(আগের পর্বের পর)....শেলীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।শেলীও কিছু বলতে পারছিল না । আজ তার স্বামী আসেনি ।সে এসেছে ডাক্তারের কাছে ।ডাক্তার তাকে বলেছে জরুরীভাবে জাহিদকে ওপেন হার্ট সার্জারী করাতে হবে ।যার জন্য অনেক টাকা লাগবে ।শেলী জানেনা এতো টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে ।হয়ত: আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার করে নেয়া যাবে কিন্তু সমস্যা হয়েছে জাহিদকে নিয়ে ।সে বলছে সে ওপেন হার্ট করবে না । দরকার লাগলে এই ডাক্তার বাদ দিয়ে আরও ভাল ডাক্তারের কাছে যাবে ।এই ডাক্তারের সিদ্ধান্ত ভুলও তো হতে পারে।দেখা যাবে অন্য ডাক্তার তাকে অন্য পরামর্শ দেবে ।হয়ত: তাকে এমন ওষুধ সে দেবে যার জন্য সে ওপেন হার্ট থেকে বেঁচে যাবে ।
শেলী বলেছে এর চেয়ে সে কোথায় ভাল ডাক্তার পাবে?জাহিদের ইচ্ছা সে ঢাকায় যাবে ।তার হাতে কিছু টাকা আছে ।এই টাকা দিয়ে ভাল ডাক্তারের চিকিৎসা করবে ।দরকার লাগলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করবে কম টাকায় ।
সাতদিনে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করে জাহিদ পুরোনো বাকির খাতা খুলে ।এই টাকার ওপর ভরসা করে স্বামী স্ত্রী এসে একটা হোটেলে ওঠে ।ভর্তি হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ।সেখানেও ডাক্তার পুরোনো রিপোর্ট দেখে নতুন টেস্ট করার জন্য স্লিপ লিখে দেয় ।এবার আর ইসিজি নয়,তার এনজিও গ্রাম করানো হয় ।এতে আরও ভয় পেয়ে যায় জাহিদ ।এই ব্যাথাতেই কাতর সে।রিপোর্টে দেখা যায় তিন তিনটে ব্লক আছে তার ।দুটো হান্ড্রেড পার্শেন্ট আর একটা সেভেনটি ফাইভ পাশেন্ট ।তারমানে জরুরীভাবেই কেবল ওপেন হার্ট করা যেতে পারে । জাহিদের জন্য এখন অপারেশন থিয়েটার ছাড়া আর কোন গন্তব্য নেই ।রাস্তায় থাকাও তার জন্য ঝুঁকির কারন ।
কিন্তু না, জাহিদ অনড়।সে ওপেন হার্ট করবে না ।সরকারী হসপিটালের ডাক্তার কম পয়সার ডাক্তার ।এদের জ্ঞান এতো বেশী নয় ।সে ইউনাইটেড বা স্কয়ারের মতো হাসপাতালে যাবে । ভিজিট তো বেশী নয় ।ভালো ডাক্তার দেখাতে যেহেতু সে ঢাকাতেই এসেছে ভালো ডাক্তারই দেখাবে ।সরকারী হাসপাতালে আর নয় ।খুবই বিরক্ত হয়ে যায় শেলী ।তারপরও স্বামীকে সে খুবই ভালবাসে । স্বামীর জন্য নিজের জীবনও বিসর্জন দিতে পারে সে।তাই সে স্বামীকে বলে দেয়, এটাই শেষ । এখানকার ডাক্তার যা বলবেন তাই করতে হবে জাহিদকে ।এবার জাহিদ না করতে পারবে না ।
জাহিদও মেনে নেয়।কিন্তু দুর্ভাগ্য । ডাক্তার কুমার একই কথা বললেন ।ওপেন হার্ট সার্জারী বা বাইপাস ছাড়া কোন উপায় নেই । বুকের পাঁজর কাটতেই হবে ।মুষড়ে পড়ে জাহিদ ।শেলী তাকে সান্তনা দেয়, এতে কোন ভয় নেই ।সে যদি সুস্থই না হতে পারে তবে ব্যবসা করবে কি করে । তার দোকানের যে দামী দামী লাইটগুলো আছে সবগুলো বিক্রী করে দিলে অনেক টাকা আসবে । সেই টাকা দিয়ে খুব ভালভাবে ওপেন হার্ট এর খরচ হয়ে যাবে ।জাহিদ কোন মন্তব্য করে না । হঠাৎই সে একটু নিরব হয়ে গেছে ।তারপরও তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা । হোটেলে কাটিয়ে দেয় সাতদিন । শেলী আরও বিরক্ত হয়ে ওঠে।স্বামীকে রাজী করাতে পারেনা ওপেন হার্ট সার্জারী করাতে ।সে যে ঢাকায় এসেছে সে খবর কাউকেই বলেনি শেলী । জাহিদের আপন বোন থাকে ঢাকায়।যখন সব ব্যর্থ হয়ে যায় তখন উপায়ান্তর না পেয়ে শাহানাকে ফোন করে শেলী ।শাহানাও তার ভাইকে একই পরামর্শ দেয় । তার বাড়িতে উঠতে বলে । জাহিদ না বলেনা । এক এক করে বোনের বাড়িতে কাটিয়ে দেয় দশ দিন।কিন্তু ওপেন হার্ট সার্জারীর কথা মুখেও আনেনা ।সে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটা কাউকে বলতেও চায়না সে ।সকাল হলে বেরিয়ে যায়, সন্ধায় ফিরে আসে। এই সময়টা খুব ভয়ে থাকে শেলী।কখন কি সংবাদ আসে কে জানে ।নিজেকে পুরোপুরি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকে ।প্রতিদিন একই নিয়মে চলতে থাকে জাহিদ।দিন হলে বেরিয়ে গিয়ে বিভিন্ন হসপিটাল, মেডিসিন সেন্টার, নাসিং হোমের লোকদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয় কি করবে সে। সবাই যখন পরামর্শ দেয় ওপেন হার্ট সার্জারী করতে বা বাইপাস করতে তখন সে আর সেই লোকের সাথে দেখা করেনা ।তার বিশ্বাস কোন দিন কোন না কোন ডাক্তার তাকে ওপেন হার্ট না করে কিছু ওষুধ খেতে দেবে। যা খেলে তার সব রোগ ভাল হয়ে যাবে ।কিন্তু তা বলেনা কেউ।ধীরে ধীরে বুকের ব্যথা বাড়তে থাকে।জাহিদ নিজেও থমকে যায়।কি করবে বুঝতে পারেনা সে।
নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয় দেশে না চিকিৎসা করিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার।সেখানে নামকরা ডাক্তার আছেন। তারা বাংলাদেশী ডাক্তারদের চেয়েও ভাল।আশাকরি তারা বাংলাদেশী ডাক্তারদের মতো ওপেন হার্ট সার্জারী করতে বলবেনা।বাংলাদেশের মতো টাকার খেলা তো সেখানে নেই।যে ভাবা সেই কাজ।জাহিদ শেষ চিকিৎসা হিসাবে দ্রুত পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলে কাউকে না জানিয়ে।ভিসার জন্যও পাসপোর্ট জমা দিয়ে আসে।দেখতে দেখতে তার চিকিৎসা ভিসা হয়ে যায়।ভিসা পাবার পরই সে শেলীকে জানায় যে সে ইন্ডিয়া যাবে।সবাই অবাক হয়ে গেলেও কেউ তার কথার ওপর না বলতে পারেনা কারন সবাই জানে জাহিদ একটু একরোখা স্বভাবের।কারো কথার গুরুত্ব তার কাছে নেই।সে যা ভাববে সেটাই তার কাছে বড়ো।
জাহিদ দ্রুত দেশের বাড়িতে যায়।সেখানে এক দালালের সাথে কথা বলে তার দোকানের যতো দামী দামী লাইট আছে সব মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়।তার জানা মতে দোকানে প্রায় বিশ লাখ টাকার লাইট আছে।যে ঝাড়বাতিগুলো আছে, সেগুলোর দামই তো প্রায় পনেরো লাখ টাকার ওপরে।কিন্তু জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন তার কাছে আর কিছু নেই এইমূহুর্তে।এখন টাকা হলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার দেবী শেঠীজির কাছে সে যেতে পারবে চিকিৎসা করাতে।তার বিশ্বাস এতেই কাজ হবে।দেবী শেঠি যে ওষুধ দেবে তাতেই তার কাজ হবে।দুনিয়ার সেরা ডাক্তার বলে কথা।ঢাকা থেকেই সে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয় দেবী শেঠির।চারদিন পরেই ডাক্তারের সাথে দেখা করার কথা তাই সে দ্রুত রওয়ানা দেয়।শেলীর চোখে পানি।স্বামীকে বিদায় দেবার সময় সে বারবার প্রার্থনা করতে থাকে যেন সুস্থ হয়ে তার স্বামী আবার ফিরে আসে তার বাড়িতে।ঢাকা থেকে বিদায় নেবার সময় তার ভাগ্নে এরিক গোপনে তার মামার মোবাইলে একটা ট্রাকিং ডিভাইস ইনস্টল করে দেয়।
স্বামী চলে যাবার পর শেলী আর বাড়িতে যায়না।ঢাকাতেই থাকে।গ্রামে গেলে নানা মানুষ নানা কথা বলে।গ্রামের মানুষের মুখের লাগাম নেই।তারা সান্তনা দেবার বদলে যন্ত্রনা আরও বাড়িয়ে দেয়।তাই স্বামীর ফোনের অপেক্ষায় থাকে সে।যদি কোন ভাল সংবাদ পায় তবে বাড়িতে যাবে।এরিক ডিভাইস ট্রাক করে দেখে জাহিদ কোলকাতা থেকে ব্যাঙালোরের পথে রওয়ানা হয়েছে।তারমানে সে ইন্ডিয়ান মোবাইল সিম কিনেছে এবং ডেটা ব্যবহার করছে।
ঠিক চারদিন পর হোয়াটসএ্যাপে কল দেয় জাহিদ।জানায় সে দেবী শেঠির কাছে চিকিৎসা নেবেনা।দেবী শেঠি তাকে ওপেন হার্ট সার্জারী করতে বলেছেন।শেলী রেগে যায় তার স্বামীর কথা শুনে।দেবী শেঠি যা বলেন তাই করতে হবে তাকে এটা বলে দেয় সে।জাহিদ যদি তার কথা না শোনে তবে সে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবে।ঢাকা এসে তাকে আর খুঁজে পাবেনা।জাহিদ জানায় সে ব্যাঙ্গালোর থেকে কয়েম্বাটুর যাবে।সেখানেও একটা ভাল একটা হসপিটাল আছে হার্টের । ডাঃ সৌমেন হলো তার চেয়ারম্যান।ও তার সাথে দেখা করবেন।শেলী চিৎকার করে বলে,‘তোমার যা খুশি তাই করো,এখানে আমাকে টেনোনা।আমি এসব থেকে মুক্তি চাই।’
জাহিদ লাইন কেটে দেয়।বাড়ির সবাই প্রায় মেনে নিয়েছে জাহিদের এই পাগলামিটা।এখন শাহানার কাছেও এটা বড়ো কিছু মনে হয়না।কিন্তু শেলী বাড়িতে চার চারটে বাচ্চা রেখে এসেছে আরেকজনের জিম্মায়।জাহিদ কি তার ভীতিটাকেই বড়ো করে দেখছে?সে কি তাদের জন্য একবারও ভাবছেনা?মানুষ হয়ে জন্মেছে, একদিন মরতে হবে।এত ভয় পাবার কি আছে?
দু’দিন পরে আবার কল দেয় জাহিদ।জানায় ডাঃ সৌমেনও তাকে ওপেন হার্ট করতে বলেছেন।সে তাদের কারো কথাই মানতে পারেনি।এরা কেউই তার হার্টের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারেনি।তার অপারেশন দরকার নেই।সাধারন ওষুধেই চলে যাবে।তাই সে এখন এমন একজন ডাক্তার খুঁজছে যে সার্জন নয়।সব সার্জনই পয়সা খাবার তালে থাকে।
শেলী বেশী কথা না বলে তাকে ঢাকা চলে আসতে বলে।জাহিদ বলে,চিকিৎসা না করে সে ঢাকা আসবেনা।সে আরও বেশ কিছু ডাক্তারের সাথে দেখা করে তবেই আসবে।(চলবে....পরের পর্ব খানিক পরই প্রকাশিত হবে।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:১৫