যায়যায়দিন ০৮/০৫/১১
কদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এতে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অন্ধের যষ্ঠি একমাত্র সন্তান হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে অনেক পরিবার। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষাজীবন ও শিক্ষা শেষে কাজের অনিশ্চয়তা, পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা, ঠুনকো আবেগ ও ব্যক্তি জীবনে হতাশা, দুশ্চিন্তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ আত্মঘাতী প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে। অথচ একটু উদ্যোগী হলেই শিক্ষিত শ্রেণীর সম্ভাবনাময় এ শক্তিকে এ ধরনের ভয়ানক প্রবণতা থেকে ফেরানো সম্ভব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্মহত্যা রোধে কোনো কাউন্সিলিং সেল বা সেন্টার না থাকায় শিক্ষার্থীরা দিন দিন ঝুঁকছে হন্তারক এ প্রবণতার দিকে। গত তিন বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা চেষ্টাও করেছে প্রায় এর সমান।
এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও বিশিষ্ট মনোবজ্ঞিানী প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহ বলেন, পরিণত বয়সে এসে আত্মহত্যাটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এজন্য আমাদের ত্রুটিযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা অনেকটা দায়ী। এছাড়া সহপাঠীদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা সম্পর্ক, পারিবারিক এবং পারিপাশ্বর্িক কিছু উপসর্গ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সাত-আট মাসের শিক্ষা সমাপ্তির অপেক্ষা না করেই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল ইমরান আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে এক চিরকুটে সে জানায়, 'আমি যে কী করতে যাচ্ছি তা হয়তো আমি নিজেও জানি না। তবে যা কিছু হচ্ছে তা নিজের ইচ্ছায়। কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই।' ইমরানের পথ ধরে একইভাবে আত্মহত্যা করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়মা সুলতানা এ্যানী, ফাতেমা তানজিন ঝরনা ও শ্রী নিবারণ। ২০১০ সালে
প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলের আবাসিক ও অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ফারহানা রাহী। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আত্মহত্যা করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের আবাসিক ছাত্র সোহানুল ইসলামও। সোহান আত্মহত্যার জন্য বিভাগীয় সেশনজটকে দায়ী করে চিরকুট লিখে যায়।
তিন বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ছন্দা রানী সরকার হলের বর্ধিত অংশের ৮০ নাম্বার কক্ষে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এর ঠিক পরের দিন ওই হলেরই আরেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তাদের পরে একই হলের অাঁখি ও জোহরা খান প্রজ্ঞা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। 'পারিবারিক সমস্যা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছি'- এরকম চিরকুট লিখে ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল আত্মহত্যা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র আবুল হাসান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জানুয়ারি মাসে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী শামসদ পারভীন অনু ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। একই বছর ছাত্রী হলের অভ্যন্তরে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় আরেক ছাত্রী। গত মার্চ মাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যা করে আরো তিন শিক্ষার্থী। তারা হলো চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নিশাত ফারহাত, লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাহাকুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী কবিতা রানী রায়।
এ ছাড়া একই মাসে দর্শন বিভাগের সম্মান শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রকি, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রবীন্দ্র ভবনের সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
প্রেমঘটিত কারণে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি বহ্মপুত্র নদে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শেষ বর্ষের এক ছাত্রী। এমন আরো কিছু ঘটনা আছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও।
অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট বিশ্বদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা জানান, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তা ও সুস্থ বিবেক তৈরির কারখানা। সেখানে বহুমুখী প্রতিভার সংমিশ্রণ ঘটে। ফলে শিক্ষার্থীদের একে অন্যকে জানার সুযোগ ঘটে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এ আত্মঘাতী প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের পরিবারে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনে।
এ ব্যাপারে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিপা দাস বলেন, একটি আত্মহত্যার ঘটনা সম্পর্কে জানার পর যখন কোনো শিক্ষার্থী কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখন সে ভাবে মৃত্যুই বোধ হয় সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ উপায়। এভাবেই আত্মঘাতী প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ঝরনা সাহা জানান, একজন শিক্ষার্থী কোনো কারণে চিন্তার অস্থিরতায় ভুগে অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্তের দিকে এগোয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনোবল বৃদ্ধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। অথচ এটি থাকা খুবই জরুরি। কারণ একজন শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ, বন্ধু-বান্ধবী সবার পরিশ্রম, মেধা ও অংশীদারিত্ব এবং দায়বদ্ধতা রয়েছে। যে কেউ চাইলেই তার ইচ্ছামতো চলে যেতে পারে না। তাকে যেতে দেয়াও যায় না। এজন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্তত একটি করে কাউন্সিলিং সেন্টার করতে পারে। যেখান হতাশাগ্রস্ত, মানসিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্যম, চিন্তা ও কাজের শক্তি ও সামনে চলার অনুপ্রেরণা বা মন্ত্রণা দেয়া হবে। এছাড়া এর পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্ক আরো সহজ করারো দরকার আছে বলে জানান ঝরনা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গোলাম সাবি্বর সাত্তার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এই সংসারে কাউকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। সঙ্কটময় মুহূর্তে বেঁচে থাকতে তাকে সাহস যোগানো হয় মাত্র। কিন্তু এই কাজটিই এখনো করে উঠতে পারেননি। কাউন্সিলিং একটি বড় বিষয়। কোনো কারণে মানসিকভাবে কেউ ভেঙে পড়তেই পারে। তাই বলে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে কেন? এজন্য মনোবিশেষজ্ঞদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। তবে শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্টুডেন্ট কাউন্সিলিং সেল গঠনের ব্যাপারে প্রস্তাব আনা হবে বলেও তিনি জানান।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মনোবিকাশে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই, তা সত্যিই হতাশাজনক। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ব্যবস্থা থাকলে আত্মহত্যা থেকে শুরু করে অনৈতিক-অসামাজিক কাজ থেকেও দূরে থাকতো শিক্ষার্থীরা।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেগপ্রবণ আত্মহত্যার বিষয়টি দিন দিন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত নিজেকে, তারপর পরিবার, বন্ধু-স্বজন এবং সমাজের প্রত্যেককে চেষ্টা করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে প্রেমঘটিত, আর্থিক টানাপোড়েন, সম্ভ্রমহানি, একাডেমিক কঠোর সিস্টেম ও সেশনজটসহ অনেক অব্যস্থাপনাই দায়ী। তারপরও সবার আগে পারিবারিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও আস্থার অবস্থান তৈরি করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদালয়ে অন্তত একটি করে কাউন্সিলিং সেন্টার গঠনের উপর জোর দেন তিনি। শিক্ষার্থীদের গ্রাজুয়েশন কোর্স কারিকুলামে মানসিক কাউন্সিলিং বিষয়ক আলাদা সিলেবাস রাখা উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।
জানা গেছে, সমপ্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের উদ্যোগে কাউন্সিলিং সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে বিভাগের আবদুল মুনিম স্মৃতি পাঠাগারে ৫ দিন ৬টি গ্রুপে শিক্ষার্থী নিজেরাই ভিকটিম বা 'মোক' করে কাউন্সিলিং করবেন। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে শিক্ষার্থীদের যদি যথাযথ কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ আত্মহত্যা রোধ করা সম্ভব।