কল্পনার জন্য
পাহাড়ের সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয় ১৯৯৬ সালে। অপহরণের খবর প্রথম জানতে পাই পত্রিকা মারফত। সব মিলিয়ে জানা গেলো, সেদিন ১২জুন, রাত তখন গভীর। কল্পনা তখন নেত্রী হয়ে উঠেছেন। নিজ বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী কিছু মানুষ। নিয়ে যায় পরিবারের মানুষদের সামনে দিয়েই। তারপর, ১৪ বছর কাটলো। কল্পনাকে ফিরে পায়নি তার পরিবার, ভুলতে পারেনি সহযোদ্ধারা, কল্পনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে পারিনি আমরা। আমাদের দূর্ভাগ্য, আকালের দিনে একজন সংগঠককে হারাতে হয়েছে। আমাদের লজ্জাÑ নিজেদের অপরাধ লুকাতে, দায়িত্ব এড়াতে আমরা আজও নারীদের নিয়ে কেচ্ছা রটিয়ে দিই। রটনাই প্রধান পদ্ধতি হিসেবে সামনে হাজির হয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে পাহাড়ে নিয়োজিত সেনা কর্তৃপ এই অপহরণের দায় এড়িয়ে গেছে। এটুকুতে ান্ত হলেও কথা ছিলো। বরং অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়ে, গল্প ফেঁদে আমাদেরকে ভিন্নপথে ভাবাতে প্রথমে চেষ্টা করেছে, তারপর জোর খাটিয়েছে।
কল্পনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিালো। অধিকার আদায়ে নারীদেও সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিলো। কল্পনা সেনাদেও ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে সরব তে পেরেছিলো। সেনা কর্মকর্তাদেও সাথে তর্ক করবে আর পাহাড়ে শান্তিতে থাকবে তাতো হবার নয়। তাকে অপহরণ করে রাতারাতি গুম করে ফেলা হলো। এরপর? এরপরের কিছু আমরা জানি না। শুধু দেখছি, একটা করে বছর পার হয়ে যাচ্ছে কল্পনা চাকমাকে আমাদের মাঝে ফিরে পাচ্ছি না। আর দেখছি রাষ্ট্র তার নাগরিকের বিষয়ে কখনো কখনো কতোটা নির্বিকার থাকতে পারে।
প্রত্যদর্শী কল্পনার ভাই দাবি, কল্পনাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো যারা তারা সেনা সদস্য। কিন্তু কাকে বিশ্বাস করাবে সে? সে বললে শুনবে পাহাড়িরা আর পাহাড়ের বাঙালিরা কানে শুনবে না সে কথা। আর সমতলের বাঙালিরা কিছুই জানবে না। কারণ সেনারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সবকিছু জানাতে বাধ্য না। কার নিরাপত্তা দিতে পাহাড়ে সেনারা আছেন? দেশের? পাহাড়িরা কি দেশের বাইরের? দেশ থেকে একজন নারী অপহৃত হলেন কিন্তু সরকার নির্বিকার।
অবশেষে কল্পনাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এক মাসের বেশি সময় পর, ২৪ জুলাই ১৯৯৬, সেনা কর্তৃপ অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি হাজির করে। সেখানে বলা হয়, ‘স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কল্পনা চাকমার বাড়ি গিয়ে তার নিত্য ব্যবহার্য কোন সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেরই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তিনি অপহৃত হয়েছে, না স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে শান্তিবাহিনীর অপপ্রয়াসকে সমর্থন দিচ্ছেন? (কল্পনা চাকমার ডায়েরি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত, ২০০১; পৃ-১১৩)। এটুকু বলেও যুক্তিটা ঠিক প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কিনা নিশ্চিত হতে পারেননি। প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, অপহরণের আগে কল্পনা আন্তর্জাতিক ধরিত্রি সম্মেলনে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো সেহেতু নিশ্চয়ই তার আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট ছিলো অতএব তিনি গোপনে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। যাতে পাবর্ত্য ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ফোরামে নতুন করে উপস্থাপন করা যায়। (প্রাগুক্ত)। হতে পারে। কিন্তু তারপর? শান্তিচুক্তি হলো, সে ফিরলো না, বিদেশের কাছে ১৪বছর ধরে পাহাড়কে তুলে ধরার দায়িত্ব শেষ হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্নগুলো সামনে আসবে।
এখনো কি সে শান্তিবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আত্মগোপন করে রয়েছে? একজন বিপ্লবী রণকৌশল হিসেবে স্বেচ্ছায় এমন ত্রে কোথাও কোনদিন তৈরি করেছে কি? যে কিনা পার্বত্য প্রসঙ্গকে আন্তর্জাতিক ফোরামে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের জন্য এধরনের একটা নাটক সাজাতে পারে সে কি বর্তমান পরিস্থিতিতে আরেকটি নাটক সাজিয়ে তার পরিবার-সহযোদ্ধাদের কাছে ফিরতে পারে না? যারা উল্লিখিত যুক্তিগুলো আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন এ প্রশ্নের উত্তর তারাই ভালো দিতে পারবেন।
কি অন্যায় করেছিলো কল্পনা চাকমা? তার অন্যায় সে একটি দেশে ুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একজন নারী হয়ে জন্মেছে। তার অন্যায় বিপ্লবের অধিকার পেতে চেয়েছে। একজন পাহাড়ি নারী হলেও সে সংগঠক হয়ে উঠতে পেরেছে। কল্পনা চাকমা সন্ত্রাসী ছিলেন না বলেই আমরা তার হদিস খুঁজে পাইনি। এটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কল্পনা ুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি বলেই চাপা পড়ে যায়। কল্পনার অপহরণ নিয়ে সরকারকে প্রশ্ন করতে না পারার দায় আমাদের। আমরা যারা এদেশের ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ এ দায় তাদের।
তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজন থেকে নারীরা আবারো সংগঠিত হয়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ির বাঘাইহাটে গড়ে উঠেছে সাজেক নারী সমাজ (এসএনএস)। তুমি ‘উপজাতি’ তুমি গাড়িতে বসে ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যাবে না। তুমি ‘উপজাতি’ তোমার পেটে সন্তান থাকলেও গাড়ি থেকে নেমে ক্যাম্প এলাকা পায়ে হেঁটে পার হয়ে আবার গাড়িতে উঠবে। তুমি ‘উপজাতি’ নারী বনের ভিতর একলা পেলে রা নাই, তুমি নারী দিনের বেলা একা থাকলে আক্রান্ত হবে। আমরা এসবের কিছু মানতে চাই না। আমরা ক্যাম্পের সামনে গাড়ি থেকে নামবো না। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে আবার তারা সংগঠিত হয়।
অপহরণের ১৪ বছর পর উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দাবি করছি। দাবি করছি সুষ্ঠু তদন্তের এবং তা প্রকাশের। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হয়ে এই দায় বয়ে নেয়ার ভার সইতে হবে আমাদেরই, এ ভার বহন কি সহজ?