একটি অসম্পূর্ণ গল্প
পার্ট-০১
“প্রায় তিন ঘন্টা ধরে বসে আছি এই রুমটায়।বিরক্তির সর্বশেষ সীমানায় গিয়ে পৌছেছি।সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছে তো রেখেছেই,উনার আসার নাম নাই।একভাবে বসে থাকতে থাকতে আমি statue of Bangladesh হয়ে পড়েছি।কারন যেখানে বসে আছি তা একটা ওয়েটিং রুম।আর কোন ওয়েটিং রুম যে এত সুন্দর করে সাজানো থাকতে পারে তা আমার ধারনার বাইরে ছিল।ওয়েটিং রুমটা হল ১৪ তালায়।বিশাল বড় রুম,যার ৩ পাশেই স্বচ্ছ কাচের দেয়াল।৩ দেয়ালের পাশে বড় বড় বিভিন্ন রকমের ফুলের টব।আর কি সুন্দর ভাবেই না ফুলগুলো ফুটে আছে।দেয়ালের এক পাশে ঝুলছে বিশাল এক পেইন্টিং,তার পাশে ছোট ছোট কিছু পেইন্টিং,এদিকে আমি যে সোফায় বসে আছি তা রুমটার ঠিক মাঝখানে,তার রঙ সাদা,আসলে ঘরটার সব কিছুর রঙ ই সাদা।নিচে মেঝেতে যে টাইলস বসানো তার রঙ ও সাদা,রুমের এক কোণে একটা ছোট্ট ফোয়ারাও আছে।যাই হক রুমে আমরা মাত্র ৪ টা প্রাণী।যার মাঝে আছে একজন বৃদ্ধ লোক,যে কিছুক্ষণ পর পরই বলছে ৩টা কি বাজছে?যদিও তার হাতে সুন্দর একখানা পুরোনো আমলের Casio ঘড়ি দেখা যাচ্ছে,তবুও সে বারবার বলাতে ভালই হচ্ছে,কারন একমাত্র তার এই কথাতেই রুমটার নিরবতা ভাঙছে,এছাড়া রুমে এসির ঠান্ডা শো শো আওয়াজ।এদিকে আর যে দুজন আছে তার মাঝে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা,তার মনে হয় সাদার প্রতি আলাদা একটা ঝোক আছে,কারন তিনি যে চাদরটা পড়েছেন তার রঙ সাদা,শাড়ির রঙ সাদা,চুলের রঙটাও সাদা এমনকি যে চশমাটা পড়েছেন তার ফ্রেমটাও সাদা,আমার মনে হয় উনি নিজেও খুব সাধাসিধে টাইপের মানুষ,যাই হোক এবার তৃতীয় যে মানুষটা বসে আছে সে শুধু মানুষ নয় এ রীতিমতো যুবতী মেয়ে মানুষ।অসাধারণ রুপবতী একটা মেয়ে,স্রষ্টা যেন নিজ হাতে তৈরী করেছেন,এমন রুপবতী মেয়ে এখন খুব কমই দেখা যায়,কারন সব মেয়েই এখন আধুনিক বিজ্ঞানের(!) কারনে সুন্দরী।মেয়েটার বয়স বড়োজোড় ২২-২৩ হবে।মুখের ভিতর একধরনের মায়া আছে,কিন্ত চেয়ে আছে ভাবলেশহীন চোখে,ওর চোখে এক ধরণের শূন্যতা আছে,বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না,সেটাও কোন সমস্যা না,সমস্যা হল,মেয়েটা তার ঐ ভাবলেশহীন চোখ দিয়ে বারবার আমাকেই দেখছে।কেন দেখছে সেটা এখনও বুঝতে পারছি না,আমার চুল ঠিক আছে,মুখের গাম্ভীর্য ঠিক আছে,এমনকি প্যান্টের জীপারটাও লাগানো আছে,তবে সমস্যাটা কি,সেটাই ধরতে পারছি না,কারণ মেয়েদের তাকিয়ে থাকার মত আমার চেহারা না,তারপরও এত সুন্দর একটা মেয়ে,আর এর জন্যই অস্বস্তি লাগছে,ও হ্যা বলতেই ভুলে গেছি মেয়েটাও কিন্ত একটা সাদা শাড়ি পড়ে আছে,আর মেয়েরা কপালে টিপ নিলে সেটা সাধারণত ঠিকভাবে পড়ে না,কিন্ত এরটা একবারে ঠিক জায়গাতে বসিয়েছে,মনে হচ্ছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি
-এই যে,Excuse me,আপু একটা প্রশ্ন করতে পারি?
-জ্বী,অবশ্যই বলুন
-আপনার কপালের টিপটা কি আপনি কাটা কম্পাস দিয়ে মাঁপজোখ করে বসিয়েছেন?
-এই রে,আপনি কি করে জানলেন?
-(জ্ঞানী ভাব নিয়ে)হুম,আমি অনেক কিছুই জানি,যাই হোক আরেকটা প্রশ্ন করি?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই,আপনি একটা কেন হাজারটা প্রশ্ন করুন না
-আসলে আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো,তখন থেকে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন কেন?
এর মধ্যে সত্যি সত্যি এবার মেয়েটাই প্রশ্ন করে বসল!
-এই যে ভাইয়া আপনি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?কিছু বলবেন?
-জ্বী,না,মানে,আসলে এমনি!
-জ্বী,না,আবার কি?কি সমস্যা বলুন?
-না,আসলে হয়েছে কি আপনার শাড়ীর আচলটা নিচে পরে গেছে তো তাই
-ও আচ্ছা,তাতে আপনার কোন অসুবিধা আছে?
-না,না কোন অসুবিধা নেই
-তাহলে আমার দিকে না তাকিয়ে চুপ করে বসুন
--জ্বী আচ্ছা
কি মেয়ে রে বাবা,এতক্ষন নিজে তাকাচ্ছিল তাতে দোষ নেই,আর আমি মাত্র একবার তাকালাম তাতেই এত কথা,এর জন্যই রবি ঠাকুর বলেছিলেন…………
রবি ঠাকুর কি বলেছেন তা চিন্তা করার আগেই আমাকে যে ভদ্রলোক এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছেন তার আগমন…………
-ওহ মাসুদ,সরি,আসলে একটা জরুরী কাজ পড়ে গেল তো তাই এতক্ষন বসিয়ে রাখতে হল আরকি
-না,না,ঠিক আছে দুলাভাই
-ও রিমা তুমিও দেখছি চলে এসেছ।তা কতক্ষন?
-এইত ভাইয়া এক ঘন্টার মত হল
-ওহ আসলে I am extreamly sorry,অফিসে এত কাজ
-It’s okay ভাইয়া
-যাই হোক পরিচয় করিয়ে দিই,এ হচ্ছে আমার গুণোধর শ্যালক(!) মাসুদ,আর মাসুদ এ হল রিমা,এই প্রজেক্টে ওকে আমরা নতুন নিয়োগ দিয়েছি
আমরা দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম
-হ্যা,যা বলছিলাম,তোমরা দুজনে তাহলে একসাথে সিলেট যাচ্ছো ফটোশ্যুট করবার জন্য,তোমাদের ফটো দিয়েই তৈরী হবে আমাদের কোম্পানীর ক্যালেন্ডার।তোমরা দুজনেই কেবল পাশ করে বেরিয়েছো,আশা করি তোমাদের কাজটা ভালো হবে,আর এটা ভালোভাবে করতে পারলে তোমাদের ক্যারিয়ারের জন্যও ভাল,যাই হোক তোমরা যত তাড়াতাড়ি রওনা করবে ততই ভাল,সব চেয়ে ভালো হয় যদি আগামিকাল সকালে যেতে পার।তোমাদের সাথে গাইড হিসেবে একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি,ওর নাম ফরিদ,ওর বাড়িও সিলেট।ওই তোমাদের সব দেখিয়ে দেবে,আর হ্যা,Best of luck
এইটুকু বলেই উনি চলে গেলেন।
আমি আর রিমা দুজনেই কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।আমি কোন কথা না বলেই খুব দ্রুত লিফটের কাছে গেলাম,সে ও আমার পিছু পিছু আসলো।একসাথেই বের হলাম।আমার উচিত তার সঙ্গে কিছুক্ষন কথা বলা,কিন্ত একটু আগের ঝাড়ির কথা মনে করে আমি আর সাহস করলাম না,এর মধ্যে দেখি আমার কাঙ্খিত ৬ নাম্বার বাস চলে আসছে,আমি কিছু না বলেই লাফিয়ে উঠে পড়লাম বাসে।
পার্ট-০২
উফ!অসহ্য,সেই তখন থেকে ফোনটা বাজতেই আছে।এত সকালে কে ফোন দেয়?তাও আবার Unknown number,মেজাজ খারাপ করেই ফোনটা রিসিভ করলাম,কিন্ত ওপাশ থেকে খুব মিষ্টি করে কেউ একজন বলল
-হ্যালো,কে মাসুদ সাহেব বলছেন?
-জ্বী,মাসুদ সাহেবই বলছি
-আসলে আমি রিমা
আজ আমাদের একসঙ্গে সিলেট যাবার কথা
-ওহ মাই গড,আমি তো ভুলেই গেছি,আপনি এখন কোথায়?
-আমি বাসা থেকে বেরুচ্ছি,আপনি বাস স্ট্যান্ডে আসেন
-জ্বী,আচ্ছা
মাথায় এক গাদা প্রশ্ন নিয়ে কোনমতে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম,শুক্রবার রাস্তাঘাট ফাকাই আছে,কিন্ত তারপরও মাথায় ঘুরছে শালা,এতদিন পরে কত কষ্ট করে চাকরিটা পেলাম,আর কি করে ভুলে গেলাম,আর মেয়েটাই বা আমার নাম্বার কোথা থেকে পেল?ধুর আর ভাল লাগছে না,টেনশনে টেনশনে জর্জরিত হয়ে বাসে উঠলাম,কিন্ত রাস্তা যেন আর শেষই হয় না”
এই পর্যন্ত পড়ে অতশী থামল।কারন অতশীর মা তার কান ঝালাপালা করে ফেলছে
-অতশী,এই অতশী তোকে কতবার বললাম যে দরজাটা খোল,কথা শুনতে পাচ্ছিস না?
-যাই আম্মু
অতশী দরজা খুলে তো পুরাই থ!তার বাবা সম্পুর্ণ কাকভেজা হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে,আর তার বাবার সাথে যে ছেলেটা আসছে তার ও একই অবস্হা,কিন্ত মজার বিষয় তার মাথায় ১ ঝুড়ি আম,দুজনেই দাত বের করে হাসছে
-কিরে,মা,ঘরে ঢুকতে দিবি,নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো?
-কিন্ত,তোমার এরকম অবস্হা হল কি করে?
-সব বলছি আগে ঘরে তো ঢুকতে দে
এরমধ্যে অতশীর মা দৌড়ে আসল
-ওহ,মাই গড,কি অবস্হা তোমার?এক্ষুণি যাও বাথ্রুমে গিয়ে শাওয়ার নাও,আর এই ছেলেটা কে?
-ওর নাম হচ্ছে মফিজ,এই আমগুলো আনার জন্যই ওকে সাথে নিয়ে আসছি
-তাই বলে এত্ত আম!!!
-সস্তায় পেলাম তাই নিয়ে আসছি,যাই হোক আমি বাথরুমে গেলাম,তুমি মফিজ ছেলেটাকে টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় কর,আর আমগুলো বারান্দায় নিয়ে রাখো
অতশীর মা খুব বিরক্তমুখেই কাজ গুলো করলেন।
পার্ট-০৩
-কিরে,আমার অতশী মামণি কি করে?
-আম খাই বাবা
-আম কেমন রে মা?
-খুবই ভাল বাবা,কিন্ত দু একটাতে পোকা আছে
-পোকা তো থাকবেই,পোকা ছাড়া আম খেয়া মজা পাওয়া যায় না।হাঃহাঃহাঃ
কিছুক্ষণ পর অতশী আবার সেই ডায়েরী নিয়ে বসল,এর মধ্যই হঠাৎ অতশীর বাবা ওর রুমে চলে আসল
-কিরে,মা কি পড়ছিস?
-কিছু না বাবা
-না না কিছু তো একটা পড়ছিসই,বল কি পড়ছিস?
-এইটা বাবা
-ডায়েরী!দেখি এই ডায়েরী তুই কোথা থেকে পেলি?
-স্টোর রুমে পেয়েছি,বাবা
-সব পড়েছিস?
-না,বাবা এইটুকু পড়েছি,এরপর থেকে পাতা গুলো আর পড়া যাচ্ছে না,কিন্ত এটা কার ডায়রী বাবা?
অতশীর বাবা চুপচাপ ডায়েরির পাতাগুলো উলটে যাচ্ছেন,তার চোখ টলমল।আজ হঠাৎ অনেকদিন পর পুরোনো অনেক স্মৃতি তার মেয়ে তার চোখের সামনে টেনে তুলে ধরেছে
-বাবা,ও বাবা বলনা এটা কার ডায়েরী?
অতশীর বাবা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন,অতশীর বাবা এম্নিতে খুব হাসিখুশি মানুষ,এত সহজে উনি কাদতেই পারেন না,কিন্ত তারপরেও আজ় ঊণী কাদছেন,অতশীর বাবার চোখের জল দেখে অতশীরও খুব কান্না পাচ্ছে,সে এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না,সে কি দৌড়ে তার মায়ের কাছে চলে যাবে নাকি এখানেই বসে থাকবে কিছুই বুঝতে পারছে না,এদিকে অতশীর বাবার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে সেই পুরোনো স্মৃতিগুলো………………
‘তিনি দৌড়ে যাচ্ছেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে,ইশ চারিদিকে কত্ত মানুষ,কিন্ত রিমাকেতো কোথাও দেখা যাচ্ছে না,আসার পথেও ফোনে কয়েকবার কথা হল,কিন্ত রিমা কোথায়?এদিকে রাস্তার ওপাশে একটা জটলা দেখা যাচ্ছে,মানুষের খেয়ে কোন কাজ নেই,শুধু জটলা পাকাতে পারলে বাঁচে,শুনেছি রিমার সাথেও নাকি ওর ছোট বোনটাও আসছে ওকে বাসে উঠিয়ে দেবে বলে,ওর বোনটার নাম যেন কি?ও হ্যা সীমা,ধুর রিমার ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।রিসিভ করার কোন নাম নেই
-আচ্ছা,ভাই ওদিকে এত জটলা কেনো?
-যাইয়া দেহেন
মাসুদ দেখতে গেল,সে যেয়ে যা দেখল তা এখনও তার মনটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে তোলে,তার পুরো পৃথিবীটা যেন দুলে উঠেছে”
-বাবা,ও বাবা কাঁদছ কেন?
-ও কিছুনা মা,তোর মা কোথায়?
সীমা,সীমা এদিকে একবার আসো তো
-হ্যা,কি হয়েছে,বল?
-শোন কাল থেকে তো অতশীর স্কুল ছুটি,এই ছুটিতে না হয় সিলেট গিয়ে বেড়িয়ে আসলাম…………না কাল না আজ আমরা আজই আমাদের মামণিকে নিয়ে সিলেট বেড়াতে যাব,আর হ্যা,যাবার সময় রিমার ক্যামেরাটা নিয়ে নিয়ো,ওই ক্যামেরাটায় আসলেই খুব ভালো ছবি ওঠে।