গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে নাকি গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে তা বোঝার মত ক্ষমতা বাঙালি তথা আমাদের এখনো হয়নি। ‘বিজয়’ নাকি ‘হত্যা’ এ বিষয়ে পরে আসি। আপাতত মহাজ্ঞানী এরিস্টটলের “সাইকেল অব পলিটিক্যাল চেঞ্জ” থিওরি সম্পর্কে জ্ঞান নেওয়া যাক।
এরিস্টটল সাহেব একটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে সামগ্রিকভাবে ৬(ছয়)টি পর্যায়ক্রমিক ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এই ভাগগুলো চক্রাকারে ঘূর্ণনশীল। ছয়টা ভাগের নামগুলো দেখে নেওয়া যাকঃ (১) রাজতন্ত্র, (২) স্বৈরতন্ত্র, (৩) অভিজাততন্ত্র, (৪) সামরিক শাসন, (৫) প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থা এবং (৬) গণতন্ত্র।
(৬নং শেষ হলে আবার ১নং থেকে শুরু হবে বলে এই চেঞ্জটাকে “সাইকেল অব পলিটিক্যাল চেঞ্জ” বলা হয়ে থাকে)
বিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ প্রকৃতার্থে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের স্বাদ আস্বাদন করেনি বলাবাহুল্য। বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি। আমরা যা পেয়েছি তা হলো পর্যায়ক্রমে অভিজাততন্ত্র, সামরিক শাসন এবং লোক দেখানো প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থার একটা প্যাকেট যা কিনা ‘গণতন্ত্র’ দিয়ে মোড়ানো!!! অথচ গণতন্ত্র নিজেই একটা আলাদা অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
একটু যদি গভীরে যাই... (ক্রম ৩-৫)
ক্রম ৩ঃ অভিজাততন্ত্র বলতে বোঝায় সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদাধারী (যিনি মূলত বংশগত খেতাবে ভূষিত) কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা । বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে “শেখ সাহেব”; যিনি বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবে সমাদৃত। পঁচাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্তরালে ‘বাকশাল' প্রতিষ্ঠা করে অভিজাততন্ত্র অনুশীলনের চেষ্টা করেছিলেন। যার বীজ বপন হয়েছিল অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই।
ক্রম ৪ঃ সামরিক শাসনের ধারণা এসেছে ইংরেজি ‘অলিগার্কি’ শব্দ থেকে, যাকে বলা হয় ‘দ্য রুল অব দ্য রিচ’। স্বাধীন বাংলাদেশে এই ক্রম ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল; দুই ভাগে। (ক) জেনারেল জিয়ার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১) এবং (খ) জেনারেল এরশাদের শাসনামল (১৯৮২-১৯৯০)।
প্রথম ভাগে জেনারেল জিয়া গণতন্ত্রের নতুন চমক দেখালেন। তিনি ‘সামরিক বিধি’ জারী করার সাথে সাথে অন্যান্য সামরিক শাসকদের মত তিনিও বেসামরিকীকরণ এবং গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় তার ব্যক্তিগত শাসনকে কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘গণতন্ত্রায়ন’ শব্দের যথেচ্ছা ব্যবহার থাকলেও তা যথেচ্ছাই উপেক্ষিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় ভাগে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এরশাদ তাঁর সরকারের বৈধতা অর্জনের উদ্দেশ্যে জনগণকে ‘গণভোট’ এর মাধ্যমে ‘গণতন্ত্র-গণতন্ত্র’ খেলা দেখিয়েছিল। যাকে সামরিক শাসন না বলে, কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে আমরা ‘স্বৈরতন্ত্র তথা স্বৈর শাসন’ বলে অভিহিত করি। সামরিক শাসন বললে পাছে আবার কারো জাত যায়, এইজন্য!!! আমরা পারিও বটে।
ক্রম ৫ঃ প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থা যা “দ্য রুল অব দ্য পিপল” নামে অধিক পরিচিত। এই শাসন ব্যবস্থা হলো সিভিল সরকার বা সংবিধানের একটি ফর্ম বা প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর বাংলাদেশ আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে(!) প্রবেশ করল। জনগণ তো মহাখুশি! এবার তা হলে প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের আসল রস আস্বাদন করা যাবে! কিন্ত ‘গণতন্ত্র’ নামক সেই মূলা আমাদের সামনে ঝুলেই থাকল!!! ছুঁয়ে দেখা হলো না আর কখনোই।
চলছে অদ্যাবধি...
আবার কেউ যদি ১৯৮৭ সালে শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগানকে আসলেই গণতন্ত্রের মুক্তি হিসেবে দেখে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে 'প্রহসন নির্বাচন' আখ্যা দিয়ে গণতন্ত্রের হত্যা নিশ্চিত করেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তবে মনে রাখা বাঞ্চনীয়- গণতন্ত্রের হত্যা নিশ্চিত করলে কিন্তু এত সহজে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। রাজতন্ত্র যেহেতু বিলুপ্তপ্রায় সেহেতু নিয়মানুযায়ী আপনি যদি এখনকার সময়কালকে স্বৈরশাসন বলে থাকেন, এরপর কিন্তু আসবে অভিজাততন্ত্র। যা মোটেই কল্যাণকর কিছু নয়।
তবে 'আমাদের গণতন্ত্রের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত' এহেন হতাশায় যারা নিমজ্জিত তাদের জন্য আশার আলো দেখিয়ে গিয়েছেন এরিস্টটল সাহেব। উনার “সাইকেল অব পলিটিক্যাল চেঞ্জ” অনুযায়ী আমাদের দেশে অদ্যাবধি যা চলেছে তা গণতন্ত্র নয়। ‘গণতন্ত্র’-কে বলা হয় “দ্য মব রুল”; অর্থাৎ “জনতার শাসন”। এরিস্টটলের মতানুসারে এখনো যার শুরুটাই হয়নি এদেশে!
সুতরাং, “গণতন্ত্রের বিজয়” বলেন অথবা “গণতন্ত্র হত্যা” বলেন…সবই গুজব, সব মিডিয়ার সৃষ্টি। বিভ্রান্ত হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন স্বয়ং এরিস্টটল সাহেব!
আজ সেই ৫ই জানুয়ারি! সবাইকে 'পাখি দিবস'-এর শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৭:১৩