শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চৌদ্দতলার এই ফ্লাটে একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা অহনা চৌধুরী বাস্তবতার জয় পরাজয়ের হিসেব নিকেশে ব্যস্ত। সোনালী ফ্রেমের চশমা আঁটা গাম্ভীর্যপূর্ণ যে চেহারায় প্রয়োজনের খাতিরে সবসময় লেগে থাকে একটুকরো কৃত্রিম হাসি। বর্তমান গতিময় বিশ্বে উপরে ওঠার খেলা যখন থেকে সে খেলতে শুরু করেছে তখন থেকে একটা মুহুর্তও অবহেলায় কাটেনি তার। তারপরও কখনও কখনও দেখা যায় ক্ষণিকের তরে থমকে যায় ব্যস্ত জীবন। পদমর্যাদা, ডেলিগেট, কনফারেন্স, সেমিনার মিটিংকে ছাপিয়ে জানালার ফাঁক গলে আসা আকাশটা একাকী, নিস্তব্ধ অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়।।
সংসারেরভাব অনটন, জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত মা, বাবা, ভাইবোনের ভালোবাসাহীন পারিবারিক বন্ধন, কলুষিত নোংরা সমাজে নিজেকে বড় করার মানসে খুব সহজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সে। সমাজের কাছে ভালো থাকার অলিখিত চুক্তিপত্রে সই করে তাই একাকীত্বের মাঝে ঠেলে দেয় নিজেকে। যেন কোন পাপ স্পর্শ করার কোন পথ খুঁজে না পায়। ধীরে ধীরে যৌবনের রঙ্গিন তানপুরাটায় ধুলো জমতে শুরু করে, তাতে ঘুণপোকার একটানা টি টি শব্দ নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিত। তখন জীবন মনে হত কোন ফটোগ্রাফারের তোলা স্থিরচিত্র, যেন সে তার অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে অনন্তকাল।।
কিন্তু না। কখনও কখনও কোন তুচ্ছ ঘটনাও কারও জীবনকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারে। এমনি এক ঘটনার হাত ধরে অহনার তরুণ জীবনের জলতরঙ্গ প্রবল ঘূর্ণিবাতাসে আন্দোলিত হয়, জোয়ারের ঢেউ আছড়ে পড়ে বার বার। ঝড়ের তীব্রতা একে একে খুলে ফেলে অভাব, হতাশা আর রক্ষণশীলতার আবরণ। ভালোবাসার উদাম নৃত্যে তাকে পাগলপারা করে তোলে। যার আবেশে সে খোলা আকাশের নীচে বালুকাময় দ্বীপের উপর দিয়ে, প্রবাহমান নদীর স্বচ্ছ স্রোতের পাশ দিয়ে হেঁটে অগ্রসর হতে লাগল।।
সামান্য বই হারানো থেকে জিতুর সাথে তার সেই পরিচয়। তারপর জিতুর পাগলামি, হুটহাট ভালোবাসার জোর আবদার, কখনওবা নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেবার সাহস মুগ্ধ করেছিল অহনাকে।তারপর সব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে, সমাজের ছি ছিক্কারের মুখে ধুলো দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল নিজেদের ভালোবাসাকে। তখন টুকরো টুকরো সুখগুলো শরতের মেঘের মত বিচরণ করত দিনভর। সুখের পরিপূর্ণতা এত সহজেই পাওয়া যায় ভেবে অবাক হয়ে যেত সে। তখন সে খুব অল্পেই খুশি হয়ে যেত যে জিতু অবাক হয়ে বলত, “তুমি এত ভাল কেন অহনা?”
জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব যখন শেষ হয়ে যায় সৃষ্টিকর্তা তখনই হয়ত মঞ্চের দৃশ্যপটে নতুন কোন প্লট জুড়ে দেন।।
বিয়ের এক বছরের মাথায় জিতুর অসুখটা যখন ধরা পড়ল তারপর থেকেই মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন একে একে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। জিতুর অফিসে একটা চাকরিও জুটে গেল। জীবন পালটে গেছে। কিন্তু তারপরও কেন সে নিঃসঙ্গ, হাজারের ভীড়ে নিজের মত করে।।
দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল। মাঝে মাঝে অহনা তার স্মৃতির সীমা খুজে দেখতে চায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় বার বার। জীবনের সাথে পুনরায় কথা বলতে শুরু করেছে সে। একাকীত্ব জীবন যাপন পূর্বের মত। অনুরাগ বা বিরাগ উভয়ই সেথা অনুপস্থিত। মাঝখানে শুধু রঙ্গিন কয়টা দিন সাদা কাগজে জলছাপ এঁকে দিয়েছে। অহনা নিজেকে প্রবোধ দেয় সব মিথ্যে, মরীচিকা কিংবা ভোর রাতের সুখ স্বপ্ন। কিন্তু তারপরও চোখ বুজলেই ভেসে উঠে ভালোবাসা, মান অভিমান, বিয়ে, সংসার, জিতুর মৃত্যু হাতে গোনা মাত্র দুটি বছর নস্টালজিয়ার মত জেঁকে বসে।