(তৃতীয় পর্বের পর)....শেলী পরের দিন রাগ করে বাড়িতে ফিরে যায় বাচ্চাকাচ্চা সহ।যাবার সময় বলে যায় সে আর তার স্বামীর কোন খবর নেবেনা কোনদিন।সে বাচ্চাকাচ্চাসহ বাপের বাড়ি চলে যাবে।গ্রামে না খেয়ে মরার চেয়ে চট্টগ্রামে বাপের বাড়িতে চলে যাওয়া ঢের ভাল।
জাহিদ ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিল জানুয়ারীর ২০ তারিখ।আর এখন মার্চ মাসের শেষ।দুটো মাস চলে গেছে ইতিমধ্যে।শেলী সত্যি সত্যি বাপের বাড়ি চলে গেল।বাচ্চাকাচ্চাগুলো নিয়ে তার চলতে ভীষন সমস্যা হচ্ছিলো।কিন্তু ইন্ডিয়া থেকে যে চিঠি আসে তার জন্য প্রস্তুত ছিলনা কেউ।সবার জন্য ভীষন একটা ধাক্কা ছিল সেই ঘটনাটা।কয়েম্বাটোরের কোভাই হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে শাহানার ঢাকার ঠিকানাতে।বিষয়বস্তুটা বিশ্বাসযোগ্য নয় মোটেও।তারা জানিয়েছে ‘জনাব জাহিদের হার্ট অপারেশন করার আগেই তার হার্ট স্ট্রোক করেছিল এবং আইসিইউতে নেবার আগেই তার মৃত্যু হয়।সঠিক ঠিকানা না জানার কারনে তার লাশ দীর্ঘ দুই মাস হিমাগারে পড়ে থাকে।শেষ পর্যন্ত কোন দাবীদারের ঠিকানা না থাকায় তার লাশ চুল্লিতে দাহ করে ফেলা হয়।জনাব জাহিদের বেশ কিছু ব্যবহার্য জিনিষপত্র তাদের হেফাজতে আছে যেমন তার জুতো, ব্যাগ, কিছু টাকা ও মোবাইল।সঠিক প্রমানাদি দিয়ে জিনিষপত্রগুলো নিয়ে যাবার অনুরোধ রইলো।’
চিঠি পাবার পর বিশ্ময় আর কষ্ট একসাথে চেপে ধরলো শাহানাকে।এতো একেবারে অসম্ভব একটা ব্যপার।জাহিদ মরে কিভাবে? সেতো সেদিনও কথা বললো।বললো সে মুম্বাই গেছে।দুই মাস আগে যদি মারা যেতো তবে কিভাবে সে কথা বললো? মিথ্যা বলেছে তারা? কিন্তু ব্যবহার্য জিনিষপত্রের যে লিস্ট দিলো তাতো সঠিক।তবে কি জিনিষপত্রগুলো রেখেই চলে গেল জাহিদ মুম্বাইতে?
শাহানা চিঠির কথাটা শেলীকে বলেনা।শেলী মাঝেমধ্যে ফোনে জিজ্ঞেস করে তার স্বামীর কথা।কিন্তু শাহানা মিথ্যে করে বলে সে ফোন দিয়ে বলেছে এখন ভাল আছে।কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে ঢাকাতে।এভাবে আরও এক মাস দশ দিন কাটে।শেলী আবার বাচ্চাদের নিয়ে শাহানার কাছে আসে।বাপের বাড়িতেও তার মন বসেনা।বাচ্চাগুলো তাদের বাবাকে দেখার জন্য প্রতিদিনই কান্নাকাটি করে।তার অসহ্য লাগে সবকিছু।
শেলী যেদিন ঢাকাতে আসে ঠিক সেদিন রাতে 000000 নাম্বার থেকে ফোন আসে।আনন্দে কেঁদে ফেলে শেলী।জিজ্ঞেস করে সে কোথায় আছে এখন।জাহিদ ধরা গলায় বলে,‘আমি গুজরাটে আছি।অনেক গরম এখানে।তবে অনেক সুন্দর জায়গা।সারাক্ষন বাতাসে ভেসে থাকতে ইচ্ছে হয়।তোমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু কি করবো, উপায় নেই।এখান থেকে ইন্দোর যাবো।ওখানে নাকি বড়ো একটা হার্টের হসপিটাল আছে।ওখানের ডাক্তাররা হয়তো কোন ওষুধ দেবে,আর সবাইতো খালি অপারেশন করতে বলে।’
শেলী কাঁদতে কাঁদতে বলে,‘তুমি কি এখনও সেই হার্ট অপারেশনের কথা নিয়ে আছো?আমাদের কথা একটুও ভাবোনা?আমরা কিভাবে আছি না আছি একটুও চিন্তা হয়না তোমার?’
‘হয়।কিন্তু আগে তো হার্ট এর চিকিৎসাটা করাতে হবে।’ জাহিদ বলে।‘ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।’
‘তোমার চিকিৎসা লাগবে না।প্লিজ তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে এসো।’ শেলী অঝোর কাঁদতে থাকে।
‘তুমি কেঁদোনা।আমার হার্টে ব্যথা হবে।’জাহিদ বলে।‘আর আমার হার্টে ব্যথা হলে ডাক্তাররা আবার বলবে অপারেশন করতে।’
‘প্লিজ তুমি ফিরে এসো।’
লাইনটা কেটে দেয় জাহিদ।
আরও চারমাস কেটে যায়।এরিকের জন্মদিন।বাড়িভর্তি মানুষ।পুস্পিতা সারাঘর দৌড়ুদৌড়ি করছে।অনেক বাচ্চাকাচ্চা এসেছে।তাদের সাথে খেলছে।শাহানার দুটো বাচ্চাই।এরিক এবার ও লেভেল পরীক্ষা দেবে।পুস্পিতা মাত্র কেজি ওয়ানে পড়ছে।কেক আনা হয়েছে।কেকের ওপর ওগি এ্যান্ড দ্যা ককরোচেসের ছবি।শাহানা মোবাইলে ছবি তুলছে।মেহমানরা জড়ো হয়ে গল্প করছে।ঠিক এই সময়টাতে হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে শাহানার।সেই 000000 নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।শাহানা তাড়াতাড়ি ফোন ধরে।জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।‘ইন্দোর থেকে কানপুর এসেছি প্রায় একমাস।এখানে বেশ ভালো কিছু হাসপাতাল আছে।এরা হয়তো কিছু ওষুধ দিতে পারবে আমাকে।মনে হয় এখান থেকেই ভাল কিছু হার্টের ওষুধ পাবো আমি…..।
‘আপনার হার্টের চিকিৎসার কথা শুনতে আর ভাল লাগেনা’।মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে শাহানা।‘আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন,আমাদের ফোন দেবার দরকার নেই।আজ এরিকের জন্মদিন।আমি ব্যস্ত আছি।’
‘ওহ আচ্ছা।এরিককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাস।’
‘ঠিক আছে।’ এবার শাহানাই লাইন কেটে দেয়।
এই ঘটনার প্রায় এক বছর কেটে গেছে।সেদিনের পর আর কল দেয়নি জাহিদ।বেশ কয়েকবার শেলী ফোন দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল জাহিদের কথা।শাহানা মিথ্যে করে বলেছে জাহিদ ইন্ডিয়াতে চাকরি পেয়েছে।সেখানে থেকে গেছে।শেলী রাগ করে লাইন কেটে দিয়েছে।শাহানার আর ইচ্ছাও নেই ভাইয়ের খোঁজ নেয়ার।সে বুঝতে পারেনা কি ঘটেছে তার ভাইয়ের।তারপরও ভাই বলে কথা।যেহেতু জাহিদের কোন নাম্বার নেই তাই তারও খোঁজ নেবার কোন উপায় নেই।কিন্তু সময়ে সকলি সহ্য হয়।টাইম হিলস দ্যা উন্ড!একসময় বিষয়টা শাহানার কাছে হালকা হয়ে যায়।এরিক ও লেভেল দিয়ে এ লেভেলে ভর্তি হয়।পুস্পিতা কেজি টু থেকে স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে ভর্তি হয়। ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে আজকাল।ছুটি বলে কিছু নেই।নেই কোন অবসর।রান্নাবান্না তো আছেই।অবসরে পুস্পিতাকে পড়াতে হয়।এরিককে কোচিং থেকে আনতে হয়। এরই মধ্যে একদিন ঠিক রাত এগারোটা তেত্রিশ মিনিটে 000000 নাম্বার থেকে কল আসে।শাহানার বুক ধড়াশ করে ওঠে,সেই সাথে একটা আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে মনে,‘ভাইয়া!’
জাহিদ তেমন কোন উচ্ছাস দেখায় না।বলে,‘কাল উত্তরাখন্ডে যাচ্ছি।নৈনিতালে অনেক ভাল ভাল হসপিটাল আছে।ওরা নিশ্চয় ওপেন হার্ট করতে বলবেনা।দেখি হয়তো ওরা ভাল কোন ওষুধ দেবে,আমি ভাল হয়ে যাবো।’
শাহানা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,‘আপনি এখন কেমন আছেন ভাইয়া?কোথায় আপনি?আর দেশে আসবেন না?’
‘জানিনা।’জাহিদ বলে,‘তার কোন উপায় নেই।আমার জন্য দোয়া করিস।’
‘ভাইয়া, আমি তো…..।’
জাহিদ লাইন কেটে দেয় কথা না শুনেই।
দুই বছর অনেকটা সময়।এই সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়।শেলীও বদলে যায়।স্বামীর কথা অনেকটা ভুলে গেছে সে।চট্টগ্রামে থাকে।একটা গার্মেন্টসে চাকরি করে।বাচ্চাগুলোকে তার নানা নানীই দেখাশোনা করে।বাচ্চাগুলোও তার বাবার কথা অনেকটা ভুলে গেছে।শাহানাও ভুলে গেছে তার ভাই এর কথা।দুই বছর পর একদিন আবার ফোন আসে জাহিদের কাছ থেকে,‘দোয়া করিস এবার নিশ্চয় উপায় একটা হবে।আমি কাল চন্ডিগড় যাচ্ছি।ওখানে ডাঃ রবি নাকি ভাল ডাক্তার।উনি নিশ্চয় ভাল কোন ওষুধ দিতে পারবে।আর সব তো চোর, খালি ওপেন হার্ট করার কথা বলে!’
শাহানা রেগে গিয়ে বলে,‘আমাদের সাথে ফাজলামি করেন আপনি?দুই বছর ধরে ইন্ডিয়ার দক্ষিন থেকে উত্তরে ট্রাভেল করে বেড়াচ্ছেন আর আমাদের খালি গান শোনান যে হার্টের জন্য ইন্ডিয়াতে আছেন।ফাজলামি?’
গম্ভীর গলায় জাহিদ বলে,‘দোয়া করিস যেন ভাল একটা হার্টের ডাক্তার পাই।’
শাহানা ভাবে তার ভাই বোধহয় আরেকটা বিয়ে করেছে ইন্ডিয়াতে।নাহলে এমন করে কেউ দুটো বছর পার করে দিতে পারে?ছেলেমেয়েদের খোঁজ না নিয়ে যে থাকতে পারে সে তো আর যাই হোক বাবা হতে পারেনা।তার ঘৃনা হয়।ফোন কেটে দেয় সে।
গ্রামের সবাই জানে জাহিদ এখন একটা নিখোঁজ চরিত্র।নিখোঁজ না হলে সে স্বেচ্ছায় এমন করতো না। পাঁচ পাঁচটা বছর সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।কোন খবর নেই।গ্রামে এখন আর তার পরিবারের কেউ থাকেনা।তার বাচ্চাগুলো বড়ো হয়ে গেছে।শাহানাও ব্যস্ত।ভাইয়ের কথা মোটামুটিভাবে ভুলে গেছে সে। এরিক এখন বিবিএ সেকেন্ড ইয়ারে আছে।পুস্পিতা স্ট্যান্ডার্ড ফোরে পড়ে।এক শীতে আবার ফোন করলো জাহিদ,‘কাল কাশ্মির যাচ্ছি।দোয়া করিস।ওখানে গিয়ে যেন একটা ভাল হার্ট স্পেশালিস্ট পাই।’
বিরক্ত শাহানা জিজ্ঞেস করলো,‘বাড়ি ফিরবেন কবে?’
‘জানিনা।দেখি হার্টের চিকিৎসা হলে বাড়ি ফিরবো।’
লাইন কেটে দিল জাহিদ।লাইন কেটে দেবার পরও শাহানা বলতে লাগলো,‘পাঁচ বছর ধরে খালি হার্টের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন।আপনি সারা জীবন হার্টের চিকিৎসা করতে থাকুন।’
এরিকের বিয়ের দিন।জাহিদ নিরুদ্দেশ হবার নয় বছর পর।সবাই ব্যস্ত।বউয়ের বাড়ি থেকে পাত্রীপক্ষ আটটা গাড়ির একটা বহর নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে পাত্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে।শাহানা মোটামুটি সব রেডি করেছে।বাড়িভর্তি মানুষজন।মেয়েরা দাঁড়িয়ে গেছে গেটের কাছে।ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ুদৌড়ি করছে।চারদিকে সাজসাজ ভাব।এমনি সময় 000000 থেকে কল আসে শাহানার মোবাইলে।শাহানা কল রিসিভ করে বলে,‘আমি এখন ব্যস্ত আছি।আজ এরিকের বিয়ে।’
‘শুভেচ্ছা রইলো।কাল আবার ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি।দেখি ভাল কোন হার্টের ডাক্তার পাই কিনা।আমি কোনদিনও হার্টের অপারেশন করবো না।যদি কোন ডাক্তার মেডিসিন দেয় তবেই খাবো।’
‘নয় বছর ধরে তো হার্টের চিকিৎসা করেই যাচ্ছেন আপনি।আর কতো এমন করবেন?’
‘এই শেষ।আর না।আমার ছুটি হয়ে গেছে।’
‘ছুটি হয়ে গেছে মানে?’
‘আমার হার্টটা আর নেই।’
‘হার্ট নেই মানে!’
‘ওটা পুড়ে গেছে।’
‘কি বলছেন উল্টোপাল্টা।’
‘আজ থেকে নয় বছর আগে আমার হার্টটা ওরা পুড়িয়ে ফেলেছে।তাই যে ডাক্তারের কাছেই যাই ওরা আমার হার্টটা দেখতে চায়।আমি কিভাবে আমার হার্টটা দেখাবো?আমি বলি যে আমার হার্টে সত্যিই সমস্যা আছে তারপরও ওরা বিশ্বাস করেনা।যে হার্ট নেই তার অপারেশন করবো কিভাবে বল? কয়েম্বাটুর এর কোভাই হাসপাতালে আমার জিনিষপত্রগুলো নয় বছর যাবৎ পড়ে আছে।মোবাইলটা,বেশ কিছু টাকাপয়সা আর জামাকাপড়।ওগুলো শেলীকে দিয়ে দিস।ওর কাজে লাগবে।আর একটা জারে আমার শরীরের দেহভষ্ম রাখা আছে।লকার নম্বর ২৫।ওটা নিয়ে এসে ছাইগুলো গ্রামের মাটিতে পুতে দিতে হবে।আর তাহলেই আমি ছুটি পাবো।আর তোদের ফোন করে জ্বালাবো না।বিদায় তোদের।ভালো থাকিস।’
শাহানা দেখলো ওর সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে।দুরে অনেক গাড়ির সম্মিলিত হর্ন।পাত্রীপক্ষ এসে গেছে।ও মাথা ঘুরে পড়ে গেল বিছানার ওপর। (সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৯