চলুন ঘুরে আসি বুয়েট থেকে ১৯৯৭ থেকে ২০০৩। হ্যা, এই ৬ বছর আমি কাটিয়েছি বুয়েটে ৪ বছরের কোর্স শেষ করতে। আবার মনে করবেন না যে আমি কোন সেমিস্টারে ফেল করেছি। তখন বুয়েটে ৬ বছর লাগাটাই ছিল নরমাল।
নিচের ঘটনাগুলি আমার চোখের সামনে হয়েছে। তবে দিন-তারিখ ঠিক করে বলতে পারব না।
দৃশ্য একঃ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র-ফ্রন্টের একটা মিছিল শুরু হল বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে। হাতে গোনা ১০-১৫ জন কর্মী হবে। তারা ছাত্রদেরই কোন একটা শিক্ষা বিষয়ক (আমার মনে নেই, সম্ভবত, কোন ফি বাড়ানোর বিষয় নিয়ে) দাবি নিয়ে, কোন দলীয় বিষয় নয়, ওই মিছিলটা শুরু করেছিল। ছেলে গুলি মাত্র ২-৩ বার শ্লোগান দিতে পেড়েছিল। সাথে সাথে ছাত্রদলের ছেলেরা তাদের ঘিরে ধরল, আর শুরু করল বেদম ঘুষি, চড়, লাত্থি, ইত্যাদি। মুহুর্তের মধ্যেই বেশির ভাগই রক্তাক্ত হল, তাদের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগল। ফ্রন্টের কর্মীরা নিরীহ ছিল, তারা কোন প্রতিরোধের চেষ্টা করল না, হয়ত করলেও বাচতে পারত না। চারিদিকে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী দাড়িয়ে দেখল, আমিও তাদের মধ্যে একজন। কাউকে দেখলাম না প্রতিবাদ করতে। শুধু দেখলাম, আর মনের মধ্যে কষ্ট পেলাম। আমি যদিও ছাত্রফ্রন্ট বা কোন রাজনীতি করি না, তবুও তাদের উপর এমন হামলা মন থেকে মেনে নিতে পারি নি। কি ছিল তাদের অপরাধ?
চিত্রঃ বুয়েট ক্যাফেটেরিয়া
দৃশ্য দুইঃ আমরা ডেল ক্যাফেটোরিয়াতে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছি আর সেসনালের রিপোর্ট লিখছি। হঠাৎ দেখি, কাফেটোরিয়া চত্তর এবং মুল কাফেটোরিয়ার সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী ভয়ে এদিক-সেদিক ছোটা-ছুটী আর চিৎকার করছে। কেউ কেউ কাফেটোরিয়ার পেছনের দেয়ালের উপর থাকা কাটা তারের বেড়াও ঝুকি নিয়ে পার হচ্ছে। আমরাও যখন ডেল ক্যাফে থেকে বের হলাম, দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে ২ টা ছেলে হাতে পিস্তল উচিয়ে ক্যাফের দিকে ছুটছে। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমিও ক্যাফের পিছন দিকে ছুটলাম। কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে গেল। সন্ত্রাসী ২ টা চলে গেছে বুয়েটের গেট দিয়ে। ওরা ভেবেছিল, ক্যাফের ভেতর দিয়ে বের হওয়ার রাস্তা আছে, তাই এদিকে ছুটেছিল। তারপর আস্তে আস্তে যখন বের হচ্ছিলাম ক্যাফে থেকে, তখনই শুনলাম কেউ একজন খুন হয়েছে। লাইব্রেরীর পাশের মাঠে, যেখানে আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতাম, আর বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম, সেখানে গিয়ে দেখি তাজা রক্ত পড়ে আছে। গরু জবাই করলে যেমন রক্ত হয়, তার মত তাজা রক্ত, ফেনা হয়ে আছে রক্তের উপর। কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। তারপর থেকে ওখানে আর বসিনি। শুনেছি, যে খুন হয়েছে, সে ছিল বহিরাগত। কোন একটা টেন্ডারের (বুয়েটের) ভাগাভাগি নিয়ে বহিরাগতরাই তাকে খুন করেছে। বুয়েটের ছাত্রদের মধ্যে কেউ না কেউ তাদের সাথে জড়িত ছিল, নইলে এমন ঘটনা বুয়েটে ঘটার কথা নয়।
দৃশ্য তিনঃ ৮ ই জুন, ২০০২। বিশকাপ ফুটবলের জন্য ছুটি চেয়ে ছেলেরা গেটে তালা দিয়েছে, ক্লাস করবে না। ওই দিন কোন ক্লাস হয় নি। ছাত্ররা যে যার মত আড্ডা দিচ্ছে, কেউ কেউ বাসায় চলে গেছে। আমার কয়েকজন মিলে আমাদের ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরীতে বসে পড়ছিলাম। আনুমানিক, ১১-১২ টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির আর বোমাবাজির শব্দ। আমরা প্রথমে আতশবাজি ভেবেছিলাম। লাইব্রেরীরিয়ানের নিষেধাজ্ঞা না মেনে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। দেখলাম, ২ টা ছেলে একবার বুয়েটের মেইন গেটের দিকে যাচ্ছে, আবার পেছনে যাচ্ছে। তাদের মদ্ধ্যে একজন বারবার তার জামার নিচ থেকে একটা লম্বামত বদুক বের করছে, গুলি করছে, আবার জামার নিচে ঢুকাচ্ছে। অন্য ছেলেটা কি নিয়ে গুলি করছিল দেখি নি। তারা গুলি করছিল তিতুমীর হলের দিকে। এরা ছিল ছাত্রদলের বহিরাগত (টগর গ্রুপ, ঢাকা ভার্সিটির) টেন্ডারবাজ। আর বুয়েটের মুকিত গ্রুপের ছাত্রদলের টেন্ডারবাজরা গুলী করছিল তিতুমীর হল থেকে। এদের এক পক্ষে কে শেল্টার দিত মীর্জা আব্বাস, আর আরেক পক্ষকে পিন্টু। এই রকম কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পর সব চুপচাপ। আর এর মধ্যেই ঘটে গেছে বুয়েটের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। ২ গ্রুপের ক্রস ফায়ারে নিহত হল বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন্নাহার সনি।
আমার মত অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী একবারই বুয়েট লাইফে মিছিলে গিয়েছিল। সেটা এই সনি মারা যাবার পর দিন। আমরা বুয়েট থেকে প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখানে বুয়েটের ছাত্র সংসদের তৎকালীন জি,এস, মিঃ হাসিব (ছাত্রদল থেকে নির্বাচিত) উপস্থিত ছিল এবং বক্তব্য দিল। কিন্তু, সে মুকিত-শরীফের নাম বলতে চাচ্ছিল না। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চাপের মুখে সে তখন মুকিত-শরিফের নাম উল্লেখ করে তাদের বিচার চাইল। এই জন্য তাকে একটু হলেও ধন্যবাদ দিতে হয়। সনি যেদিন মারা যায়, সেদিন রাত্রে সাধারণ ছাত্ররা মুকিত-শরীফের রুমে রুমে ভাংচুর করে, আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা কিভাবে যেন পালিয়ে যায়, আমার জানা নেই। এই ঘটনার পর ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় বুয়েটে। ধীরে ধীরে ছাত্রদল ও জনপ্রিয়তা হারিয়ে দুর্বল হয়ে পরে।
http://www.youtube.com/watch?v=c0tla-7w7as
চিত্রঃ সনি মেমরিয়াল
দৃশ্য চারঃ সনি হত্যার বিচার নিয়ে আন্দোলন চলছে। সনি হত্যা নিয়ে এই নিয়ে ২য় বা ৩য় বারের মত বুয়েট আবার গরম হয়ে উঠে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ছাত্ররাই প্রথম অনশন শুরু করেছিল। তারপর আস্তে আস্তে আন্দোলন কারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় অনেক অনশনকারীই ছাত্রই অসুস্থ হয়ে যায়, তাদেরকে স্যালাইন দিতে হয়। স্যালাইন দেয়া অবস্থাইয়ও তারা অনশন চালিয়ে যায়। এর মদ্ধ্যে ভিসির ইশারায় ছাত্রদল আর পুলিশ তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অনশনকারীরা প্রাণ ভয়ে স্যালাইন লাগানো অবস্থায়ই দৌড়াতে থাকে। অনেকেই আহত হয়। আমাদের একাডেমিক ভবনে দাঁড়িয়ে থেকেই তা দেখেছি। অনেকেই গ্রেফতার হয়, কেউ কেউ ভিসির কারণ দর্শানোর নোটিশ খায়।
দৃশ্য পাচঃ বুয়েটে ৯৬ ব্যাচের সিভিলের এক ভাইকে তার বান্ধবীর ক্লাস টেস্ট দিয়ে দেয়ার সময় হাতে নাতে ধরার পর বহিষ্কারের পর কিছু ছাত্র মিলে পি এল চলাকালীন সময়ে বুয়েটের ইতিহাসে কম্পিউটার ল্যাব সহ সবচেয়ে বড় ভাংচুর করেছিল। সেই সময় ২৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি সাধন করেছিল। এটার পেছনে কোন রাজনৈতিক যোগসুত্র ছিল কি না আমার জানা নেই, কারো জানা থাকলে বলবেন।
আমার মতামতঃবুয়েটে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী নুতন কিছু নয়। এটা আগে যেমন ছিল, এখন ও তেমন আছে। কোন পরিবর্তন নেই। এমন কি রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও এখন ও রাজনীতি চলছে। এই দুষ্ট চক্র ভাঙ্গা যে কত কঠিন, তা সবাই জানেন। আজকে আমরা যারা ‘কুত্তালীগ’ বলে ছাত্রলীগকে গালি দেই, তারাই পরের বার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ছাত্রদলের আসল চেহারা দেখে ‘কুত্তাদল’ গালি দিবেন। আসলে এরা সব ই এক, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুইটাই (মোটামুটি সকল ছাত্র সংগঠনই) সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজদের আস্তানা। সনি হত্যার বিচার ঠিক মত হয় নি। খুনী শরীফ ঠিক ই বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়। মুকিত (সাকা চৌধুরীর লোক) কে জামাই আদরে অন্য কোন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বার ঈশান কে মারপিটের ঘটনায় যে ২ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের মধ্যেও কারো কারো শাস্তি মৌকুফও হয়ে যেতে পারে।
ছাত্ররাজনীতি আমার ছাত্রদের নৈতিকতা ধবংসের মুলে। শিক্ষাংগন কে করছে যুদ্ধের ময়দান, নষ্ট করছে অমূল্য সময়। ১% ছাত্রের লোভ বাকি ৯৯% ছাত্রকে ভোগাচ্ছে। দলীয় লেজুর ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করলে কখনই শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ তৈরী হবে না। বারে বারে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আর আমরা কুত্তা লীগ, কুত্তা দল, কুত্তা শিবির আর কুত্তা সমাজ বলে গালি দিতে থাকব অনন্তকাল। শুধু অভিনেতা বদল হবে, কাহীনি একই থেকে যাবে।
আর এই যে ছোট হোক বড় হোক শাস্তি গুলি হয়, নুতন ছাত্ররা যখন আসবে তারা জানবেই না যে এই রকম শাস্তি তাদেরকেও পেতে হবে যদি তারা এমন অপরাধ করে। কিন্তু, এই যে সনি হত্যার প্রতিক্রীয়া, ঈশানের মারপিটের প্রতিক্রীয়া, নুতন ছাতরা জানবে ও না। আগে থেকে জানানো হলে কিছু টা কাজ হতে পারে। বুয়েট কর্তপক্ষের উচিত নুতন ছাত্রদের অরিএন্টেশনের সময় এই সব বিষয়ে জানানো।
বিঃ দ্রঃ লেখায় কেউ কোন তথ্য ভুল পেলে আমাকে জানাবেন, আমি সংশোধন করে দিব। আর কোন দলকে ছোট/বড় করার জন্য আমার এই পোস্ট নয়, আমার সামনে যা ঘটেছে তাই লিখলাম। আমাদের সময় ছাত্রলীগ শক্তিশালী ছিল না, তাই কোন কিছু হয়ত করতে পারে নি। তবে, শক্তি থাকলে যে করত তাতে কোন সন্দেহ নাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:৪২