(কপিরাইটকৃত গল্প। )
‘দেখতো আমার বুকটা এতো ধড়ফড় করছে কেন?’
‘কই দেখি?’ শেলী এগিয়ে এসে স্বামীর বুকে হাত দেয় । দেখে সত্যি, জাহিদের হার্ট বিট বেশী । ‘চলো ডাক্তারের কাছে যাই ।’
‘দুর, এতে ডাক্তারের কাছে যাবার কি আছে?’ জাহিদ উঠে বসে ।‘আজ অনেক কাজ আছে । নতুন কিছু কাস্টমার আসবে দেখা করতে ।’
শেলী আর কিছু বলেনা । এই বিজনেসটাই তাদের ভরসা ।ওরিয়েন্টাল লাইট হাউজ ।বিভিন্ন ধরনের লাইটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ।দিনকে দিন ব্যবসা খারাপের দিকে যাচ্ছে ।মানুষের হাতে বোধহয় টাকাকড়ি কমে যাচ্ছে দিনদিন ।এমন দুর্দিনে কাস্টমার আসছে তাই ঢের ।জাহিদ দ্রুত ঘড়ি দেখে উঠে পড়ে । গোসল সেরে দুপুরের লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ে দোকানের উদ্দেশ্যে ।মফস্বলের দোকান অথচ জাহিদ সাজিয়েছে দামী দামী লাইট দিয়ে । এসব জায়গায় এমন দোকান চলবে কিভাবে?যেখানে একটা মুদি দোকানই ঠিকমতো চলতে চায়না সেখানে লাইট হাউজ!
কাস্টমারের সাথে দেখা হলো ঠিকই কিন্তু কথা শুরু করার আগেই হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল ।এতো দিন ভাবতো গ্যাসের ব্যথা, আজ একটু অন্যধরনের লাগলো।মনে হচ্ছে ব্যথার উৎসটাই বুঝতে পারছেনা সে । কিছু বোঝার আগেই অজ্ঞান হয়ে যায় জাহিদ ।
যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলো তাকে ঘিরে আছে অনেকে । শেলীকে কান্নারত দেখতে পাওয়া গেল মাথার কাছে ।তার ছোট ভাইরা ঘিরে বসে ভাবীকে সান্তনার বানী শোনাচ্ছে । জাহিদকে চোখ মেলতে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল ওরা । তাদের চেহারায় ভীতি আর শংকার মিলীত রূপ ।জাহিদ একটু হাসার চেষ্টা করলো,‘কিছু হয়নি, একটু বুকে ব্যথা হয়েছিল ।’
‘তোমাকে বলেছিলাম ডাক্তারের কাছে যেতে,’ কান্না ভেজা গলায় শেলী বললো,‘ব্যবসা তোমার কাছে বড়ো । তোমার যদি কিছু হয়ে যায় কি হবে আমাদের? এই চার চারটা বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব আমি?’
‘এইতো ডাক্তারের অফিসেই তো এলাম!’ পরিবেশটা একটু হালকা করার চেষ্টা করলো জাহিদ । ভেবেছিল সবাই তার কথায় হাসবে । কিন্তু না, সবাই যেন কি নিয়ে খুবই টেনশনে আছে ।
এরপর একটা মাস অনেক কষ্টে পার করলো জাহিদ ।ডাক্তারের মাপা মাপা নিয়ম । এতোদিন তো বেহিসাবী চলাফেরা করেছে । ইচ্ছে হয়েছে কিনে এনেছে চার কেজি গরুর চর্বিযুক্ত মাংশ । ইচ্ছে হয়েছে বাজারের সবচেয়ে বড়ো রুই মাছটা কিনে এনেছে ।আর এখন মাপা মাপা ভাত খাও, তাও বিশেষ ধরনের রান্না করা খাবার। মাংশ তো বলা যায় নিষিদ্ধ বস্তু।শেলী তো কোনভাবে তাকে এক টুকরো খেতে দেবেনা ।জাহিদ বলা যায় একটু পেটুক স্বভাবের । টাকা না থাকুক বাকিতে সওদা করার অভ্যাস তার আছে । তার কথা হলো টাকা না থাকলে কি খাওয়া বন্ধ হবে? এ ধরনের মানুষ যে ভুগবে তা বলাই বাহুল্য । তবে শেলী জানেনা যে বাড়িতে সব কিছু নিষিদ্ধ হলে কি হবে, দোকান থেকে জাহিদ এখনও চলে যায় সজিবের হোটেলে ।সেখানে কাচ্চি বিরিয়ানী, বিরিয়ানী বা মোরগ পোলাও মেরে বাড়ি ফেরে ।
ডাক্তার পইপই করে বলেছে তার হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে ।এখন একটা সময় পর্যন্ত অবজারভেশনে থাকতে হবে ।ওষুধ চলবে । যদি সময় পার হবার পরও দেখা যায় কাজ হয়নি তবে অপারেশনে যেতে হবে।জাহিদ ভাবে কে জানে কি অপারেশন, যা হয় হবে।না খেয়ে মরলে তো সবই শেষ । এমনিতে মরবে ওমনিতে মরবে, না খেয়ে মরলে আপশোষ রয়ে যাবে ।
এভাবেই চলছিল।হঠাৎ করে আবারও অসুস্থ হয়ে গেল জাহিদ ।তার মনে হল এবার আগের চেয়ে বেশী ব্যথা সে টের পাচ্ছে । সেই সাথে জায়গা দখল করলো ভীতি । এতোদিন ভীতিটা তার আসেনি । যখন দম বন্ধ হয়ে মর মর অবস্থা হয়েছিল সে চিৎকার করে দোকান মাথায় তুলেছিল । সে জ্ঞান হারায়নি, তবে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিল । সে ভেবেছিল মারা যাচ্ছে । বারবার ডাক্তারকে বলছিল ডাক্তার সাহেব আমি কি মারা যাচ্ছি?
এইবার মোটামুটি পথে এল জাহিদ । মাংশ খাওয়া পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিল । ব্যবসার চাপ নেওয়াটাও কমিয়ে দিল ।ধর্মের পথে ধুম করে এসে পড়লো ।দাড়ী রাখলো, মাথায় উঠলো টুপি। তবে জোব্বা পরবে কিনা এই নিয়ে তার মনে দ্বিধা ছিল যে এই পোশাক তাদের পোশাক নয়, আরবের পোশাক ।শেষ মেষ শার্ট প্যান্ট পরে থাকারই সিদ্ধান্ত নিল । সে যাই হোক মনে মনে ভেঙে পড়লো সে ।কারন যার মনে একবার মৃত্যুভয় ঢুকে যায় সে জীবন্মৃত অবস্থায়ই বেঁচে থাকে । সে অন্যসকলের মতো চলতে পারেনা ।এমনকি শেলীর সাথে দুর্বল মুহুর্তের সঙ কমিয়ে দিল জাহিদ ।কারন তার হার্ট দুর্বল ।তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এখন ।
তার ডাক্তারের নাম আবদুর রাজ্জাক । ঢাকাতে থাকেন, কেবল শুক্রবারে মফস্বলে আসেন গ্রামের আর মফস্বলের রোগীদের চিকিৎসার জন্যে । তিনিই এই প্রথমবারের মতো তাকে ওপেন হার্ট সার্জারীর কথা বললেন । জাহিদ জীবনে প্রথমবারের মতো শুনলো ওপেন হার্ট সার্জারীর কথা ।সেটা কি জিনিষ সে যেহেতু জানেনা তাই অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সদুত্তর পেলনা । মফস্বলের মানুষ এতো কঠিন বিষয় জানবে কি করে? তবে জ্ঞানী মানুষের অভাব কোনখানেই নেই । প্রতিটা জায়গাতেই দেখা যায় কোন মানুষ আছে যে সব কিছুই জানে, সব কিছুরই খবর রাখে ।এমন একজন মানুষ মামুন । তার মার্কেটের ম্যানেজার । সেই তাকে ইউ টিউব খুলে দেখালো ওপেন হার্ট সার্জারী কিভাবে করে ।জাহিদ বিশ্মিত চোখে দেখলো কিভাবে সার্জন একজন রোগীর বুকের দুই পাঁজরের মাঝখানটা প্লায়ার্স দিয়ে কেটে ফেলছে ।তারপর পাঁজরদুটো খুলে ফেললো দুই পাশে।হুকের সাথে আঁটকে রাখলো।হৃদপৃন্ডটা তারা ওয়াশ করলো, বারবার তারা একটুকরো স্পঞ্জ দিয়ে রক্তগুলো তুলো নিচ্ছিল বুকের ভেতর থেকে ।দুর্বল হার্ট বেশী চাপ নিতে পারেনি জাহিদের ।সে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে । জ্ঞান হারিয়েছিল ।
তৃতীয় বারের মতো তাকে হসপিটালে নেয়া হয়েছিল। অজ্ঞান অবস্থায় জাহিদ বারবার চিৎকার করে বলছিল যেন তাকে ওপেন হার্ট করার জন্য থিয়েটারে নেয়া না হয় ।বারবারই সে গোঙাচ্ছিল, আমি অপারেশন করবো না ।আমি অপারেশন করবো না (চলবে.... পরের অংশ খানিক পরেই প্রকাশিত হবে।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:৪৩