সাল ২০০৯ । আমি তখন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । থাকতাম মেসে, ষোলশহর ২নং গেট-এই এলাকায় ।
সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল । যাকে কবিতার ভাষায় বলে অঝোর স্রাবণ । সারাদিন কারেন্টের লুকোচুরি খেলার সাথে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম নিজের সাথে লুকোচুরি খেলায় । ফলস্বরূপ হাতে ১০ দিন সময় পেয়েও অ্যাসাইনমেন্টটা কমপ্লিট করতে পারিনি । এবং সেটা জমা দেওয়ার আগের দিন মনে হল । এক হাতে কলম আর অন্য হাতে জলন্ত সিগারেট নিয়ে শুরু করলাম অসাধ্য সাধন করার । যখন শেষ হল তখন সময় রাত ৪ টা ছুই ছুই করছে । সাহস করে আর বিছানার দিকে তাকালাম না, জানি যে এখন ঘুমিয়ে পরলে দুপুর ১২ টার আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা । কিন্তু চেয়ারে হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম তা এক মাত্র আল্লাহই জানে । কি কারনে যেন ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি আর মাত্র ২০ মিনিট আছে সকাল ৮.১৫ টার শাটল ট্রেন ধরতে । নিজেরে একটা গালি দিয়ে ছুটলাম ট্রেন ধরতে । এদিকে বন্ধুরা ক্রমাগত ফোন দিতে লাগল, কিরে হালার পো কই তুই,ট্রেনতো ছাইড়া দিলো ? আইতাছি বলে ফোনটা রেখে দিলাম । দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে, তাই কথা পুরোপুরি শেষ না করেই ফোনটা রেখে দিলাম । হাটা বাদ দিয়ে অবশেষে দৌড়াতে শুরু করলাম, কিন্তু তারপরেও ট্রেনটা অল্পের জন্য মিস করে ফেললাম । এই সময়টা আমার কাছে খুব অসহায় লাগে যখন বন্ধুরা ট্রেনে আর আমি ট্রেন মিস করে রেল লাইনের পাশে দাড়িয়ে থাকি ।
নিয়তিকে গালাগাল করে হাটা শুরু করলাম শেষ ভরসা ৩ নং লোকাল বাস ধরার জন্য । রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখি অনেক ভীড় । আমার মত যেসব হতভাইগ্যা পোলাপান ট্রেন মিস করসে সব খাড়ায়া আছে । চিন্তায় পইরা গেলাম, এমনেই চট্রগ্রামের ৩ নং লোকাল বাস ঢাকার লোকাল বাসের চেয়ে সাইজে ছোট, ঠিক মত বইতেও পারি না তারপরে এই ভীড় ঠেইল্লা উঠমু ক্যামনে ? পর পর ২ টা বাস গেল উঠতে পারলাম না । কিছুক্ষন পর দেখি আরেকটা বাস আসতেছে । এই বাসে না উঠতে পারলে অনেক দেরি হয়ে যাবে । তাই নিয়ত করে ফেললাম যেভাবেই হোক এই বাসে আমাকে উঠতেই হবে । বাস আসতেই নিজের বিশাল ভুঁড়িটাকে রাইফেলের বেয়নেট চার্জের মত ঠেলে ঠুলে, অন্য মাইনষের ঠ্যাং মাড়িয়ে অবশেষে আমি বাসে উঠলাম ।
ওওহফ, কি শান্তি, অবশেষে তাহারে পাইলাম এমন একটা ভাব আমার মনে । বাস জ্যামে আটকাচ্ছে আবার খোলা রাস্তা পেয়ে সাই সাই করে ছুটচ্ছে । আর আমি ? কাচ বিহীন খোলা জানালার পাশে বসে আরামসে বাতাস খাচ্ছি । কিছুক্ষন পর কনডাক্টর এসে ভাড়া চাইলে, আমি ভাড়া দেওয়ার জন্য মানিব্যাগ বের করতে গিয়ে হঠাৎ একটা হার্টবিট মিস করে ফেললাম । প্যান্টের পেছনের পকেটে মানিব্যাগটা নেই । আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাসে উঠার আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম তখনও মানিব্যাগটা পেছনের পকেটে ছিল । আমি সামনের পকেটে, ব্যাগের ভেতরে, সিটের নিচে আশে পাশে যতদূর চোখ যায় তন্ন তন্ন হয়ে আমার জীবনের প্রথম মানিব্যাগটা খুজচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছিনা । কনডাক্টরে কোনমতে বললাম- মামা পরে লও । পায়ের ঘাম মাথায় উঠে যায় যায় অবস্থা । আমার ভার্সিটির আইডি কার্ড, ব্যাংকের ডেবিট কার্ড সব গেল । এক সময় চক্ষু লজ্জা ভুলে পাশের অপরিচিত সহযাত্রীকে সব খুলে বললাম । সে আমার অবস্থা শুনে মামাকে ডেকে আমার ভাড়াটা দিয়ে দিলো । কাধ থেকে মনে হল ৫ টনী বোঝাটা নেমে গেল । বাস থেকে নামার পর আমার পাশের ওই সহযাত্রীকে বললাম- ভাই আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিন, আমি ফ্লেক্সি করে টাকাটা আপনার নাম্বারে পাঠিয়ে দিব । উনি হেসে বললেন- লাগবে না, আসলে আমি নিজে খুশী হয়েছি আপনার এই বিপদে আপনাকে সাহায্য করতে পেরে । ভালো থাকবেন । এই বলে উনি হাটা শুরু করলেন ।
ওই ঘটনার পর অনেক দিন কেটে গেছে । অনেক নতুন মুখের ভীড়ে পুরনো অনেক মুখকে আজ আর মনে করতে পারি না । কিন্তু ওই ভাইকে আজো ভুলিনি । তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ওই ভাইয়ের নাম কিংবা চেহারা কোনটাই আজ আমার মনে নেই । শুধু তার ঝাপসা একটা প্রতিচ্ছবি আমার চোখে ভাসে ।
এরপর ওই দিন থেকে আমি যেটাতেই উঠি না কেন সেটা হতে পারে বাস কিংবা লেগুনা মানিব্যাগটা সব সময়টা সামনের পকেটে নিয়েই উঠি, বলাতো যায় না আবার কখন মেরে দেয় ।