পুরান ঢাকার বেগমবাজার গলি। তাঁকে দেখে সাইকেল চালানো এক যুবকের সালাম, ‘ওস্তাদ, স্লামালেকুম।’ কিছু দূর এগোতেই আরেক কিশোরের কণ্ঠ, ‘ওস্তাদ, কেমন আছেন?’ হাসিমুখে ‘ওস্তাদ’ সবার সঙ্গে কথা বলছেন। কুশল বিনিময় করছেন ফজলুল ইসলাম। বাবা-মায়ের দেওয়া নামটা অচেনা হয়ে গেছে। এলাকায় ফজলু ওস্তাদ নামেই পরিচিত, ‘হকির ওস্তাদ’।
একসময় পুরান ঢাকার আরমানিটোলাকে বলা হতো হকির সূতিকাগার। সেই আরমানিটোলার হকি কোচ এই ‘ফজলু ওস্তাদ’। চল্লিশোর্ধ ফজলু এখনো ভোরবেলা সবার আগে চলে যান বেগমবাজার পুরোনো জার্সি-কেডসের বাজারে। শিষ্যদের জন্য যে কিছু কিনতে হবে! বাজারে যান লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে, যাতে কেউ চিনতে না পারে। কিন্তু একদিন ঠিকই ধরা পড়ে যান জাতীয় দলের গোলরক্ষক জাহিদের কাছে।
ফজলুর ছাত্র নন জাহিদ। তবে ফজলুর ছাত্রের তালিকাটা বেশ লম্বা। তাঁর হাত ধরেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন রফিকুল ইসলাম (কামাল), মাকসুদ আলম (হাবুল), রাসেল মাহমুদ (জিমি), আবদুস সাজ্জাদেরা (জন)। অপেক্ষায় আছেন আফসার, রুবেল, রাকিবদের মতো একদল কিশোর। খেলোয়াড় খুঁজতে এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হানা দেন ফজলু। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন ছাত্রদের। অভিভাবকদের বোঝান, নেশার জগৎ থেকে বাঁচাতে ছেলেদের খেলতে পাঠানো কতটা জরুরি। শুধু বাড়ি বাড়ি ঘুরেই নয়, রাস্তা থেকে, ফুটপাত থেকে, ডেকে এনেও খেলোয়াড় বানানোর উদাহরণ গড়েছেন ফজলু। স্টেডিয়ামের ফুটপাতে চা বিক্রি করতেন বাচ্চু গাজী। একদিন স্টেডিয়ামে ঢুকে দেখেন, তাঁর এক ছাত্রের হাত থেকে স্টিক কেড়ে নিয়ে বলে হিট করছেন বাচ্চু। হকির প্রতি ছেলেটার আগ্রহ দেখে মুগ্ধ ফজলু। বললেন, ‘খেলবি?’ একসময় বাচ্চুর দায়িত্ব নেন। পরে সেই ছেলেটিই খেলোয়াড় কোটায় সুযোগ পেয়ে যান নৌবাহিনীতে। প্রথমবারের মতো লিগে খেলার সুযোগ পেয়ে বাচ্চু পেলেন ৩০ হাজার টাকা। সেখান থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে গিয়েছিলেন ফজলুর বাড়িতে। কিন্তু বাচ্চুর কামাই করা টাকা তিনি কেন নেবেন?
ফজলুর হকি কোচ হয়ে ওঠার পেছনে একটা গল্প আছে। ১৯৮৪ সালের ঘটনা। প্রথম জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ফজলু। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন ওত পেতে ছিল। হঠাৎ একদিন চোট পেয়ে গেলেন। মালয়েশিয়ায় খেলতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক তার এক মাস আগে চোখের ওপর লাগে স্টিকের আঘাত। ১৩টা সেলাই লেগেছিল। সেই আঘাতের কারণেই পরে আর জাতীয় দলে ঢুকতে পারেননি। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। পরে প্রতিজ্ঞা করেন, হকির একটা একাডেমি গড়ে তুলবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে আরমানিটোলা স্কুল মাঠে শুরু করে দেন হকি শেখানো।
কোচিংটা এখন রক্তের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে গেছে, অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময়ই পান না ফজলু। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কম ঝামেলা হয় না। বড় ভাই রাগারাগি করেন, স্ত্রী করেন অভিমান। কিন্তু ওসব পাত্তাই দেন না। পরিবারের চেয়ে যে বেশি আপন করে নিয়েছেন খুদে খেলোয়াড়দের। এখন অবশ্য মেনে নিয়েছেন পরিবারের লোকজন।
পাকিস্তানি হকি খেলোয়াড় মমতাজ হায়দার তাঁকে বলতেন ‘র্যাম্বো’। বড় চুল রাখতেন, হেয়ার ব্যান্ড পরে স্টিক নিয়ে দৌড়াতেন। এটা দেখেই এমন নাম দিয়েছিলেন মমতাজ। আরেক পাকিস্তানি কামরান আশরাফের সঙ্গে এখনো রয়েছে ভালো বন্ধুত্ব। ঢাকা এলে তাঁর বাড়িতে একবেলা হলেও আতিথ্য নেন কামরান। গুরু-দক্ষিণা হিসেবে তিনি কোনো টাকা-পয়সা নেন না, এটা শুনে কামরান আশরাফ অবাক হয়েছিলেন। কামরানের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘শিষ্যদের ভালোবাসাই অনেক বড় গুরু-দক্ষিণা।’
নিজের হাতে গড়া ছাত্র জিমি, চয়নকে মনে করেন বিশ্বমানের খেলোয়াড়। শুধু সুযোগ আর পরিচর্যার অভাবে এরা হারিয়ে যাচ্ছে—বললেন তিনি। ধূসর হয়ে গেছে হকির সোনালি দিনও। হকি নিয়ে আর মাতামাতি হয় না। এসব দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ফজলু। সেই দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপেই ভোরে উঠে ছুটে যান ছাত্র খুঁজতে। স্বপ্ন দেখেন আবারও একদিন জেগে উঠবে বাংলাদেশের হকি। ফুটবল, ক্রিকেটের মতো হকি নিয়েও এ দেশে তৈরি হবে উন্মাদনা। হকির দৈন্য থাকবে না—জীবদ্দশায় এটা দেখে যেতে চান ‘ওস্তাদ ফজলু’। ফজলুদের প্রত্যাশা আদৌ কি পূরণ হবে?
*********
*********
“আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে” পড়াশোনার সুবাদে “ফজলু ওস্তাদকে” চেনা। উনি স্কুলের মাঠে বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের হকি প্রশিক্ষণ দিতেন। মাঝে মাঝে ছুটির পর খেলা দেখতাম (যদিও আমার হকিতে তেমন কোন আগ্রহ ছিল না)। উনি শুধু বিনা পয়সায়ই নয়, ছাত্রদের হকির সরঞ্জামও কিনে দিতেন। বাচ্চা ছেলেদের জন্যে হকি ষ্টিক কেটে ছোট করতেও কার্পণ্য করতেন না।
*********
*********
গতকাল প্রথম-আলো পত্রিকায় তাকে নিয়ে লিখা প্রতিবেদন পরে আমি এই তীব্র শীতের মধ্যেও শিহরন অনুভব করেছি। ফজলু তোমায় অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১৯