আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাললাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর ওয়ালিলল্লাহিল হামদ।
সামুর-এর সকল ব্লগার, পাঠক, লেখক, শুভানুদ্ধায়ী, মডারেটর, পৃষ্টপোষক সহ সকলকে জানাচ্ছি ঈদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।
কোরবানী, কোরবানী সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীসঃ-
‘কোরবানী’ শব্দটি আরবী ‘কুরব’ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আত্মোৎসর্গ করাই কোরবানী। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর নামে পশু জবেহ করাকে কোরবানী বলে। ঈদ-ঊল-আযহা উপলক্ষে জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই বা কোরবানী করা হয়।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন,
*‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত ৩৪)
*‘আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না।’ তাঁদের একজন বললেন, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবই।’ অপরজন বললেন, ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭)
* ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের (কোরবানির) গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত ৩৭)
* রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।’ (ইবনে মাজা, তিরমিজি)
হজরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের শেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুসারীরা মহান আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টি লাভের আশায় কোরবানী করেছেন।
আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে ইতিহাসে প্রথম কোরবানীর সূত্রপাত হয়।
এরই ধারাবহিকতায় হজরত নূহ (আঃ), হজরত ইয়াকুব (আঃ) ও হজরত মুসা (আঃ)-এর সময়ও কোরবানীর প্রচলন ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানীর আদেশ লাভ করেন, পর পর তিনি তিন দিন দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কোরবানি করেন।কিন্তু তাঁর কোরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল হলনা। স্বপ্নযোগে তিনি আবার আদেশ প্রাপ্ত হলেন, "তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো" আবশেষে তিনি নিজের ভুল বুঝে বুঝতে পারলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আঃ)। শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য উৎসর্গ করলেন। আল্লাহর রাস্তায় শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আঃ)-কে কোরবানী করার মাধ্যমে মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। শিশু হজরত ইসমাইল (আঃ) নির্দ্বিধায় আল্লাহর আদেশে সম্মত আত্মত্যাগের বিরল ও বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা। তাই পিতার ধারালো ছুরি শিশুপুত্রের একটি পশমও কাটতে পারেনি; পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টাপ্রেমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানী। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পশু কোরবানী করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল তথা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর পবিত্র হজের পরে ঈদুল আজহা ফিরে আসে, যার প্রধান আকর্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কোরবানি। ঈদের দিন কোরবানীকে কেন্দ্র করে ধুমধামের সঙ্গে চলে মনের পশুপ্রবৃত্তি ত্যাগের মহোৎসব।
কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ এতিমখানা বা গরিব-মিসকিনদের দান করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, দীন-দুঃখীরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে এবং দান-সাদকা করতে হবে। হালাল উপার্জন, তাকওয়া ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত।
ঈদুল আযহা শিক্ষা দেয় আল্লাহপ্রেমে তাকওয়া ও মনের একাগ্রতা নিয়ে কোরবানী করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ঈদুল আজহা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উৎসর্গ করা। তাই উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা প্রভৃতি গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও কোরবানির পশুর মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
আসুন কোরবানী থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়ে গবীব-দুঃখীকে সঙ্গে নিয়ে সবাই মিলেমিশে ঈদের এই আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেই। সবার সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন কামনা করছি সেই সঙ্গে সবার জন্য রইল প্রাণঢাল শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। ঈদ মোবারক।