ঢাকা থেকে বকুল মামা মাঝেমধ্যেই ফোন করেন। কুশলাদি
জানার পর তিনি বলেন,আমাদের দেশে একবার বেড়াতে এসো।
আমি বারবার একটি কথা বলি,যাব মামা,যদি একবার হুমায়ূন
আহমেদের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন।
মামা বলেন,উরি বাস,তিনি খুব বিখ্যাত মানুষ,আমি বাপু একটা
ছোট চাকরী করি,তার নাগাল পাব না।
আমি হাসি। বলি,বেশ,যেদিন ব্যবস্থা করত পারবেন,বলবেন,
অবশ্যই যাব।আমার পাসপোর্ট রেডি আছে, ভিসা পেতেও অসুবিধা নাই,তাঁর সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে আমার।
একদিন মামা ফোন করলেন,ব্যবস্থা একটা হয়েছে ভাগনে,তুমি আসতে পার।
ছুটলাম ভিসা অফিসে।নিজের অফিস কামাই করে,একে-তাকে ধরে,কোনরকমে একমাসের ভিসা পেলাম।
মামার বাসায় ভালমন্দ খাই আর হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ি।অপেক্ষা করি জোছনা রাত্রির। মামার কাছে খবর আছে,আগামী শুক্লপক্ষতে তিনি নুহাশপল্লীতে থাকবেন।
ভারতীয় সাংবাদিক জেনে, নুহাশপল্লীর কেয়ারটেকার আমাকে তিরিশ মিনিট ছাড়পত্র দেবেন তাঁর সঙ্গে কথা বলার।
অবশেষে এল সেই দিন। নুহাশপল্লীর সিকিউরিটি পার হলাম যেন স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে।
বেলা তখন চারটে দশ।তিনি এলেন।আমার সামনের চেয়ারে বসলেন।
বললেন,আপনি আমাকে দেখতে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন।
আমার তখন হাঁচি হবে না কাশি হবে ভেবে পাচ্ছি না।কোনরকমে
ঢোক গিলে বললাম, জী-না, আমি কলকাতা থেকে একশ কিমি দূরের
একটা গ্রামে থাকি।ছোট্ট একটা কাগজ আছে ‘শুভেচ্ছা’।
---তারমানে আপনি লেখালেখি করেন?
---জী,হ্যাঁ,না,মানে, ওই আর কি,ওই একটু।
আমি যে এত তোতলা তা তাঁর সঙ্গে কথা না বললে বুঝতাম না।
---আমাদের দেশের কাগজে লেখা বেরিয়েছে?
--জী হ্যাঁ,একটা গল্প ।
---বই?
---অনু গল্পের সংকলন ‘তবুও মানুষ’।
--- বেশ এবার বলুন আমার কাছে কেন?
স্মিত হাসলেন তিনি। কলেজ-সুন্দরীরা আমাকে ‘খামখেয়ালী রাজা’
খেতাব দিয়েছিল,তাঁর হাসিতে তা যেন সম্পূর্ণতা পেল।বললাম,
আমার কাগজে আপনার একটা সাক্ষাতকার ছাপব।
---বেশ, যা খুশি লিখে দেবেন,আমি কোন প্রতিবাদ করব না।
ফের মৃদু হাসি। আমার বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে যাওয়া।গলার মধ্যে
হাঁচি-কাশী সব জট পাকিয়ে আছে।কোনরকমে উঠে বললাম,
একটা কপি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব,পড়ে দেখবেন।
---নিন,চা এসেছে,খেয়ে তারপর যাবেন।
‘শুভেচ্ছা’র কয়েকটা পুরোন সংখ্যার কপি তাঁর পায়ের কাছে রেখে
কোনরকমে উঠে দাঁড়ালাম।
দেশে ফিরে ‘শুভেচ্ছা’ তে একটা লেখা লিখলাম,
‘হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে আমার মিল-অমিল’।
তার কয়েকটা চুম্বক অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি,
১) জন্মসুত্রে হুমায়ুন আহমেদ আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছেন,তিনি
বাবার প্রথম সন্তান,আমি দ্বিতীয়।
২)দুজনের বাবাই উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার ছিলেন। কর্মরত অবস্থায়
দুজনেই মারা যান।হুমায়ুনের বাবা শহীদ,আমার বাবার স্ট্রোকে মৃত্যু।
৩) বাবার মৃত্যুর সময়ে আমরা দুজনেই নাবালক ছিলাম।তবে হুমায়ুনের
বাবা,ছেলের লেখক হওয়ার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন,আমার কোন
লেখা বাবার পড়ার সৌভাগ্য হয়নি।
৪)তাঁর বাবা লেখালেখি করতেন,আমার বাবাও। বাবার একটি উপন্যাস
‘অতৃপ্ত আত্মা’ পাঠকমহলে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল। ‘ঘটনা ও রটনা’ নামের
একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন।
৫)লেখার প্রয়োজনে তিনি অধ্যাপনা ছেড়েছেন,জীবনের প্রয়োজনে আমাকে
বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করতে হয়েছে,জীবিকাই আমার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে,
লেখালেখি নয়।
৬)তাঁর বই সকলেই আগ্রহ নিয়ে কিনে পড়ে,আমার বই ফ্রিতে পড়ে
সবাই প্রশংসা করে।
৭)হুমায়ুনের এক বোনের নাম শিখা,আমার একমাত্র বোনের নামও তাই।
৮)হুমায়ুনের ছোট মেয়ের নাম,আমার ছোট মেয়ের নাম একই ‘বিপাশা’।
৯)প্রকাশকরা তাঁর লেখা আগাম দিয়ে কিনে রাখে। আমার লেখা গল্প ,কবিতা
প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেলেও, পুরস্কার আমার হাতে আসে না।
(কিংবদন্তী সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে আমার কখনই দেখা হয়নি,
বাংলাদেশে আমার কোন আত্মীয় নাই,তাই সেই দেশে যাওয়ার সৌভাগ্যও
আমার হয়নি। শুধুমাত্র,কিংবদন্তী সাহিত্যিককে শ্রদ্ধা জানাতে আমার এই লেখার প্রয়াস,অপরবাস্তব- ৭ এর জন্য। )
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৫৩