সন্ধে নাগাদ সারাদিনের ঝিরঝির বৃষ্টি থেমে গেলো। মেঘলা আকাশে বাগেরহাটের আকাশ যেনো একটু বেশি কালো। কারাগারের সামনে শ খানেক মানুষ। সবারই কেউনা কেউ কারাগার থেকে মুক্তি পাবে। নিয়মানুযায়ী সন্ধ্যার আগ দিয়ে মুক্ত করা হয় হাজতি কিংবা কয়েদিদের। সবাই অপেক্ষা করছে। তবে সেদিনের বিষয়টি আলাদা কিছু ছিলো। রোজকার তুলনায় ভিন্ন। ভিড়ের মধ্যে সাংবাদিক আছেন, ঢাকা শহর থেকে কিছু শার্ট-প্যান্ট পরা 'ভদ্রলোক'ও হাজির হয়েছেন। আবার জেলসুপারও ভিড়ে এসে সামিল হয়েছেন। 'সাদা' পোশাকে যে আরো কেউ এই রঙমহলে ঢুকে পড়েনি তা বলবো না। নিশ্চিতভাবে বলছি এই কারনেই যে আমরা জানি তারা কতোটা ভীত, তাদের আত্মবিশ্বাস কতো কম। হঠাত ঘটাং শব্দে খুলে গেলো বিশাল জেলগেটের কিছু অংশ-একজন মানুষ বের হতে পারে এতাটা জায়গা আরকি। একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করে বন্দিরা। বের হয়ে যেনো বুঝতে কস্ট হয় কোনদিকে যাবে। কারণ? কারণ এই গেটে তারা যখন প্রথম ঢুকেছে বা যখন কোর্টে হাজিরা দিতে গেছে প্রতিবারই প্রিজনভ্যানে গিয়েছে। রাস্তাতো তারা চেনে না। যতোই জেলে থাকুক না কেনো। একজন করে বেরিয়ে আসছে আর অপেক্ষমান তাদের আত্মীয় স্বজন ইশারা করে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এক- দুই- তিন- চার- পাচ করে বেরিয়ে আসতে আসতে ৭ নম্বরে বেরিয়ে এলো আনিস রায়হান। সাংবাদিকরা নড়েচড়ে দাড়ালেন, রিক্সার ওপর ভিডিও ক্যামেরা। ততোক্ষনে দুই তিনটা ক্যামেরার ফ্ল্যাশও দেখা গেলো। াপেক্ষমান অন্য বন্দিদের আত্মীয় স্বজন যেনো একটু বেশি অবাক। নিজেদের বন্দিদের কথা ভুলে গিয়ে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো বিষয়টা কি, এ কে? এরপর রামকৃষ্ণ মাঝি, তারপর মনিকা হালদার। তিনজন বেরিয়ে আসতেই ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়া হলো। কালো মেঘের আড়ালে গাদা ফুলের বাসন্তি রঙ যেনো একটু বেশি চড়া।
তিনজন বেরিয়ে এলেন। সবার সাথে কোলাকুলি সারলেন। ছোট্ট করে জানতে চাইলাম: কেমন লাগছে? তিনজনের উত্তর শুনি
আনিস: বুঝতে পারছি না, ঠিক আছে? (আনিস কথায় কথায় ঠিক আছে জিজ্ঞেস করে)
মনিকা: ১৩বছরের মেয়ে সুস্মিতার দিকে তাকায়ে বলে কলিজার টুকরা কাছে পাইসি। জানলা দিয়ে তারা গুনে দিন কেটেছে।
রাম: অনেকদিন রাতের আকাশ দেখি না।
এরা তিনজনই জরুরি অবস্তা ভঙের দায়ে নিজ বাড়ি থেকে আটক হয়েছিলেন মধ্য রাতে। যদিও সে অর্থে জরুরি অবস্থা ভাঙা হয়নি তখনো। তারা নিজ গ্রাম বাগেরহাটের মোড়েরগঞ্জে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলো, তার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলো। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান না করতেই আটক হয়েছিলো গত অক্টোবরে। তারপর সেই একই আলামত (স্ট্যাপলার, মোবাইল চার্জার, ব্যাটারি, টর্চ, স্কেচ পেন জাতীয় জিনিস) দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন 'গণতান্ত্রিক' সরকারের দ্বারা। ১১মাস পর হাইকোর্ট তাদের জামিন দিয়েছে বলেই তারা বেরিয়ে এসেছেন। আর তাই এই সমবেত উপস্থিতি। কারাগেট কে পিছে ফেলে এই তিনজনকে সাথে নিয়ে যখন সকলে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আবারো ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামলো। ভিড়ের মধ্য থেকেই কে যেনো বলে উঠলো: সরকারের কস্টে আকাশ কাঁদে দেখো। এই ছেলেদের একদিনের জন্য হলেও মুক্তি দিতে হলো। এ কি তাদের জন্য লজ্জার? কেউ উত্তর করলো না। মৌনতা কি সবসময় সম্মতির লক্ষণ? হতে পারে কিন্তু।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৫৮