সন্ধ্যায় এককাপ চা না খেলে মাথার ভিতরে কেমন কেমন জানি করে। চিন্তা ভাবনায় ধুলি জমে, জ্যাম লেগে যায় মনে হয়। তো এই চিন্তা ভাবনার মহাসড়ককে সাবলীল, জটমুক্ত রাখতে কড়া লিকারের এক কাপ চিনিমুক্ত দুধ চা পান করার জন্য দোকানে গেলাম। আগেপরে চায়ের সাথে 'টা' খাওয়াটাও আমার অভ্যাস এবং বদঅভ্যাস।
মাসের শেষ দিকে যেহেতু আমাদের পকেট দারিদ্র্যতার দুষ্টচক্রে আক্রান্ত হয় তাই 'আয় বুঝে ব্যয় করো' পদ্ধতির সফল প্রায়োগিক প্রচেষ্টা এই সময় মাথার ভিতর সবচেয়ে বেশী চলাফেরা করে। মন চায় একটা কিন্তু করতে হয় আরেকটা। প্রায়দিনই সন্ধ্যার পর মনটা চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দিকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ায়, তার পিছু পিছু ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও। আজও মন, নাক এবং চোখের 'ত্রিদেশীয়' রেস 'চিকেন ট্রফি'র দিকেই যাচ্ছিলো কিন্তু যেহেতু স্পন্সরের দূর্বলতা রয়েছে তাই তারা নিরাশ হয়ে যথাসময়ে ফিরে এলো।
শুকনা বদনে চায়ের দোকানে বসে বসে কি খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে এক প্যাকেট ছোট রুচি ঝাল চানাচুর হাতে নিয়ে প্যাকেটের মুখ খুললাম। বলাই বাহুল্য, চিপস, চানাচুর জাতীয় প্যাকেটজাত মুখরোচক শুকনা খাবার ফ্রি তেই পাওয়া যায়। শুধু প্যাকেট এবং প্যাকেটের ভিতরের বাতাসের দামটা দিলেই হয়।
চানাচুর খাওয়া শেষ করে প্যাকেটটা দেখলাম কয়েকবার। আট টাকার 'ভোগ্যপন্যের' মোড়কে 'ঝাল' লেখা থাকলেও আমার কাছে কেন যেন ঝাল লাগলো না। কেকা ফেরদৌসির কথা মনে পড়লো ওই সময়টায়। ফেসবুকে দিনভর তার নুডলসের তেহারি বিষয়ে কয়েকটা ট্রোল দেখলাম। চানাচুরের প্যাকেটে 'ঝাল' লেখাটাও সমপর্যায়ের একটা ট্রোল বলেই মনে হলো।
দোকানদার টিভিতে ইন্ডিয়ান ফুটবল লীগের একটা লাইভ ম্যাচ চালু করে টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তাকে একগ্লাস পানির ফরমায়েশ করতাম যদি উপযুক্ত পরিমানে ঝাল চানাচুরে থাকতো। চানাচুরের রেসিপি যেমনই হোক ব্যাচেলর বাসার কোন বুয়াকে দিয়ে এই চানাচুর তৈয়ার করা হলে তাতে ঝালের পরিমান হতো কয়েক লক্ষ স্কোভেল (ঝাল পরিমাপের একক)।
হাতে যেহেতু কোন কর্ম নেই তাই প্যাকেটটাকে আরো একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম। দেখতে দেখতে প্যাকেটের গায়ে ' ১০ - ৩০ টাকার মোবাইল রিচার্জ' জাতীয় একটা লেখা চোখে পড়লো। ভালো করে পড়ে দেখলাম প্যাকেটের ভিতর একটা গোপন কোড নাম্বার দেওয়া আছে। ঐ কোডটা একটা বিশেষ নাম্বারে এসএমএস করলে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ফ্রিতে মোবাইল রিচার্জ মিলে জেতে পারে। শুধু তাই নয়, ভাগ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত হলে টিভি, ফ্রিজ, ব্লা ব্লা সহ আরো অনেক কিছু জিতার সুযোগ রয়েছে।
কোড নাম্বারটা এসএমএস করে টেনশন বেড়ে গেলো। কি না কি পাই তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট যায় কোন রিপ্লাই আসে না। হঠাৎ মোবাইলে ফিরতি মেসেজ এলো। চেক করে মেজাজটা 'ঠাস' করে বিগড়ে গেল। তারা ফিরতি ম্যাসেজে লিংকসহ জানালো, 'আমি একটি ওয়ালপেপার জতেছি'!!
মেজাজ বিগড়ে যাওয়াতে কোন কিছুই ভালো লাগছিলো না। টিভিতে খেলা চলছে। ফুটবল আমার সবচেয়ে ফেভারিট স্পোর্টস। কিন্তু সেটাও ভালো লাগছে না। তবুও চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে চেয়ে আছি। খেলা চলছে। এফসি গোয়া বনাম এতলেটিকো ডি কলকাতা। হঠাৎ একজন এসে গায়ের উপর নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো, কার খেলা ভাই?
বে-ঝাল চানাচুর, তার উপর উপহারের নামে ধোকা, তারও উপর ঘাড়ের উপর পতিত গরম নিঃশ্বাস - দাঁতমুখ চেপে ভাবলাম এখনই একটা গালি দিলে মেজাজ কিছুটা শান্ত হয় বৈকি। লোকটাকে বললাম, 'গোয়ার' খেলা।
কয়েক মিনিট পর......
চা খাওয়া শেষ করে 'বদঅভ্যাসের কাঠি'তে আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে কিছুটা রিলাক্সড আবিষ্কার করলাম। মেজাজোটাও ফুরফুরা হয়ে গেলো। 'বদঅভ্যাস' পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলা দেখবো বলে মনস্থির করলাম।
টিভির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করেই একটা পরী এবং একটা হুরপরী এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। মুগ্ধ হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। মনের ভিতর ডিজে গান বাজছে অবিরত। এত সুন্দর কাজলমাখা চোখ, এত সুন্দর চুল, এত সুন্দর.... আহা!! মোবাইল রিচার্জ না পাওয়ার বিদঘুটে কষ্টটা নিমিশেই উবে গেল।
তাদের জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরতে যাবো এমন সময় হুরপরীটা বললো, 'ভাইয়া সানসিল্ক শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক হবে?'
তাদের এই কথা শুনে ফের মেজাজ বিগড়ে গেল। আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশী। নিজেকে আলিফ লেয়লার দুই শিং ওয়ালা রাগী জ্বিনের মত মনে হতো লাগলো। একবার ভাবলাম পরী দুইটারে রাগী জ্বিনের মত আছর করি। আবার ভাবলাম, সানসিল্ক শ্যাম্পুরর মিনিপ্যাক খেয়ে মরে যাই। এত্ত বড় একটা ঘটনা, একে তো ভাইয়া ডাকছে তারউপর আবার দোকানদার ভাবছে।
ক্ষানিক পর মনে হলো, বদ অভ্যাসের কাঠির আগুন দিয়া দুনিয়াটা জ্বালিয়ে দেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৪