তখন আমার খুব বাজে রকমের ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে দিন কাটছে। যেরকম ডিপ্রেশনে থাকলে সারাক্ষণ মাথার ভেতর কেবলমাত্র একটা টপিক-ই ঘুরপাক খেতে থাকে.....“মরে যাবো”।
আমার কোনো বন্ধু নেই....কাছের কোনো ভাই কিংবা বোন_কিংবা এমন কেউ,,যার কাছে গিয়ে বাঁধ ভেঙে কাঁদতে পারি....সমস্তটা দুপুর ঝরঝর করে কাঁদতে পারি....সমস্তটা বিকাল হাউমাউ করে কাঁদতে পারি.......সমস্তটা সন্ধ্যা টপটপ করে চুপচাপ রুমাল ভেজাতে পারি......
কিংবা যাকে বলতে পারি_,,,,, “পারছিনা”.....আমি আর একটা মূহুর্তও পারছিনা.........
ঐরকম উদ্ভট একটা সময়ে_এক উৎকট মানুষের সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয়....পূর্ব পরিচয় স্বল্প,,,পাঁচ ফুট দশ কিংবা এগার হবে উচ্চতায়,,,কাল,,বেশ কাল,,,কথাবার্তায় খুব খাপছাড়া.......একটা ভাল রকমের আধপাগল আধপাগল ভাব আছে........যখন হাসতো,,,,খুব উদার ভঙ্গিতে হাসতো.........! যেভাবে হাসতে হয়.........!! যতখানি হাসা যায়......!!! প্রাণখোলা পরিতৃপ্ত হাসি!!!
সেই সময়টার পর থেকে পরবর্তী বছর পাঁচেক.....যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে.......খুব হাল ছেড়ে দিয়ে বলতাম,,, “ভাইয়া,,,মরে যেতে চাই....কি করবো??”
এত সহজ ভাবে আর কারো কাছে গিয়েই_কখনো হয়তো বোধহয় মরবো বলে বলিনি........কিংবা হয়তো বলেছি ........তবে_ওর উত্তরগুলা অন্য রকম ছিল........
“মরবা?? তোমাকে বান্দরবানে নিয়ে গিয়ে কোনো একটা পাহারের উপর থেকে ফেলে দিয়ে আসবো.......মরে গিয়েও শান্তি পাবা!!”
আধপাগল ভাইয়াটা কিভাবে কিভাবে যেন সত্যিকারের ভাইয়া হয়ে গিয়েছিল......আমার তো কোনো বড় ভাই নেই,,,সেই জায়গাটা আস্তে আস্তে ওর দখলে চলে গিয়েছিল......
৫ বছরে অনেকবার একসাথে হেঁটেছি.......দু:সময়ে....সুসময়ে.......বেশ কয়েকবার ওর বাসাতেও গিয়েছি.....আন্টি সারাবছর-ই অসুস্থ থাকে....বিছানায় শোয়া.......তার সাথেও জমে গিয়েছিল বেশ.......আন্টির একটাই ছেলে.....আর কোনো ছেলেমেয়ে নেই......সেই ছেলেটাও হয়েছে এমন আধপাগল......আন্টির আফসোসের কোনো শেষ ছিলনা.......
একটা সময় ওর জীবনেও ঝড় আসল......ভয়ংকর ঝড়.............পছন্দ করে বিয়ে করলো......বিয়েটা আর টিকলোনা.........ডিভোর্সের পর থেকে ছকের গুটি উল্টে গেল......এবার ওর ডিপ্রেশনের পালা....
রাতের পর রাত...দিনের পর দিন.....কীরকম অসহ্য অসহনীয় দিন কাটাতে কাটাতে একটা সময় গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে চাইল বেচারা....কপালে ছিলনা,,,পরলনা..........বেঁচে গেল......
তারপর দিন থেকে মাস_ মাসের পর মাস.....বছরের পর বছর......কয়েকবছর.......বেশ কয়েকবছর...................
ও তারপর পুরোদস্তুর ট্রাভেলার.......বন জঙ্গল সমুদ্র ঝর্না......উঁচু উঁচু পাহার......এগুলোই জীবন.....বাকিটা জীবন এভাবেই কাটবে........সপ্তা দুয়েক ট্যুর দিয়ে ফিরে শহরে আসলেই ফোন দিত একটা......
“নারায়ণগঞ্জে আছি,,,দেখা করে যেও....বাসায় এসো.....কেমন আছো?? পড়াশোনা কর??? কবে নাগাদ পাশ করবা?? আমার আম্মুটাতো অসুস্থ,,,ডাক্তার লাগে তো হাতের কাছে একটা....”
সকালবেলায় মাঝে মধ্যে সাইকেল নিয়ে বের হতাম.....খুব সকাল....সাড়ে পাঁচটা ছয়টা হবে.......ওর সাথে হুট করে দেখা হয়ে যেত...জগিং এ বেড়িয়েছে!
একদিন খুব তাড়াহুড়ো করে হাঁটা দিয়েছি,,ভর দুপুর,,,,,,দেরী হয়ে গেছে....হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝখানটায়_দাড়িয়ে আছেন উনি!!
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,,,রাস্তার মাঝখানে এভাবে কেন দাড়িয়ে আছ???
মুখে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে বলল,,, “তোমাকে দেখেই তো দাড়াইছি বোকা!!”
শেষবার যখন দেখা হল তখন রাত ৯ টার মত বাজে...শহীদ মিনারের পেছনটায় দাড়িয়ে আমের শরবত খাচ্ছি,,,ওর সাথে দেখা...বেশখানিক্ষণ জোড়াজুড়ি করলো,,বাসায় চলো....কাছেই তো বাসা........আম্মুর শরীরটা ভালনা.....আর বেশীদিন বাঁচবেনা বোধহয়.........
যাওয়া হয়নাই আর.......যাইনাই........
তারপর শেষ কথা ফোনে,,, "একটা টিউশন আছে,,করবা????"
করা হয়নাই আর........করিনাই...........
,,,,,,,,
,,,,,,,,,,,,,,,
এর সপ্তাখানেক পরেই পাহাড় চষে বেড়ানো আধপাগল মানুষটা হুট করে মরে গেল.....একেবারেই হুট করে.......আমি আমার জীবনের এই বছর পঁচিশ অবধি কাছের কাউকে এমনভাবে মারা যেতে দেখিনাই.........ছোটবেলায় দাদুকে মারা যেতে দেখেছিলাম...তারপর নানা মারা গেল...তারপর এক কাকু মারা গেল......কিন্তু,,,ঠিক এমনভাবে মৃত্যুটাকে আর কখনোই ফিল করিনাই......কিরকম দুম করে নাই হয়ে যাওয়া.........ঠিক এই ছিল_এই এখনি নাই হয়ে যাওয়া...............
বান্দরবান থেকে ম্যালেরিয়ার জীবানু নিয়ে ফিরেছিল.......ব্রেইন পর্যন্ত চলে গেল ব্যাপারটা...সেরেব্রাল ম্যালেরিয়া........কয়েকটা দিন অচেতন অবস্থায় কাটিয়ে যেদিন রাতে জ্ঞান ফিরে পেল,,,বাবা-মা বন্ধু-বান্ধব সবাই যখন বেশ কিছুটা আস্বস্ত হল,,,সেদিন ভোরেই চিরদিনের মত হারিয়ে গেল মানুষটা.........
আমার তখন প্রফ চলছিল,,মনে আছে,,সেদিন টানা ১৮ ঘন্টা পড়েছি....পরেরদিন-ই শেষ পরীক্ষা.........ছেলে হলে ঘন্টাখানেক খরচ করে জানাজায় দাড়িয়ে আসতে পারতাম.........মেয়েদের তো আর ওই সুযোগটা নাই....যেতে হলে সরাসরি বাসায় যেতে হতো.....,,,আন্টির মুখোমুখি গিয়ে দাড়ানোর মত সাহস আমার এখন পর্যন্ত হয়নাই......,,,এই মহিলাটা কেমন করে বেঁচে থাকবে অবশিষ্ট জীবন???? তাকে সান্তনা দেবার মতন কোনো শান্তনার কি এখন পর্যন্ত জন্ম হয়েছে???
পরেরদিন পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা থেকে বাসে করে ফিরছি........তুমুল বৃষ্টি.........সমস্ত পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে.........আমার হুহু করে কান্না পাচ্ছে..........মনে হচ্ছে,,মুনীর ভাইয়ের কবরটা পানি দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে.......ও পানির ভেতর ডুবে যাচ্ছে..........ও নিশ্বাস নিতে পারছেনা...............আমার কেবল-ই ওর গলার শব্দ,,,আর সেই সুবিস্তৃত হাসিমুখটার কথা মনে পরে.......যখন মরে যাবার পর আবার কোনোদিন দেখা হবে,,,তখন খুব রাগ করবো.......নাক মুখ কুচকে কর্কশ গলায় জানতে চাইবো,,,
এটা কি চলে যাওয়ার বয়স ছিল??? আঠাশ কিংবা উনত্রিশ,,,,,এটা কি চলে যাবার সময়??? এমন করে সবাইকে কাঁদিয়ে কেউ কি কখনো চলে যায়??????????
কিন্তু যায়....সবাই এভাবেই যায়...........এই মৃত্যুটা শুধু কেবল কাছ থেকে দেখিয়ে গেল ব্যাপারটা...এইরকম কাছ থেকে সত্যিই আর কখনো ফিল করতে পারিনি..........
একদিন রাত ন’টার দিকে ভাইয়ার নাম্বার থেকে ফোন আসলো,,,কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করলাম,,,
“তুমি কি তটিনী?? মেডিকেলে পড়তা সেই তটিনী??”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম........আন্টি ফোন দিয়েছেন.......বেশ সহজ গলায় জানতে চাইলেন,,,কেমন আছ মা??? মুনীরের খবরটা কি শুনছো??
বললাম,,,আমি খুব দু:খিত আন্টি...আপনার সামনে গিয়ে দাড়ানোর মত সাহস করে উঠতে পারিনাই.....তাই দেখা করতে যাইনাই.......আপনাকে শান্তনা দেবার মতন শক্তি,,,আমার ভেতরে নাই.......কেমন আছেন আপনি ???
বললেন,, “ভাল আছি মা...আমি খুব শক্ত.......দিন কেটে যায়.......মুনীরের কম্পিউটারের সামনে বসে ওর মোবাইলটা নিয়ে ওর বন্ধুদের সবাইকে ফোন দিচ্ছি.....আমি সবার খোঁজ-খবরই রাখি......”
................এটাই জীবন,,,,,
তবে যেটাই জীবন হোক পাহারে যাবার আগে অবশ্যই ক্লোরোকুইনের ডোজ নিয়ে যেতে হবে........
"সবুজের মাঝেই কাটিয়ে দিতে হবে অবশিষ্ট জীবন".......,,,এইরকমটা যারা স্বপ্ন দেখে,,,তাদেরকে এইভাবে হারিয়ে যেতে নেই.......
ওর একটা ছবি নিবো বলে একটুখানি আগে ওর প্রোফাইলটা ঘুরে আসলাম........এবং আবার কেঁদে ফেললাম.........এত্ত মানুষের ভালবাসা ও পেয়েছে.........বেঁচে থাকার সময়টাতে ও কি কখনো ফিল করতো,,সবাই ওকে কত্তখানি ভালবাসে????
আর আল্লাহ্-ও এমন,,,যখন কেউ জোর করে হলেও মরে যেতে চায়,,তখন উনি কষ্ট দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখেন.........আর যখন কেউ সমস্তটা জীবন ধরে সবুজ দেখে বেড়াবে বলে পাহাড় চড়ে বেড়ায়,,,
তখন উনি টুপ করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে যান তাকে..........
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এই সমস্ত mysteryর আসলে কোনো উত্তর নেই,,,............
রিমেম্বারিং মুনীর ভাই.........বেঁচে থাকবা,,,,বেঁচে থাকা মানুষগুলোর অবাধ্য চোখের কোনায় কোনায়......
যেখানেই আছো,,,ভাল আছো নিশ্চই.......
আর না থেকে থাকলেও,,ভাল থেকো............
ইতি,,
"ছোট বোন" ......তোমারও তো কোনো বোন ছিলনা......
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ২:২৫