ইদানীং এটা প্রায় অসম্ভব যে আমরা টিভি খুলেছি অথবা পত্রিকা পড়ছি কিন্তু ধর্ষণের নিউজ পাইনি। মিডিয়াগুলোকে ধন্যবাদ আমাদেরকে ২৪/৭ এসব নিউজ প্রোভাইড করার জন্য। কেননা এই সহিংস নিউজগুলো যে শুধুমাত্র আমাদেরকে সংবাদ জানান দিচ্ছে তা নয়; আমাদের মাথাও খাচ্ছে বৈকি! একটা উদাহরণ দিই-
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার সময় মুনিরকা থেকে ধরকাগামী বাসে ভারতের রাজধানী দিল্লির অদূরে হরিয়ানার রোহটাক জেলায় ২৩ বছর বয়সী এক যুবতীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনা ঘটেছিল ভারতে, ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল বাংলাদেশী মিডিয়াতেও।
ফলাফলস্বরূপ, ঠিক এর পরপরই এক মাসের মাথায় ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গার্মেন্টসকর্মী। সেইম স্টাইল মেইন্টেইন করা হয়েছিল। এর আগে বাসে ধর্ষণ করা যায় এমন কনসেপ্টই আসেনি ধর্ষকদের মাথায়! কি বলবেন? মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্স নাই!
বিজ্ঞানী শানা গাদারিয়ান ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছিলেন, "মিডিয়া প্রতিযোগিতা মানেই অধিক শ্রোতা লাভের আশায় সাংবাদিক ও সম্পাদক কর্তৃক আবেগঘন দৃশ্য এবং লাইনগুলি সংকুচিত ও রসালো করে পাবলিশড করা। এক্ষেত্রে ধর্ষণের খবর গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি স্বতন্ত্র নাটকীয়!"
এধরণের পক্ষপাতদুষ্ট নিউজগুলো আমাদের ধর্ষণের বিষয়গুলির উপর আরো মনোযোগ দিতে সহায়তা করে অথবা আংশিকভাবে নেগেটিভলি বায়াসড করে ফেলে! কিছু কিছু মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মিডিয়াগুলির নেতিবাচক এবং হিংসাত্মক নিউজ এক্সপোজারে গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রভাব ফেলে।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গ্রাহাম ডেভি প্রচার মাধ্যমের সহিংসতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবগুলি নিয়ে কাজ করে থাকেন। তিনি 'দ্য হফিংটন পোস্ট' বলেছেন, "সহিংস মিডিয়া এক্সপোজার চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং এমনকি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার (PTSD) বাড়াতে বিশেষভাবে অবদান রাখে। নেতিবাচক খবর আপনার মেজাজকে প্রভাবিত করে এবং আপনি আপনার চারপাশের জগৎকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং কীভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করবেন তার উপরও প্রভাব ফেলে"।
উদাহরণস্বরূপ, যদি নেতিবাচক ঘটনাগুলো আপনাকে আরও উদ্বিগ্ন বা দুঃখজনক করে তোলে, তাহলে আপনি নেতিবাচক বা হুমকির ঘটনাগুলির মধ্যে আরো বেশি মনোনিবেশ করা শুরু করবেন এবং আপনি অস্পষ্ট বা নিরপেক্ষ ঘটনাগুলিও নেতিবাচক হিসাবে দেখা শুরু করবেন।
মজার ব্যাপার হলো, একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব সাংবাদিকেরা আনসেন্সরড ইমেজ পুনর্বিবেচনা, পরিহার এবং এ রিলেটেড গ্রাফিক ডিজাইনের সাথে সম্পৃক্ত তারা একসময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং তারা মদ্যপান, বিষণ্নতা এবং সোমাটাইজেশনে PTSD সূচকের উপর সর্বোচ্চ স্কোর করেছেন।
আমাদের দেশে আইসিটি আইন এত শক্ত! ৫৭ ধারা এত সচল! অথচ দেখলাম না কুরুচিপূর্ণ এবং এইসব রসালো গল্পের ফাঁদ পাতা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করল। কারো নিবন্ধন বাতিল হলো। আমি বলছি না ধর্ষণের সংবাদ পত্রিকাতে না আসুক। আমি বলছি সংযতভাবে আসুক! অপরাধকে অপরাধ হিশেবে তুলে ধরা হোক। শাস্তি সম্পর্কে অবগত করা হোক।
ধর্ষণের সংবাদ যত সমারহে প্রচার করা হয়; ধর্ষকদের শাস্তির সংবাদ অত মহাসমারহে প্রচার করা হয় না। দিল্লী কিংবা মানিকগঞ্জের ধর্ষণের ঘটনা আমরা সবাই জানি। বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, কয়জন জানি বিচার কি হয়েছিল? আমাদের দূর্ভাগ্য এখানেই। কেননা আমরা পাঠকেরা শাস্তির নিউজ পড়তে আগ্রহী না। আমরা ধর্ষণের স্টাইল জানতে বেশি আগ্রহী। গোড়াতেই যখন গলদ তখন এর নির্মূল কোথায়?
আমরা যেভাবে চেষ্টা করছি এভাবে হবে না। আমাদেরকে অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। সমূলে উৎপাটনের চিন্তা করতে হবে। মিডিয়া থেকে মন্ত্রণালয়, আইন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ, জনগণ থেকে প্রধানমন্ত্রী সবাইকেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে "জিরো টলারেন্স" প্রদর্শন করতে হবে। অন্যথায় "এক ব্যক্তি-এক প্রতিষ্ঠান" কেন্দ্রিক আন্দোলন "অযথা"!
আমি তো প্রতিকার দেখি না। এর একমাত্র কারণ হলো- "সমন্বয়হীনতা"! সুতরাং শিক্ষাদান শুরু করুন পরিবার থেকেই!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৩:১৬