মানবজমনি ০৭/০৫/১১
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
‘ফতোয়া’ নিয়ে দেশের আলেম সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকদের বিরোধ ইতিপূর্বে হরতাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ফতোয়া প্রদান করাকে বেআইনি ঘোষণা করার পর সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল হয়েছে। আপিলের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট দেশের সিনিয়র আইনজীবী ও ওলামাগণের মতামত শুনেছেন। প্রায় সকলেই হাইকোর্টের ওই ঢালাও রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
ফতোয়ার সাদামাটা অর্থ হচ্ছে, কোন একটি বিষয়ে ইসলামের অনুশাসন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে সে বিষয়ে উপযুক্ত ধর্মবেত্তার সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করা।
এখন প্রশ্ন, এই উপযুক্ত ব্যক্তিটি কে হবেন? নিশ্চয়ই ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছেন এমন একজন। এমন ব্যক্তিদের ‘মুফতি’ নামে অভিহিত করা হয়। মিশরে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুফতি নিযুক্তি দেয়া হয়। আমাদের দেশে ‘কাজী’ যেভাবে নিযুক্ত হন। সেদেশে সর্বোচ্চ পদাধিকারী মুফতিকে বলা হয় ‘গ্র্যান্ড মুফতি’।
আজকের বাংলাদেশে কে ‘ফতোয়া’ দেবেন, কার ‘ফতোয়া’ ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণীয় হবে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও মর্যাদা পাবে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে অনেক সময় শক্তিমান ব্যক্তিরা বিচারের প্রহসন চালিয়ে তাদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের দিয়ে ‘ফতোয়া’ জারি করিয়ে থাকেন। দেখা যায়, এ ধরনের বেশির ভাগই ফতোয়া-ই ‘নারীঘটিত’। ইসলামে তালাক প্রদান এবং তা কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক শর্ত রয়েছে। স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তা কার্যকর হয় না। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কিছু মাতবর শ্রেণীর লোক এ নিয়ে অতি উৎসাহে সালিশ দরবার বসায়। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা মাওলানা নামধারী কাউকে দিয়ে ঘোষণা দেয়া হয়- ‘ওদের তালাক হয়ে গেছে, তারা আর স্বামী-স্ত্রী নয়’।
তারপরের বিধান, আবার যদি তারা একত্রে থাকতে চায় তাহলে মেয়েটির ‘হিল্লা’ বিয়ে অর্থাৎ তৃতীয় কোন ব্যক্তির সঙ্গে ‘সাময়িক বিবাহ’ দিতে হবে এবং সে বিয়ে কনসামেটেডও হতে হবে। তারপর সেই ‘অস্থায়ী স্বামী’র কাছ থেকে তালাক নিয়ে আগের স্বামীর সঙ্গে নতুন করে হতভাগিনী মেয়েটির বিয়ে পড়াতে হবে!
স্বামী যেন যখন তখন তালাক উচ্চারণ থেকে বিরত থাকে সেজন্যই সম্ভবত এই বিসদৃশ ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে এর সুযোগ নেয় দুষ্ট লোকেরা। শোনা যায়, অনেক সময় মেয়েটিকে নির্দিষ্ট কারও অঙ্কশায়িনী করার সুযোগ নেয়ার জন্য এ ধরনের ‘ফতোয়া’-নাটক সাজানো হয়।
এক্ষেত্রে মাওলানা নামধারী ব্যক্তিটি আদৌ ফতোয়া দেয়ার যোগ্য কিনা, সে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে না।
ধর্মের অনুশাসনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতেই পারে। আমাদের সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা বাধ্যতামূলক মনে করেন তেমন লোকের সংখ্যাই বেশি। এটা এদেশের সব ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন ব্যক্তিদের জোর করে ‘আধুনিক’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বানাবার চেষ্টা করা বৃথা। সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থেই তাদের ধর্মীয় চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যারা ধর্ম মানেন না বা ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না তাদেরকেও এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে।
তবে ফতোয়ার অপব্যবহার যাতে না হয় সে ব্যাপারেও অবশ্যই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে শাস্তি প্রদান, যেমন দোররা মারা বা পাথর ছুড়ে মারা, গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ হতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের আলেম-ওলামাগণকেই বেশি সোচ্চার হতে হবে। কেবল ফতোয়ার অধিকার দাবি করলেই চলবে না, ফতোয়ার মর্যাদাও রক্ষা করতে হবে।
ফতোয়া এবং ‘ফতোয়াবাজি’ এক কথা নয়।
(ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।)