গত কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। স্ট্যাটাসটা ছিলো কারা পাশে থাকে কারা থাকেনা এই নিয়ে যেটা ছিলো হুবহু এমন, 'যারা পাশে থাকে আমরা তাদেরকেই পাত্তা দেই না। যেমন প্যাকেটের দুই পাশের দুই পিস রুটি, কেক।'
তখন আমার কোন প্রেমিকা ছিলো না। বলা বাহুল্য এখনো নাই। এই জনম দুঃখী মানুষের সেই স্ট্যাটাসের পর আমার অনেক বন্ধুরা ইনবক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সবাই ভাবলো হয়তো কারো সাথে গন্ডগোল কিংবা অন্যকিছু অথবা নতুম উদ্যমে ছ্যাকা খেয়েছি। তাদের বললাম, হে বন্ধুগন তোমরা যা ভাবতেছ বিষয় আসে তা না। বিষয়টা হচ্ছে, চা-টা খাইতে সন্ধ্যায় টং দোকানে গেলাম। বিপদের বন্ধু, দরদী দিলখোশ দোকানদার মামুর কাছে গিয়ে দেখি প্যাকেটে এক পিছ মাত্র কেক। সেটা আমি নিতে যাবো তার আগেই কচ্ছপ খরগোশের রেসের মত আমাকে একজন পিছনে ফেলে কেকটা নিতে গেলো। একমাত্র এবং প্যাকেটের পাশের মোটা পিছ হওয়ায় সে উৎসাহ হারিয়ে ফেললো। তার নিরুৎসাহিত চেহারা দেখে দোকানদার মামু বিষণ্ণ বদন হয়ে গেলো। তার সাত টাকার কেক অবিক্রিত থেকে যাবে এটা আমি গ্রাহ্য করতে পারলাম না। মাসের শেষে সে আমাদের বাকি দিয়ে জীবিত রাখে। তাই উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন পূর্বক আমি সেই কেকটাকে সগৌরবে হাতে নিলাম এবং খেলাম। আর কেক দেখে ঐ লোকের যে ইমোশনাল ব্রেকডাউন হলো তা ব্যক্ত করতেই মূলত স্ট্যাটাসখানা ফেসবুকে আপ্লোডাইলাম।
সব শুনে বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে শালা সম্বোধন করে গালি দিলো এবং স্ট্যাটাসে লাইক দিয়ে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়লো।
আমি ব্যাচেলর মানুষ। ব্যাচেলররা ভালোবাসা পায় না। আমি এবং আমার কাছের বন্ধুরাও পাই না। দু এক মাস পরপর মরুর বেদুইনের মত আমরা খ্যাতা বালিশ সমেত নতুন বাসায় স্থানান্তরিত হই। নতুন ভালো বাসা পেলাম বলে স্বস্তি প্রকাশ করি এবং কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমাদের উপলব্ধি হয় আসলে যেটাকে আমরা ভালো বাসা বলি সেটা আসলে ভালো বাসা নয়। ভালো বাসায় ছারপোকা থাকে না।
ব্যাচেলর বাসায় রান্নার জন্য খালা রাখা হয়। আমি তাদের বুয়া বলতে নারাজ। মানুষকে পেশায় নয় বরং সম্পর্কে মূল্যায়ন করতেই আমার বেশি ভালো লাগে। তো, একবার ভালোবাসা দিবসে আমাদের খালা এলো না। খালার অনুপস্থিতিতে আমরা দিশেহারা উদ্বাস্তুর মত হয়ে গেলাম। দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। খালা এলো না। তাই সাংগঠনিক সম্পাদকের মত উদ্যোগ নিয়ে রান্না করতে গেলাম। রান্না হবে শুধু ভাত। আর যে যার মত ডিম ভেজে খাবে।
ডিম ভাজতে গিয়ে আমার মাথায় একটা যুগান্তকারী চিন্তা এলো। অভুক্ত পেটেই সেই চিন্তাটা ফেসবুকে স্ট্যাটাস আকারে দিয়ে দিলাম। ভালোবাসা দিবসের স্ট্যাটাস হিসেবে লিখলাম, 'সহজে ভাঙ্গা যায় এমন জিনিশের তালিকায় প্রথমেই আছে মানুষের মন। তারপর ডিম।'
খেয়েদেয়ে ফেসবুকে লগইন করে দেখি তুলকালাম কান্ড। ফ্রেন্ডলিষ্টের দুইজন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী আমার স্ট্যাটাসে এসে কমেন্ট করলো এবং একে অন্যের সাথে কিচির মিচির শব্দে প্রায় ঝগড়া শুরু করে দিলো। একজনের বক্তব্য হচ্ছে, কাঁচও কিন্তু খুব সহজে ভাঙ্গে। উদাহরণ হিসেবে নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের কথা বললো। আরেকজনের বক্তব্য হলো, কাঁচ অনেক সময় ভাঙ্গে না। হাত থেকে পড়ার পরও যেমন ছিলো তেমনই থেকে যায়। উদাহরণ দিলো পানির গ্লাস। দুই আঙ্গুলের মাঝের বিড়িটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের বাকবিতন্ডার লাইভ টেলিকাস্ট দেখলাম এবং ক্ষানিক বাদে মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমাতে চলে গেলাম।
আরেকদিনের কথা বলি। সেদিন ভোরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হাই ভোল্টের ইলেক্ট্রিক পিলার দেখে মনে হলো, এই ইলেকট্রিক পিলার এবং মোবাইল টাওয়ারের ফাউন্ডেশনের ব্যাপ্তি যতটুকু যায়গা জুড়ে থাকে অতটুকু যায়গাও আজকাল কেউ কারো মনে দখল করে নিতে পারে না। কালোজিরা দেয়া চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে আবারো মনে হলো, চাইলেই কারো মনে যায়গা করে নেওয়া সম্ভব নয়। অন্যের মনে কালোজিরা সম জায়গা নিজের জন্য প্রস্তুত করে নিতে অনেক পোড়াতে হয়। মশার কয়েল যেভাবে পোড়ে সেভাবে। খুব ধীরে কিন্তু কার্যকর ভাবে। কালোজিরা সকল রোগের এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসের মহৌষধ। চিন্তার এই ক্ষুদ্র খোরাকটা সেদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে দিলাম। ক্ষানিক বাদে দেখি অনেকেই সেই স্ট্যাটাসে লাইক দিলো এবং কমেন্ট করলো। লোল, হা হা হা কমেন্ট তারা করেই ক্ষান্ত। অথচ আমি মোটেই হাসির কথা বলি নাই। সাংঘাতিক সিরিয়াস একটা কথা শুনেও ফেসবুকে বন্ধুরা শুধু হেসেই গেলো।
মহল্লার ভিতর সস্তা যে হোটেলগুলো থাকে সেখানে কিছু খাওয়ার পর টিস্যুর বদলে পেপার, বইয়ের পৃষ্ঠা, অথবা কোন স্কুলের পরীক্ষার খাতা কিংবা প্রশ্নপত্র দু ভাগ করে কেটে হাত মোছার জন্য দেওয়া হয়। একদিন সকালে পরোটা খেয়ে টিস্যু চাইলে আমাকে একটা নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের একভাগ দেওয়া হলো। হাত মোছার আগে সেই অর্ধেক প্রশ্নপত্রের একটা প্রশ্নে চোখ আটকে গেলো। কিছু বলা কওয়া ছাড়া সেখানে দুম করে লেখা, 'বাঙ্গালীর হাতে সেদিন কি উঠেছিলো?' কোন এক শিক্ষার্থী উত্তর হিসেবে বল পয়েন্ট কলম দিয় কলম দিয়ে বৃত্ত ভরাট করেছে। ভরাট বৃত্তের পাশে লেখা 'গ্রেনেড'।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অতীত চিন্তায় না ডুবে ভাবতে লাগলাম, বাঙ্গালীর হাতে এখন কি গ্রেনেড উঠে?
উঠে বৈকি। তবে গ্রেনেড নয়। স্মার্টফোন। খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে এই বস্তু। চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা এতোই বেশি যে আমার এক বন্ধু ল্যাপটপ বিক্রি করে হাইফাই একটা স্মার্টফোন কিনলো একবার। তাকে বললাম, এ তুই কি করলি? ল্যাপটপ বেচে মোবাইল? সে বললো, আরে ল্যাপটপ তো ঘরেই থাকে। কাউকে দেখিয়ে পার্ট নেওয়া যায় না। অথচ পকেটে দামী একটা মোবাইল থাকলে অনেক পার্ট নেওয়া যায়। সুন্দরী মেয়ে এবং দামী মোবাইলের দিকে মানুষ হা করে তাকিয়ে থাকে। ভেবে দেখলাম, আসলেই। বন্ধুর কথায় যুক্তি আছে।
আমাদের মৌলিক চাহিদা এখন বদলে গিয়েছে। সৌর জগতের নতুন গ্রহের তালিকা যেমন হালনাগাদ চলে মৌলিক চাহিদা তালিকাও তেমনি হালনাগাদ হয় যুগে যুগে। স্মার্টফোন এবং ফেসবুক আজকাল মৌলিক চাহিদার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
বন্ধু খুব হিউমর সমৃদ্ধ মানুষ। পার্সনালিটিও চমৎকার। কিন্তু সে আজকাল খুব বিরক্তি এবং দুঃখের মাঝে বসবাস করে। দুঃখের কারণ তার প্রেমিকা মা হতে চলেছে। মানে, তার প্রেমিকার বিয়ে হয়েছে গতবছর। এ বছর সেই মেয়ের সন্তান হবে। বন্ধু ফেসবুক থেকে যাবতীয় সংবাদ পেয়ে দুঃখে জর্জরিত হয়ে চিতৈ পিঠার মত ঝাঁজরা হয়ে গেছে। আর বিরক্তির কারণ, তার প্রেমিকার দিনে দেড় ডজন সেলফি।
বন্ধু নতুন মোবাইল দিয়ে ফেসবুক চালায় আর আমার সাথে দেখা হলেই ক্ষোভ করে এসব বলে। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। তার হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনে নিজেও কিছুটা ব্যাথিত হয়ে তাকে বলি, আরে এসব কিছু না। এতোই যখন ক্ষোভ তখন মেয়েটাকে আনফ্রেন্ড করে দে। আর ক্ষানিক গর্বে বুক ফুলিয়ে বলি, দুঃখ কমাতে আমার স্ট্যাটাস নিয়মিত পড়তে।
বন্ধু কোনটাই করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কিছুদিন পরে তার প্ল্যান খুলে বলে। সে শুনেছে ফেসবুকে ডিসলাইক অপশন আসবে। তাই মেয়েটাকে আনফ্রেন্ড করবে না। ডিসলাইক এলে প্রথমেই সেই মেয়ের সেলফিতে ডিসলাইক দিবে। নিজের ক্ষোভ কমাবে। তাকে জিজ্ঞেস করি, আর দুঃখ কমাবি কিসে? নতুন নায়িকা পেয়েছিস নাকি? সে বলে দুঃখ কমানোর উপায়ও আছে। ডিসলাইক এলে তোর সব স্ট্যাটাসে ডিসলাইক দিমু। বলেই সে দুমড়ে মুচড়ে যায়।
আজ সকালে তার সাথে দেখা। প্রথম সাক্ষাতেই সে বললো, বন্ধু এ কি হলো? আমি কিছুটা আতংকিত হয়ে বললাম, কি হয়েছে? সে বলে, ফেসবুক তো ডিসলাইক অপশন দিলো না। লাইক বাটনের সাথে কি সব স্টিকার মার্কা হাবিজাবি বাটন দিলো!! তার দুঃখটা বুঝতে পেরে বললাম, আহারে!
বন্ধুর আশা পুরণ হলো না। সে প্রেমিকাকে ডিসলাইক দিবে বলে এতোদিন শুধু স্বপ্নই দেখলো কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হলো না। বাসায় ফিরে আসার সময় বন্ধুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, হুদাই এতোদিন ফ্রেন্ডলিস্টে রাখলাম। আরো আগেই আনফ্রেন্ড করে দেওয়া ভালো ছিলো।
বাসায় এসে ফেসবুকে লগইন দেখি বন্ধু নতুন ব্র্যান্ড নিউ স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেখানে লেখা, 'বরুণাও কথা রাখেনি, রাখেনি ফেসবুকও!!'
বন্ধুর এই ভয়ঙ্করতম হিউমর সমৃদ্ধ স্ট্যাটাসে লাইক দিলাম না। ভালোবাসা দিলাম। নতুন করে লাইকের সাথে এই ভালোবাসা দেওয়ার সিস্টেমটা যুক্ত হয়েছে। যারা এতোকাল ভালোবাসা পায়নাই তারা এখন খুব সহজেই ভালোবাসা দিতেও পারবে, নিতেও পারবে। এবার তাদের আক্ষেপের দিন সযত্নে ঘুচিয়া দিলেন মার্ক জুকারবার্গ সাহেব।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০৪