অবশেষে শুক্রবার আসল । আজ বিচার বসবে । এবার আর কোন ছাড় দেওয়া হবে না । সাদেক পেয়েছে কি ? বার বার চুরি করবে আর কোন বিচার হবে না তা তো হয় না। গ্রীষ্মের দাবদাহে সারাদিন জ্বলে প্রকৃতি মাত্রই ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে । তবুও আশেপাশের দুই চার গ্রাম থেকে বিচার দেখার জন্য মানুষজন ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে । তাদের দেখলে মনে হয় প্রকৃতি এখনো ঠাণ্ডা হয় নি , বরং নতুন উত্তাপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে । এই রকম চুরি এর আগেও হয়েছে , কিন্তু জনমনে এতটা আক্রোশ ছিল না । আশেপাশের গ্রাম থেকে জড়ো হওয়া মানুষজন পাঁচ সাতজন করে বিভিন্ন জায়গায় জটলা হয়ে বসে আছে । তাদের সবার মুখেই আজ চুরির বিচার ছাড়া অন্য কোন আলোচনা নেই । মানুষজন বেশী দেখে স্কুল মাঠে বিচারের আয়োজন করা হয়েছে । ডেকোরেটরের কাছ থেকে প্লাস্টিকের চেয়ারও আনা হয়েছে । সেগুলো গোল করে সাজানো হয়েছে । পুর্বপাশের চেয়ারগুলোর সামনে একটি টেবিল রাখা আছে, তার উপর পান সুপারি আর দুইটা হাতপাখা। চেয়ারের চারপাশ জুড়ে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকদের বসার জন্য । সাদেক স্কুলের বারান্দার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে পান চিবুচ্ছে । মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছে, নামাজ শেষ হলেই বিচার কার্য শুরু হবে। একটু সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই সবাই যার যার আসনে বসে পড়ল। এলাকার গণ্যমান্য ও বয়স্ক ব্যক্তিরা চেয়ারে বসেছে আর সাধারণ দর্শকরা বসেছে খড়ের উপর । সাদেককে বৈঠকের মাঝখানে আনা হল। তার মধ্যে কোন চিন্তার লেশ মাত্র নেই । তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পর সে বিরহের কবিতা পাঠ করার জন্য মঞ্চে উঠবে । গম্ভীর , নিশ্চিন্ত । বিচারকদের মধ্য থেকে একজন উপস্থিত জনতাকে সাদেকের বিরুদ্ধে যার যার অভিযোগ পেশ করতে বললেন । একেকজন যখন অভিযোগ
পেশ করছিল তখন প্রচণ্ড উত্তেজনায় তাদের মুখ থেকে কথার সাথে থুথুর ছিটে বের হয়ে আসছিল, তাদের রক্তিম চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো এখনি অক্ষিকোটর থেকে বের হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়বে। কেউ বলল সাদেক তার টাকা চুরি করেছে , আবার কেউ বলল গরু বাছুর নিয়েছে । এবার সাদেককে জিজ্ঞাসা করা হল এগুলো সত্যি কিনা । সে অকপটে তার সকল অপরাধ স্বীকার করল । বিচারক দের মধ্য থেকে সবার বাম পাশের ব্যক্তি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বলল তিনি এবার এমন বিচার করবেন যেন এই কাজ করার আর কোন সাহস না পায় কেউ কোন দিন। সাদেক বিচারকের মুখের উপর বলে ফেলল সে এইবারের বিচার মানবে না । চারিদিকে হইচই শুরু হয়ে গেল। বসে থাকা লোকজন উঠে দাঁড়াল । চেয়ারের সামনের টেবিলটাতে প্রচণ্ড শব্দে সজোরে কয়েকটি চপেটাঘাত হল । উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে সে বলল বিচার মানবে তবে একটা শর্ত আছে , বিচার করতে হবে এমন একজন ব্যক্তির যিনি জীবনে কোন পাপ করেন নি আর ঐসব ব্যক্তিরা বিচার করতে পারবে না , যারা এমন কোন অপরাধের অপরাধী যেটার বিচার কেউ না জানার কারণে অথবা অন্য কোন কারণে এখনো হয় নি । স্বয়ং নিজে কোন না কোন অপরাধের আসামী হয়ে কেউ তার বিচার করতে পারবে না , সাদেক জোরালো কণ্ঠে একদমে সব বলে ফেলল। চারিদিকে আবার গুঞ্জন শুরু হল । অনেকের চোখ চকচক করছে । সাদেকের এই প্রস্তাবে সমাজের কাছে ভাল মানুষ হওয়ার সুযোগ তাদেরকে পেয়ে বসেছে । বিচারকগন পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন । কেউ মুখ খুলছেন না । দর্শকরাও নীরব । হঠাৎ দর্শকসারী থেকে একজন ভিড় ঠেলে সামনে চলে এসে বলল আমি এই বিচার করব , আপনারা সবাই জানেন আমি কেমন ! আমাকে কেউ কোন দিন খারাপ কিছু করতে দেখেছেন বা শুনেছেন ? তার কথা শেষ হতে না হতেই এক মহিলা বলে উঠলো তার কাছে সে ওয়ারিশের সম্পত্তি পায়। সম্পর্কে তারা ভাইবোন । বোনের দাবি তাকে জোরপূর্বক খারাপ জমিটা দেওয়া হয়েছে । এক কথা দুই কথায় নতুন করে জমি নিয়ে হট্টগোল বেঁধে গেল। মহিলা আজ ই এই ভরা মজলিশে বিচার চায় । জমি না নিয়ে সে শ্বশুরবাড়ি যাবে না । অবস্থা বেগতিক দেখে এবার বিচারকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আলাদা করে একটু দূরে জমি নিয়ে বিচার বসানো হল। সাদেকের বিচারের অগ্রগতি না দেখে এর বাদীরা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে । এমন সময় খড়ের উপর বসে থাকা মাঝবয়সী একজন বলে উঠল সাদেকের বিচার সে করতে পারবে । সবাই লোকটির দিকে তাকিয়ে তার সাথে সম্মতি জানাল। সে আসলেই ভাল মানুষ । তার সম্পর্কে উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে খারাপ বলার মত কেউ নেই । সে সাদেকের বিচারের রায়ও দিয়ে ফেলল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে বাঁধ সাধল এক বোবা ব্যক্তি । সে ইশারা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে আজ থেকে অনেকদিন আগে এই ভালমানুষ বিচারক একটা কুকুরকে বিনা কারণে মেরে পা ভেঙ্গে দিয়েছিল । এই ঘটনা সেই বোবা ব্যক্তি বাদে আর কেউ দেখেনি। চারিদিকে আবার নতুন করে হট্টগোল শুরু হল । আজ যেহেতু বিচার বসেছেই তাই সকল অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত । আবারো বিচারকদের কয়েকজন নতুন এই বিচার নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন । এভাবে রাত ১২টা পর্যন্ত চলতে থাকল একের পর এক বিচার। শেষে সাদেকের বিচার করার জন্য আর কোন বিচারক অবশিষ্ট রইল না । সাদেকের বিচার না হলেও অন্য বিচারের ঠিকই রায় হল, ওইসব বিচারের বিবাদীদের সাদেকের মত অদ্ভুত কিন্তু যৌক্তিক কোন শর্ত ছিল না ।