- প্রত্যর্থী।
- প্রেজেন্ট মিস।
অ্যাটেনডেন্স খাতা থেকে চোখ সরাসরি এইমাত্র ‘প্রেজেন্ট মিস’ বলা শ্যাম বর্ণের মেয়েটিতে আটকে গেল মিলির। দুই দিকে বেণী করা চুল আর কাজল দেওয়া বড় বড় মায়াভরা চোখ- ধীর, স্থির, শান্ত। ঠিক যেন বিখ্যাত কোন চিত্রশিল্পীর এই মাত্র আঁকা পেন্সিল স্কেচ পরম মমতায় বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। এক কথায় রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ টাইপ।
কিন্তু মিলি আটকে গেছে অন্যখানে। একটা নাম! হ্যা শুধুমাত্র একটা নাম যে এভাবে টেনে হিঁচড়ে বছর দশেক পিছিয়ে স্মৃতির অতল গহ্বরে নিয়ে যেতে পারে মিলি তা কল্পনাতেও আনে নি। ক্লাসের প্রথম দিনের রোল কলেই বেশ একটা ধাক্কা খেয়েও সামলে নিয়ে শুরু করল...
- আজ প্রথম দিন। তাই আর অ্যাটেনডেন্স নিব না। আজ ইন্ট্রোডিউসিং ক্লাস। ওকে।
- মিস, আমি কি বসব?
- হুম। বাই দ্য ওয়ে, তোমার নামটা তো ভারী সুন্দর। কে রেখেছে?
- বাবা।
- তোমার বাবার পছন্দ তো অ-নে-ক সুন্দর। কি নাম তোমার বাবার?
- শুভ মজুমদার।
- মামণি, তোমার ব্যাগে একটা ক্যাটবেরি দেখছি। কে দিয়েছে?
- আমার বাংলা মিস।
- তোমাকে কত বার না বলেছি বাইরের কারো দেওয়া কোন জিনিস নিবে না। তারপরেও নিয়েছ?
- উনি তো বাইরের কেউ না। জানো বাবা, বাংলা মিস আমাকে অনেক আদর করেন। প্রায়ই আমাকে ক্যাটবেরি কিনে দেন। এক্সট্রা কেয়ার নেন।
- আচ্ছা তাই নাকি? তো এত জন বাদ দিয়ে তোমাকেই কেন এক্সট্রা কেয়ার নেন তোমার মিস?
- বাহ রে, আমি না ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল! হুহ। আমাকে নিবে না তো কাকে নিবে!
- তাই বুঝি। কি নাম তোমার বাংলা মিসের।
- মিলি।
- পুরো নাম কি?
- জানি না। ভুলে গেছি বাবা।
রোল কলের দিন মিলির খাওয়া ধাক্কা যদি ক্রিয়া বল হয়, তাহলে শুভর এখন খাওয়া ধাক্কাটা হবে প্রতিক্রিয়া বল। ফিজিক্স বলে, এভরি অ্যাকশন হ্যাজ অ্যান ইক্যুয়াল এন্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন। শুভ অস্থির হয়ে মেয়ের ব্যাগ হাতড়াতে থাকে।
- কি খোঁজ বাবা?
- তোমার বাংলা বইটা কোথায়?
- এই তো টেবিলে।
- তোমাকে না কতবার বলেছি, আমি একটা মেয়ে। আর মেয়েদের ব্যাগে না বলে হাত দিতে হয় না। তুমি না উফফ!
- আচ্ছা মামণি, আর দিব না।
শুভ মেয়ের বাংলা বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। কলেজ লাইফে শুভর প্রতিটা বইয়ের ১৬ নং পেইজের ১৬ সংখ্যাটা লাল কলম দিয়ে ভরাট করা থাকত। এটা জানত শুধু মিলি; ওই একজনই। ১৬ই মে মিলির বার্থডে। পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় যেটা দেখতে চাচ্ছিল না ঠিক সেটাই পরম আবেগে অপেক্ষা করছে আজ শুভর জন্য। 'প্রত্যর্থী' নামটাও তো মিলিরই পছন্দ ছিল! আহারে জীবন...
- জানো বাবা, সামনের ১৬ তারিখে আমার স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং।
- কোন মাসের?
- এই তো মে মাসে।
- কে ফিক্সড করেছে।
- মিলি মিস। উনি তো অ্যাসিস্টেন্ট হেডও। উনি সবার বাবাকে বাধ্যতামূলকভাবে যেতে বলেছেন। রিপোর্ট কার্ড দিবে না কি!
- হুম, তুমি বলো নাই যে তোমার বাবা অনেক বিজি।
- বলেছি তো। কিন্তু রুলস ইজ রুলস। তোমাকেই যেতে হবে বলেছে। মা গেলে হবে না।
আজ ১৬ই মে। মিলি নীল শাড়ি পরেছে, শুভর পছন্দ ছিল। সচরাচর টিপ না দিলেও ছোট্ট একটা নীল টিপ আর চোখের নিচে কাজল লেপ্টেছে। হাত ভর্তি নীল রঙা ডজন খানেক চুড়ি। ‘গেট আপ’টা অ্যাসিস্টেন্ট হেড হিশেবে ঠিকঠাক না গেলেও- হু কেয়ারস!
ফুল ফোঁটা আর না ফোঁটার উপর যদি বসন্তের আসা-যাওয়া নির্ভর না করে থাকে তাহলে প্যারেন্টস মিটিং এর সাথেও গেট আপ ম্যাটার করে না। করলে করুক গে যাক!
মিলি আজ শুধু দেখতে চায় বছর দশেক আগে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যর্থ এক প্রেমিক আর বর্তমানের সফল এক বাবাকে...কি অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:০৯