মানবজমিন, বুধবার, ০৪ মে ২০১১
অবিকল চাইনিজ মোবাইল ফোন সেট, ফ্লাক্স, ওয়াটার হিটার। সিলমোহরও চাইনিজ। মেড ইন চাইনিজ লেখা এসব মালামাল তৈরি হচ্ছে ঢাকার জিঞ্জিরায়। আর অবিকল চাইনিজ এসব মালামালে ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পাইলট, সিনিজু, রিগ্যাল। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে আই ফোন, ম্যাক্সিমাস কোম্পানির নাম। কেরানীগঞ্জ থানার জিঞ্জিরা। নকল পণ্য তৈরির নামকরা স্থান।
গুলিস্তানের ফোন মার্কেট থেকে মোবাইল ফোনের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা পার্টস কিনে নেয় তারা। আর এগুলো দিয়েই ইঞ্জিনিয়াররা ফটাফট তৈরি করছে নকল মোবাইল ফোন সেট। আর বসিয়ে দেয়া হচ্ছে চিনের নামী-দামি কোম্পানির সিলমোহর। এই জিঞ্জিরায় আগানগর, বাসপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট, এলাকার বাসাবাড়ি ও গুলশান সিনেমা হলের সামনে হাবীব কমপ্লেক্সে এসব পণ্য তৈরি হচ্ছে। আর বিখ্যাত সব কোম্পানির মালামাল তৈরি করছে লেখাপড়া না জানা কারিগররা। এদের ইঞ্জিনিয়ার নামে ডাকা হয়। এ রকমই একজন ইঞ্জিনিয়ার রাকিব। স্কুলের মুখ দেখেনি জীবনে। বয়স যখন ১০ বছর তখন এই জিঞ্জিরায় পা রাখে। প্রথমে ফুট-ফরমায়েশ খাটতো। এখন নামী ইঞ্জিনিয়ার। হাতের ইশারায় তৈরি করে ফেলে মোবাইল ফোন সেট। একটি ফোন সেট হাতে দিয়ে বলে, দেখুনতো চেনেন কিনা, ফোনটা জিঞ্জিরার না দেখে চেনার উপায় নেই। বলে, এখানে সবই নকল হয়। সরজমিনে দেখা যায়, বাঁশপট্টি বেড়িবাঁধ এলাকায় একটি কার্গো ট্রাক থেকে কার্টন ভর্তি মালামাল নামছে। সামনের চায়ের দোকানদার জাফর জানালেন, এগুলো চায়না ফ্লাক্স তৈরির উপকরণ। এখানে বসেই তৈরি হবে চায়নার ফ্লাক্স। চা দোকানের পেছনে মনির হাজির কারখানা। এখানে ফ্লাক্সের বডি তৈরি হয় আর কার্টনগুলোর ভিতরে রয়েছে রিফিল (ফ্লাক্সের ভিতরের কাচের অংশ) সহ আরও অনেক বস্তু। ফ্লাক্স বানানোর মতো মেশিন ও জনবল তার রয়েছে। এখানে তৈরি ফ্লাক্স হয়ে যায় ‘মেড ইন চায়না’। খোঁজ নিতে গ্লোবাল মেটাল ও গ্লোবাল হারিকেন কারখানার ভিতর ঢুকতে চাওয়া হলে কারখানার দারোয়ান বাধা দিয়ে বলেন, ভিতরে কারও প্রবেশ নিষেধ। আপনার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে মালিকের সঙ্গে কথা বলেন। কারখানার কর্মচারী পরিচয় দানকারী বাবুলের সঙ্গে মালের উৎপাদন খরচ বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, এখানে একটা ফ্লাক্সের বডি বানাতে ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ পড়ে। আর রিফিল বাইরে থেকে আনতে খরচ ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সবমিলে একটা ফ্লাক্স ১০০ টাকার ভিতরে প্রস্তুত হয়ে যায়।
চায়না পাইলট, সিনিজু ও রিগ্যাল ফ্লাক্সের প্রকৃত বাজারদর আড়াইশ’-তিনশ’ জোর সাড়ে তিনশ’ টাকা। চায়না থেকে এই মালগুলো আনতে দুইশ’ টাকার উপরে খরচ পড়ে বলে জানায় চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ফ্লাক্স বিক্রেতা ও আমদানিকারক ভাই-ভাই ক্রোকারিজের মালিক বাদশা।
হাবীব কমপ্লেক্সের আধুনিক কম্পিউটার সেন্টারে নানান ব্র্যান্ডের চায়না মোবাইল ফোন সেট চায়না চার্জার, ওয়াটার হিটার ও ফ্লাক্স দেখা যায়। ব্যবসায়িক কাস্টমার পরিচয়ে দোকানের কর্মচারীর রফিকের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপের এক পর্যায়ে আর্থিক দুর্বলতার কথা জানালে সে বলে, আপনার দোকান কোথায়? কামরাঙ্গীচরে বলতেই সে বলে, সমস্যা নেই চালাতে পারবেন। আমাদের কাছ থেকে চরের অনেকে মাল নিয়ে যায় এবং খুব ভাল চলে। দাম কোন সমস্যা না, চালাতে পারবেন কিনা ভেবে দেখেন। কোন ধরনের মাল লাগবে। এমন কথার জবাবে মোবাইলসহ চায়না সামগ্রির জিনিসপত্র লাগবে বলতেই সে মালামাল বের করে দেখাতে থাকে। দাম সাধারণ বাজারের থেকে অর্ধেক। কিভাবে অল্প দামে দিচ্ছে জানতে চাইলে সে বলে, জিঞ্জিরায় মাল কিনতে এসেছেন আর এটা বোঝেন না। সে আরও বলে, গুলিস্তানের মার্কেট থেকে দোকানের মালিক শবনুর আক্তার ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জার, নিয়ে আসে। আমরা বাজার থেকে প্যাকেজিং প্যাকেট, ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কার্ড বানাই। তারপর বাসায় বসে কারিগর রেখে ফিটিং করি। তাতে খরচ অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। আর টুকটাক মালামাল আমরা নিজেরাই বানিয়ে ফেলি- এমন কারিগরও আমাদের আছে। লালবাগের শিমুল জানায়, মোবাইল মেলায় কমদামে চায়না সেট কিনেছিলাম ২৪শ’ টাকায়। কেনার সময় অনেক কথা বলা হয়েছিল। এখন মেলা শেষ আমার মোবাইল সেটও শেষ। ওই দোকানে গেলে শুধু বলে, রেখে জান ঠিক করে দিবো। একবার ঠিক করে দিয়েছিল। আবার যা-তাই হয়ে গেলো। ওদের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আমার আরও অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। শুধু-শুধু ২৪শ’ টাকা ধরা খেলাম। শুধু শিমুল না, এভাবে প্রতিনিয়ত ধোঁকা খাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের লাখ-লাখ মানুষ।
গ্লোবাল মেটালের মালিক হাজি মনিরের সঙ্গে তার কারখানায় চায়না মালামাল উৎপাদন বিষয়ে কথা বললে সে বলে, আমি বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে বানাচ্ছি। বিনিয়োগ বোর্ডের চায়না মালামাল বানানোর অনুমতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে কাগজপত্র আছে বলে সে দাবি করে। তার কারখানায় উৎপাদিত ফ্লাক্সের নাম জানতে চাওয়া হলে কোন নামই সে বলতে পারেনি। শুধু বলেছে, যেগুলো বানানো হচ্ছে তার কাগজ আছে।