মানবজমিন ১১/০৫/১১
সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের (এমপি) আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) বা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে নেয়া প্রত্যয়ন ছাড়া চাকরি মিলছে না। অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বা প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে সুপারিশ নিলেও কাজে আসছে না। তার সঙ্গে স্থানীয় এমপি বা অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের চিঠি জুড়ে দিতে হচ্ছে। তবেই মিলছে চাকরি নামের সোনার হরিণ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা বেশি ঘটছে। দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীর নন-ক্যাডার পদেও এমন ঘটনা ঘটছে। তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়। এর ফলে ধীরে ধীরে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয় বিবেচনায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হলে তা প্রশাসনের জন্য ভাল ফল বয়ে আনে না। এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কাজের চেয়ে দলীয় বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন সবচেয়ে বেশি। যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল কখনও ভাল হয় না। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান মানবজমিনকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কোন সময়েই ভাল নয়। একই সঙ্গে সংবিধান সম্মতও নয়। কারণ সংবিধানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ার কোন কথা নেই। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাজী শামসুল আলম বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেলে সরকার কোন লাভবান হয় না। বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্য অধিদপ্তরে গতকাল সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খানের দপ্তরে তদবিরকারীদের বেজায় ভিড়। সবাই এমপির ডিও লেটার যুক্ত করে আসছেন চাকরি পেতে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এমপিরা ডিও লেটারের প্রতিটি কপি আলাদাভাবে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, সংস্থা প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে সিদ্ধান্ত নিতে কাউকেই কোন ধরনের বেগ পেতে হচ্ছে না। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক হাঙ্গামার পর থেকেই এমন সিস্টেম চালু হয়েছে। এর ফলে সরকারি শূন্য পদে নিয়োগ হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। ওদিকে খাদ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া চাকরির আবেদন আমলে নেয়া হচ্ছে না। এমনই একটি প্রত্যয়নপত্র মানবজমিনের হাতে এসে পৌঁছেছে। ওই প্রত্যয়নে স্বাক্ষর করেছেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। প্রত্যয়নে এক প্রার্থীর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি আওয়ামী যুবলীগের সঙ্গে জড়িত। বিগত জোট সরকারের আমলে তিনি এবং তার পরিবার বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এমন প্রত্যয়ন নিয়ে অনেকে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খানের কাছে তদবির করতে আসতে দেখা যায়। ওদিকে বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং এর আওতাধীন দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর ও মাঠ প্রশাসনে শূন্য পদের সংখ্যা দু’লাখ ১০ হাজার ৮০১। এসব পদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর পদ খালি রয়েছে ৩৫,৪৬০টি। এছাড়া ২২,৪৩৬টি দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ, ১০৬১১৮টি তৃতীয় শ্রেণী ও ৪৬৬৭২টি চতুর্থ শ্রেণীর পদ খালি রয়েছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে মঞ্জুরিকৃত ১২৫০৮৬১ পদের বিপরীতে এসব পদ এখন শূন্য রয়েছে। এর আগে বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রায় দু’বছর সময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি শূন্য পদ পূরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী প্রতিটি ঘরে একটি করে চাকরি দেয়ার জন্য। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কয়েক বার চিঠি দিয়ে শূন্য পদ পূরণে তাগাদা দিয়েছেন। এরপরও কাজে গতি আসছে না। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শূন্য পদে ছাড়পত্র নিয়োগ নিয়েছেন। মাসের পর মাস কেটে গেলেও শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য কোন কূল কিনারা করতে পারছেন না তারা। প্রশাসনিক দুর্বলতা, পিএসসির সময়মতো নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করা, আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের কারণে কিছু পদে লোক নিয়োগ থেমে যাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সমস্যাসহ নানা কারণে এসব পদে লোক নিয়োগ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন ওই কর্মকর্তা। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গেল এক বছরে মাত্র ১৯,২০৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৮৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া এক বছরে ৯১৩০ জন সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৯০৮ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ২১ জেলা প্রশাসনের কার্যালয়, রেলওয়ে, ডাক, পুলিশ ও ২২টি দপ্তর ও অধিদপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা বেশি। শূন্য পদের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়টির দপ্তর ও অধিদপ্তরগুলোতে সব মিলিয়ে ৩৮,৩৭২টি পদ শূন্য রয়েছে। অর্থ বিভাগের দপ্তর ও অধিদপ্তরগুলোতে ৩৬,৫৭৯টিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অনেক পদ খালি রয়েছে। এখন পদ পূরণ করতে পদে পদে সমস্যায় পড়ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরগুলো।