আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, আমি সাধারনের চেয়ে সবসময় আলাদা ছিলাম। নিজেকে অন্য একরকম মানুষ হিসাবে কল্পনা করতাম। কি রকম মানুষ সেটা আমি নিজেও জানতামনা। তবে সব মানুষদের ভিড়ে নিজেকে আমার সবসময় আলাদা বলে মনে হতো।
কল্পনা করতাম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি রাজহাঁসদের সঙ্গে। কখনও বা স্বপ্নের মধ্যে দেখতাম অন্য এক জগতে চলে গেছি যেখানে অপুর্ব সব সুন্দরীদের বাস। তাদের ভালবাসা আর অন্য দশজন নারীর মতো নয়। তারা যাকে ভালোবাসে তাকে ছেড়ে যায়না। এই স্বপ্নটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। আমি আশেপাশের কোন নারীর দিকে ফিরেও তাকাতামনা। যতোই সুন্দরী হোক সে, আমার সবসময় মনে হতো সে আর দশজন নারীর মতোই।
কিন্তু স্বপ্নে দেখা নারীদের সন্ধান কখনও পেতামনা। কোথায় পাবো তাদের? আমার তো চেনা নেই কোথায় থাকে তারা। এমনি এক সময় আমার বন্ধু সীমান্তর সঙ্গে হঠাৎ বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেঙ্ েগেলাম ওর একটা ফেভারিট পারফিউম এর সন্ধানে। আর এই যাওয়াটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো। সীমান্ত ঘুরে ঘুরে এ দোকান থেকে সে দোকান পারফিউম দেখে বেড়াচ্ছে আর আমিও তার পেছন পেছন হ্যাবলার মতো হাঁটছি। হঠাৎ আমি থমকে দাঁড়ালাম। চোখ চলে গেছে একটা শাড়ির দোকানে। সীমান্ত দোকানে ঢুকে পড়েছে, আমি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। এগুলাম শাড়ীর দোকানটার দিকে।
অসাধারন! অপুর্ব! না, কোন মেয়েমানুষ নয়, আমার চোখ গেছে শাড়ির দোকানের শোকেসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা ম্যানিকুইন এর দিকে। ফাইবারের তৈরি মডেলটা এতো সুন্দর যে আমার চোখের পাতাই পড়ছেনা তার দিক থেকে। একি করে সম্ভব! এতো সুন্দর কোন পুতুল হয় নাকি? এতো রক্ত মাংশের মেয়েমানুষের চেয়েও সুন্দরী!
আমি এগিয়ে গিয়ে দোকানটার সামনে দাঁড়াতেই লোকজন এগিয়ে এলো। জানতে চাইলো কোন শাড়ী পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি 'দেখছি,' বলে পাশ কাটিয়ে এলাম। কিন্তু মডেলটার সামনে থেকে নড়লামনা। একজন সেলসম্যান জানতে চাইলো মডেলটার গায়ের শাড়ীটা আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি কিছু না বলে চলে এলাম সীমান্তর কাছে। কিন্তু মন পড়ে রইলো সেই মডেলটার কাছে। যাবার সময় বারবার তাকাচ্ছিলাম পুতুলটার দিকে। এতো সুন্দর কোন মানুষ হতে পারে? আচ্ছা এমন সুন্দর যদি কোন মেয়ে মানুষ হতো তবে কেমন হতো? আমি নিশ্চিতভাবে তার প্রেমে পড়ে যেতাম প্রথম দিনে।
বাড়ি এসে ভুলতে পারলামনা পুতুলটার কথা। বারবার তার চেহারাটা ফুটে উঠতে লাগলো চোখের সামনে। কি সুন্দর ছোট মুখমন্ডল, কি কাটা কাটা নাক, ঠোঁট, চোখ আর গ্রীবা! কিওপেট্রার কথা শুধু বইতেই পড়ে এসেছিলাম এতোদিন এবার মনে হলো আসলে এর কাছে কিওপেট্রা কিছুই না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুতুলটার স্বপ্ন দেখলাম। আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে সে দোকানের ভিতরে।
আর থাকতে পারলাম না, পরদিনই আবার চলে গেলাম বসুন্ধরা শপিং মলে। আবার সেই দোকানে। যে লোকটার সাথে কথা হয়েছিলো গতকাল, সে আমাকে চিনতে পারলো। এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো,'এই শাড়িটাই নেবেন তাহলে?'
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলাম পুতুলটার মুখের দিকে। পুতুলটার চোখ যেন হাসছে। বলতে চাইছে অনেক কথা কিন্তু বলতে পারছেনা।
'ভেতরে আসুন,এটা তো ময়লা হয়ে গেছে। নতুন প্যাক খুলে দেখাই।' লোকটা বললো।
আমি লোকটার দিকে তাকালাম,'ভাই আমি কোন শাড়ি দেখছিনা। আমি দেখছি এই পুতুলটাকে।'
লোকটা ভুত দেখার মতো করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,'কেন, আমি যদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই পুতুলটাকে দেখি আপনার কোন সমস্যা আছে?'
লোকটা আমাকে পাগল ঠাউরেছে নির্ঘাত। সে হাসতে হাসতে ভেতরে গিয়ে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে বলতে লাগলো আমার ব্যপারে। আমি দ্রুত আমার মোবাইলে পুতুলটার একটা ছবি তুললাম তারপর চলে এলাম বাড়িতে।
ছবিটা দেখে দেখে দু'তিন দিন কেটে গেল। আমি একরকম ম্যানিয়াক হয়ে গেলাম। যদি সাইকোলোজিস্ট হতাম তবে হয়তঃ জানতাম এর কোন ব্যাখ্যা আছে কিনা। হতে পারে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আমার এমন আসক্তির সুচনা হয়েছে। যাইহোক আমি এখন এই পুতুলটার প্রেমে পড়েছি নির্ঘাত। এছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা আমি এই মুহুর্তে দাঁড় করাতে পারছিনা।
তিনদিন পর আবার গেলাম বসুন্ধরা শপিং সেন্টারে। যে লোকটার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো সেই লোকটা বড়ো বড়ো চোখে আমাকে দেখেই ভিতরে চলে গেল। গিয়ে তার মালিকের সাথে কিসব বলতে লাগলো আমাকে দেখিয়ে। আমি পুতুলটাকে একনজর দেখে ভেতরে ঢুকে গেলাম। সবগুলো লোক অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখতে লাগলো যেন আমি অদ্ভুত কোন চিড়িয়া।
আমি আজ কোন ভনিতায় গেলামনা। সরাসরি মালিকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,'আমি আপনার এই মডেলটাকে নিতে চাই। আমাকে এর একটা দাম বলবেন দয়া করে?'
'মানে আপনি কি ওই পুতুলটার দাম জিজ্ঞেস করছেন? নাকি শাড়িটার....।'
আমি তাড়াতাড়ি বললাম,'আমি পুতুল আর শাড়িটার দাম জিজ্ঞেস করছি। আমি দুটোই নিতে চাচ্ছি।'
'নিয়ে যান।' মালিকের কথা শুনে মনে হলো তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটা টাকার অঙ্কের কথা বললেন। আমিও আর দরদাম করলামনা। এর সাথে আমার ভাগ্য গাঁথা হয়ে গেছে। দ্রুত নিচে নেমে একটা এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে উপরে এসে পে' করে দিলাম তাকে। লোকটা পুতুলটাকে আলাদা আলাদা করে একটা বাঙ্ েঢোকাবার পাঁয়তারা করছিলো আমি তাকে নিষেধ করলাম। বললাম, আমি পুতুলটাকে পাশে দাঁড় করিয়ে নিয়ে যেতে চাই, শাড়ি পরানো অবস্থায়।
বাড়িতে এসে পুতুলটার একটা নাম দিলাম-রূপালী। কারন যে শাড়িটা সে পরেছিলো তার রঙ রূপালী। আমার রূমে রাখলাম রূপালীকে। আমি পুরো বাড়িতে একা থাকি। বিয়ে করিনি তাই কোন সংসারও নেই। বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিশলেও তাদেরকে কখনও বাড়িতে আনিনি আমি তাই তারা আমার বাড়ি চেনেনা।
এবার ভালোই হলো, সারাদিন ধরে আমি রূপালীর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকি। তার রূপসূধা পান করেও আমার তৃপ্তি মেটেনা। মনে হয় যদি তাকে মানুষ হিসাবে পেতাম আমি জীবনে আর কিছু চাইতামনা। তার নকল চুলগুলো নিয়ে কবিতা লিখি। যখন রুমের আলো তার প্লাস্টিকের চুলগুলোর ওপর প্রতিফলিত হয়ে যায় আমার মনে হয় এ কোন স্বর্গ থেকে আসা অপ্সরী যেন। মাঝে মাঝে তার কাছে গিয়ে খুব ঘনিষ্ঠ স্বরে ডাকি,'রূপালী? রূপালী?'
রূপালী সাড়া দেয়না।
ফাইবারের তৈরী কোন পুতুল কি সাড়া দেবে? কোন দিনও না।
থাক, কোন সমস্যা নেই। হোক সে পুতুল। হোক সে ফাইবারের তৈরী, তাকে আমি পেয়েছি এতেই সন্তুষ্ঠ আমি। রূপালীর সাথে আমার ভাগ্য গাঁথা হয়ে গেছে। রূপালীই আমার সব।
আজ রাতে রূপালীকে সাথে নিয়ে আমি শুয়েছি। উত্তরের জানালাটা খোলা। সেখানে একটা গন্ধরাজ গাছ আছে। উত্তরা বাতাসে সবসময় একটা শীত শীত গন্ধ থাকে। আজ রাতে শীত শীত গন্ধের সাথে যোগ হয়েছে গন্ধরাজ এর গন্ধ। আমি দেখলাম সমস্ত গন্ধরাজ গাছ ঢেকে গেছে সাদা সাদা ফুলে। রূপালীকে পাশে শুইয়ে ওর একটা ফাইবারের হাত টেনে আনলাম আমার বুকের ওপর। এভাবে শুয়ে থাকলাম এক ঘন্টা। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বেশ কিছুন বুঝতে চেষ্টা করলাম ঘুম কেন ভাঙলো। কারনটা কোন ভাবে বুঝতে পারলামনা। হালকা কিছু শব্দ আমার কানে এলো। কে যেন পা টিপে টিপে হাঁটছে। পানি পান করার হালকা শব্দ। কে ওখানে পানি খাচ্ছে? আমি হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ টিপে দিলাম।
রূপালী বসে আছে আমার গোল টেবিলের একটা চেয়ারে। হাতে ধরা পানির গ্লাস। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও হতবাক হয়ে রূপালীর দিকে তাকিয়ে আছি। নড়ছে রূপালী! গ্লাসটা নামিয়ে রাখছে টেবিলে! আমি মশারী তুলে বেরিয়ে এলাম। রূপালীর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। দু'জোড়া চোখ দ'ুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ওকে ফাইবারের তৈরী বলে মনে হলোনা। অবিকল মানুষ! 'রূপালী?' আমি অবাক হয়ে বললাম,'তুমি....।'
রূপালী হাসলো, অপূর্ব সে হাসি। এই হাসি এই জগতের হতেই পারেনা। বললো,'কেন অবাক হচ্ছো বলতো?'
'তুমি যে চলাফেরা করছো!'
'তুমি তো তাই চাচ্ছো!'
'আমি চাইলেই কি সব হয়ে যায় নাকি?'
'আমাদের হয়। কারন আমাদের পৃথিবী আলাদা। তুমি অত্যন্ত মনপ্রান দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছো যা এই পৃথিবীর কোন মানুষের ভালোবাসা নয়। এটা হলো ফাইবারের ভালোবাসা যা নিখুঁত এক ভালোবাসা যার মধ্যে কোন ভান নেই। তাই আমি আমার পৃথিবী থেকে চলে এলাম তোমার পৃথিবীতে। আবার চলে যাবো।'
'কোথায়?'
'আমার পৃথিবীতে।'
'কোথায় তোমার পৃথিবী?'
'অনেক দুরে। আমাদের ওখানে ফাইবারের তৈরী। সবকিছু।'
'কেন যাবে?'
হাসলো রূপালী। অপুর্ব সেই হাসি।'কেন যাবো মানে? আমি তো জাস্ট তোমাকে দেখতে এলাম। তোমাকে একটু ছুঁতে এলাম।'
'কতন থাকবে?'
'এইতো, ভোর হবার আগ পর্যন্ত।'
'তাই যদি হয় তবে আমিও যাবো তোমার সাথে।'
'তুমি যাবে?'
'হ্যাঁ।'
'কিন্তু ওখান থেকে তুমি আর ফেরৎ আসতে পারবেনা।'
'তাও আমি যাবো। আমি আর এখানে ফেরৎ আসতে চাইনা। যেখানে তুমি কথা বলবেনা শুধু পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে সেখানে আমি থাকতে চাইনা।'
রূপালী হাসছে। 'তুমি আমার নাম রেখেছো রূপালী। আমিও তোমার রূপালী হয়েই সারাজীবন থাকতে চাই'
'তাহলে আমাকে নিয়ে চলো তোমাদের দেশে।'
'তাহলে তোমাকে ফাইবার হতে হবে।'
'কিভাবে ফাইবার হবো?'
'আমি তোমাকে ফাইবার বানাবো। আর তুমি একটু ব্যথা পাবে কিন্তু যখন পুরোপুরি ফাইবার হয়ে যাবে তখন অনেক শান্তি লাগবে তোমার।'
'কোন সমস্যা নেই। আমি তবুও তোমার সাথে যাবো।'
রূপালী আমার দিকে তাকালো, 'তাহলে প্রস্তুতি নাও।'
আমি খুব দ্রুত সীমান্তকে একটা ইমেইল লিখলামঃ
সীমান্ত
আমি একটা জরুরী কাজে বিদেশ চলে যাচ্ছি। তোকে একটা
ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছি। তুই আমার রুমে যাবি তারপর....।'
বাকি ইন্সট্রাকশনগুলো লিখে আমি মেইলটা সেন্ড করলাম ওর এড্রেসে তারপর রূপালীর দিকে তাকালাম হাসিমুখে,'এবার তোমার কাজ শুরু করো রুপালী।'
রূপালী এগিয়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি অতি সুন্দর একটা ঘ্রান পেলাম রুপালীর শরীর থেকে। রুপালীর স্পর্শ আমার শরীরে আগুন বইয়ে দিলো। মনে হলো পুড়ে যাচ্ছে চামড়া। কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম। আমার শরীর থেকে সাদা সাদা কি যেন ঝরে যাচ্ছে। অন্যরকম এক আনন্দ আমার মনে। মনে হলো আমি আর রূপালী বিয়ে করছি। একটা সাদা রঙের প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তারপর....।
মেইল পেয়ে সীমান্ত পরদিন সকালেই চলে এলো জাহিদের রুমে। পুরো রুম এলোমেলো। এখানে সেখানে জিনিষপত্র পড়ে আছে। শুধু পরিপাটি জাহিদের বিছানাটা। একদম টানটান। তার মাঝখানে দুটো পুতুল পড়ে আছে। একটা নারী পুতুল আর একটা পুরুষ পুতুল। পুরুষ পুতুলটার পরনে জাহিদের জামা আর প্যান্ট। ইন্সট্রাকশন অনুসারে সীমান্ত পুতুলদুটোকে বসুন্ধরার নির্দিষ্ট একটা দোকানে ফেরৎ দিয়ে এলো। পুতুলদুটোকে পাশাপাশি রাখার জন্যও দোকানের মালিককে বলে দিলো সীমান্ত। তারপর চলে এলো। যাবার সময় সীমান্ত যদি পেছন ফিরে তাকাতো তবে দেখতে পেত পুতুলদুটো চকচকে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক যেমন জাহিদ প্রথম দিনে দেখেছিলো পুতুলটাকে ওর দিকে তাকাতে......।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৮