দেবদারু পাতার সর সর শব্দে যেন জেগে উঠলো আরেকটি দিন। বারান্দায় গ্রীলের ফাঁকে ফাঁকে এসে পড়া মেঘভাঙা রোদ্দুর রাতজাগা চোখ দু’টিতে আগুন ধরিয়ে দিল। বাথরুমে ঢুকে বেসিনের কলের সাথে মুখটা একেবারে লাগিয়ে দিলাম। জলের তুমুল ছিটাতেও মাথার ঘোর ভাবটা কাটে না। বাইরের বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারে আধশোয়া হয়ে সকালের নীল ঝকঝকে আকাশটিতে চোখ রাখি। টুকরো টুকরো মেঘের পালক আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে চলেছে। যেন বা চলে যাওয়া মানুষের ফেলে যাওয়া অসংখ্য দিনের মতে, উড়ে উড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে, জড়িয়ে যাচ্ছে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
অফিসে এসে কাজর ফাঁকে ফাঁকে বারবার শুধু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। আজকাল এক একদিন এমনই হয় কোন কিছুতেই মন বসেনা। ভরদুপুরের দিকে চোখ মেলে তাকালে সময়টাকে বিকেল মনে হয়।
িক্রম কালারের শার্টেও সাথে ম্যাচ করা ব্লু-টাই, নেভী ব্লু ট্রাউজার, চকচকে জুতোর আগা সবই ঠিক । সান মাইকা সেটিং টেবিল, নরম কাচের পেপার ওয়েট, বকস ফাইল, লেজার বুক, এলসি স্টেটমেন্ট, যেখানে যেমন থাকার কথা তেমনই আছে। অফিসের যা কিছু এটিকেট তার কোন ব্যতিক্রমও নয়। এয়ারকন্ডিশন থেকে আসছে হিম। তবু আজ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি.........
একটা সময় জীবনটা ছিল বাউন্ডুলে প্রকৃতির, অনেকটা যাযাবরদের মতোই। ছোট বেলা থেকে অতি দুরন্ত, স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাও কেটেছে ঠিক ওভাবেই। আমার বাউন্ডুলেপনা চুড়ান্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে এদিক-সেদিক করে কিনে ফেলা একটি ক্যামরাকে কেন্দ্র করে। যাকে উছিলায় ছুটেছি গ্রাম-গ্রামান্তরের পথ থেকে পথে। এমনকি কয়েক বার দেশের বাইরেও পাড়ি জমানো । বলতে গেলে আমার যে একটি ঘর আছে, পরিবার আছে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম এক সময়। তারপর প্রচন্ড আলসার বাধিঁয়ে মাস তিনেক বিছানায়, তারপর এই চাকরি নামক জেলখানা।
মাঝে মাঝে এ বন্দীশালার অত্যাচার চুড়ান্তে উঠে। তখন ভাবি পালিয়ে যাই। পালিয়ে যাই এমন কোথাও যেখানে কেউ আমাকে কোন কিছুতে বাধ্য করতে পারবে না। হতে পারে সেটি ছোটবেলার লাটিম ঘুরানোর কোন খেলার মাঠ, অথবা কোন বিশাল নির্জন প্রান্তর যেখানে কোন শাসন কার্যকরহ য় না। সেখানে আমি থাকবো একাকী-একেবারে একলা-একলা।
প্রতিদিন ভাবি ছুটি নিয়ে নেব। ছুটি নিয়ে সোজা চলে যাব কল্পনার কোন দিকশূন্যপুরে, যেখানে বুকের গহীনে সুগন্ধ ফুলের মতো নিঃশব্দে জমিয়ে রাখা একান্ত স্বপ্নগুলোকে স্বাধীনভাবে ভাসিয়ে দেওয়া যাবে। একদিন সত্যি সত্যি সমস্ত দুরাশা আর বাস্তবতা ঠেলে এলোমেলো উদাসীন হাওয়ায় ছোট্ট এক স্বপ্নডিঙ্গীতে করে ভেসে পড়বো সেই স্বপ্নদ্বীপের উদ্দেশ্যে। কেউ আমাকে আর খুঁজে পাবে না, কেউ না।
এই যে আমি রোজ অফিসে যাই, রোজ রোজ আমি ছুটি নেব বলে; ছুটি নিয়ে কয়েকদিন ইচ্ছে মতো মেঝেতে গড়াবো। আজকাল রোজ পকেটের মধ্যে দু’টি মার্বেল নিয়ে অফিসে যাই ছুটি নেব বলে। ছুটি নেব, আর বাসায় ফিরবো না। সোজা চলে যাবো কোন খেলার মাঠে, ঠিক যেমন শৈশবে স্কুল থেকে সরাসরি মাঠে পালাতাম।
প্রতিদিন সকালে এইসব ভেবে ভেবে আমার অফিসে যেতে দেরী হয়ে যায় । আর দেরী করা উচিত নয় ভাবি; যেতে যেতে অফিসে না পৌঁছতেই মনে মনে ছুটি নিয়ে নিই, চলে যাই পরিচিত এই গন্ডী ছেড়ে .......
জানি, আমার অনুপস্থিতিতে অফিসের অনেক কাজ চেয়ার উল্টিয়ে পড়ে থাকবে, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চোখ রাগানি আমাকে আর বাধ্য করতে পারবে না অতি ঝামেলাপূর্ন এসব কাজে আকন্ঠ ডুবে থাকতে। অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। বড্ড অন্যরকম; বড্ড কঠিন। আমার এ তথাকথিত অন্যায় ভাবনা মেনে নেবে না ঘরে বাইরের কেউ-ই।
কতদিন তাই ভেবেছি, আহা ! আমার যদি একটি পা ভাঙতো ! বেশ ভালোমতো ফ্রেকচার। তাহলে বেশ ন্যায়-সংগত ভাবে, নিজস্ব দাবিতে টানা অনেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকার অধিকার পেতাম। কেউ আমাকে বলতে পারতো না, এই এতবেলা ঘুমাচ্ছিস কেন? উঠ, এটা কর,এটা করে দে; এই তো অফিসের সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে-অফিসে যা.......
সময় কাটাবার জন্য, আড্ডা দেবার জন্য সঙ্গী খুঁজতে হতো না। অনেকগুলো শীর্ষেন্দু আর সুনীল কেনা হয়েছে আজ কতদিন ! সব পড়া হয়ে যেত। পড়তে পড়তে চোখ ব্যথা করলে মনে মনে আকাশ পাতাল তছনছ করতাম; তা-ও কি কম উপভোগ্য?
কতদিন-ক-ত-দি-ন ভেবেছি, আহা! সত্যিকার ভাবে যদি সম্পূর্ন একটি মাস ছুটি মিলতো !! এসব আকাশ পাতাল ভাবতেই পোড়া হলুদেও মতো এক বর্ণময় বিকেলে অফিস ছুটি হয়ে গেল। অন্যদিন প্রচন্ড ক্লান্ত আমি এতটুকু বিশ্রামের আকাঙ্খায় পড়িমড়ি ঘরমুখো হই। কিন্তু আজ বন্দরের ফুটপাত ধরে এমনভাবে হাঁটা শুরু করলাম যেন হাঁটতে হাঁটতে বিশাল এই সমুদ্র শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবো.......
বিকেলের বিলীয়মান আলোয় ফুটপাতের দু’ধার ধরে ঘরমুখো অসংখ্য মানুষ। অথচ মানুষের এই মিছিলের মাঝেও নিজেকে প্রচন্ড একা মনে হলো, ভীষন রকমের একা। গহন একাকীত্ব বোধ হঠাৎই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল জীবনের সবচে’ দুঃসহ স্মৃতির মাঝে .........
একদিন জীবনের সমস্ত একাকীত্বেও অবসান ঘটাতে আমি তাকে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সেই নতমুখী আমার জীবনের সমস্ত বিমর্ষতা মুছে দেবে, ভালোবাসবে আমাকে। পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট বুকে নিয়ে আমি তাই তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম; ভাষাহীন, নির্বাক পাথর হয়ে। প্রপাতের মতো হৃদয় নেমেছিল ধারক সন্ধানে। শেষদিন আমি তার চোখ দেখেছিলাম, তাতে অন্য দূর প্রতীখ্া, উদ্বিগ্নতায় পরিপূর্ন। দু’জনের কারো মুখেই কোনো কথা ছিল না। শুধু কোন অলৌকিক খেয়ালে দুরন্ত চোখ গুলো যেন বার বার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল ভারি কৃশ, কৃপন একটি আকাশকে। ভালোবাসার দায় ঘুচে গিয়েছিল সেদিন আমার। তবু কি আশ্চর্য, আজও কোন কোন রাত্রে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠে তার মুখখানি, স্পর্শ ছাড়াই আজো আমি বলে দিতে পারি তার কপালের কোন জায়গাটা ইসৎ ঢালু, ধনুকের মতো ভ্রু কতাটা ঘন, চোখের পাতার আড়ালে যে দুটো দীঘি তা কতটা গভীর, নাকের পাটায় কাঁপা কাঁপা ছোট্ট ফুল, টিপে থাকা ঠোঁট কতটা রক্ত গোলাপ আর চিবুকের পাশে যে ছোট্ট টোল পড়ে ঠোঁট খুললেই, সেখানে আমি আমার সারাজীবনের ব্যর্থতার ক’ফোটা চোখের জল অনায়াসে রেখে দিতে পারি ........
সব- সমস্ত কিছুই বুকের ভেতর জমাট হয়ে থমকে আছে। আজো অবাক হয়ে ভাবি শুধু এই একজনের অভাবেই পৃথিবী কেমন শূন্য হয়ে যায়। সে হীন এ বিশাল সমুদ্র শহর যেন জনশূন্যে হয়ে পড়ে, রাস্তা গুলো ফাঁকা। রোজ বিকেলে সামনে মাঠের সবুজ ঘাসগুলো শুধু দুলে দুলে শূন্যতার কথা বলে হাওয়ার সঙ্গে। যে পথে রোজ সে কলেজে যেতো, গড়ানে দুপুর ছুঁয়ে সে পথটাও আজকাল কী ভীষণ একলা পরে থাকে।
ক্রমশঃ মেঘ জমে, মেঘ জমে যায় বুকের ভেতর। হতাশা আর আত্মগ্লানির মাঝখানে আমার চারপাশে নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্জনতা। সেই কষ্ট আর আদ্রতার চাপ সামলাতে ঝাপসা দু’চোখ দিয়ে মাথার উপরে তাকাই। কী বিশাল শঙ্খনীল আকাশ।
যেদিন আমি মরে যাব সেদিন যেন আকাশ এমন নীল থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:৩৪