পর্ব: ১
"অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পাহাড় দেখবো। ইচ্ছাটা কোন ভাবেই পুরন করতে পারছিলাম না। যখনি কোন পত্রিকায় কিংবা কোন ব্লগে বান্দরবান নিয়ে কোন লেখা পেতাম খুব মনযোগ দিয়ে পড়তাম আর ভাবতাম 'কবে যাব পাহাড়ে? আহারে... আহারে...'।"
বৃহঃ বার, ০৫/০২/০৯ ইং, রাত ১০টা, ইউনিক বাস কাউন্টার, সায়দাবাদ।
আমি ও আমার এক কাজিন মেহেদী উপস্তিত বাস কাউন্টারে। এখনো কেউ আসেনি। আমি সৌম্য ভাইকে ফোন দিলাম, সে বলল 'আমি পথেই আছি, কিছুক্ষনের মাঝেই চলে আসব'। আমাদের এই ট্রিপের সদশ্য সংখ্যা হচ্ছে মাত্র দশ জন। এই দশ জনের মাঝে আমার পরিচয় হয়েছে মাত্র চার জনের সৌম্য ভাই, মনা ভাই, ইস্তীয়াক ও যাকারিয়া, আর যাদের সাথে আমার কোন আলাপ বা পরিচয় নেই তারা হচ্ছে বকর ভাই, শরিফ, ও ত্রিভুজ। এদের সাথে আমার আগে দেখা বা আলাপ হয়নি। শুধু মাত্র ত্রিভুজের সাথে সামহুয়ারে ক-একবার কমেন্টস্ চালাচালি হয়েছিল। জানিনা এদের সাথে ঠিকমত মিশতে পারবো কিনা!
আমাকে বলা হয়েছিল বাস ছাড়বে রাত সাড়ে ১১ টায়। সময় আছে দেখে আমরা দুজনে বাস কাউন্টারের অপর পাশে এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এর মাঝেই সৌম্য ভাই বাস কাউন্টারে এসে আমাকে ফোন করে জানতে চাইল আমরা কোথায় আছি? আমি জানিয়ে দিলাম আমরা বাস কাউন্টারের সামনে এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাচ্ছি।
খাবার শেষ করে কাউন্টারে ফিরে এলাম। এসে দেখি সৌম্য ভাই, ইস্তি (সৌম্য ভাই ওকে সিপ্পি বলে ডাকে), জাকারিয়া ও আর একজন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ীয়ে আছে। আমাদের দেখে তারা এগিয়ে এল। সৌম্য ভাই পরিচয় করিয়ে দিল ও হচ্ছে শরিফ। আমি আমার কাজিনকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তাদের সাথে আমরা কুশল বিনিময় করলাম। এর মাঝেই জানতে পারলাম আমাদের বাস রাত বারটায়। এর পর একে একে ত্রিভুজ ও বকর ভাই চলে এল। সৌম্য ভাই এদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সৌম্য ভাই জানালেন প্রথম আলোর ব্লগার রাকিব ভাই আমাদের বাসের টিকেট না পেয়ে রাত সাড়ে দশটার বাসে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে চলে গেছেন। আর মনা ভাই আমাদের দু'দিন আগেই রাতুল ভাইদের নিয়ে এক ট্রিপে থানচি চলে গেছেন। তিনি আমাদের সাথে আগামীকাল দুপুরে বলীপাড়া বাজারে মিট করবেন। তারপর তার নেত্রীতে আমরা বলীপাড়া বাজার থেকে পায়ে হেটে কেক্রাড়াডং এর উদ্দের্শ্য রওনা দেব। মাঝখানে আমরা প্রথম রাত কাটাবো উপজাতীয় এক পাড়ায় এবং দ্বিতীয় রাত কাটাব বগালেক এবং এর পর আমরা চলে যাব কেউক্রাড়াডং জয় করার জন্য।
বাস আসতে দেরি করছে। সৌম্য ভাই বাস কাউন্টারের সামনে আমাদের কিছু ছবি তোললেন। ছবি তোলা শেষে আমরা কাউন্টারের ভিতরে গিয়ে একটা জমপেষ আড্ডা দিলাম। এভাবেই সময় পার হতে হতে আমাদের বাস এল রাত বারটা বিশ মিনিটে। আমরা বাসের লাগেজে আমাদের ব্যাগ-প্যাক রেখে টুকেন নিয়ে বাসের সিটে গিয়ে বসলাম। বাস ছাড়ল সাড়ে বারটায়। আমরা বাসে আবার আড্ডায় মেতে উঠলাম...
এভাবে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই। মাঝ রাতে বাস থামল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এক রেস্টুরেন্টে। যে যার মত নিন্ম চাপ কমিয়ে নিলাম। আমরা এখানে পরোটা-শবব্জী খেলাম। বাস আবার চলতে শুরু করল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা চট্টগ্রামের জি. ই. ছি. মোড়ে নেমে গেলাম। সৌম্য ভাই রাকিব ভাকে ফোন দিল সে জানাল তার বাস মাঝ পথে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই তার আসতে একটু দেরি হচ্ছে। বকর ভাই, মেহেদী ও ত্রিভুজ নামাজ পড়ার জন্য চলে গেল। আমরা রাকিব ভাইয়ের জন্য অপেক্ষাই রইলাম। এর মাঝে সৌম্য ভাই চট্টগ্রামের বেশ কটা ইস্পটের কথা বললেন। তার প্রিয় একটি স্পট হচ্ছে এসি টয়লেট। ওনি যে কয়বার এখানে এসেছেন সেকবার ওখানে বসে ...করেছেন ও একটু ঘুমিয়ে নিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এসি টয়লেট টি আজ আর নেই ।
আমাদের দলের নামাজীরা নামাজ পরে চলে এসেছেন। এর কিছু পরে রাকিব ভাইয়ের ফোন; তিনি চলে এসেছেন। সৌম্য ভাই তার ব্যাগ থেকে সকল খাবার আমাদের সকলের ব্যাগে ভরে দিলেন। আর এবার আমার ব্যাগের সাইজ ও উজন ছোট খাট একটা চালের বস্তার মতো হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম আমার খবর আছে।
আমরা সবাই একসাথে লোকাল বাসে করে চট্টগ্রামের বদ্দার হাটের বাস টার্মিনালে এসে নামলাম। এখানে ত্রিভুজ আমাদের কিছু ছবি তোললেন। এখানে আধ ঘন্টা পর পর বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এখানেও আমরা প্রথম বাসটি মিস্ করলাম। সুরুভি নামের বাসের টিকেট কেটে আমরা বাসের আসনে গিয়ে বসলাম। হাতে এখনো অনেক সময় আছে দেখে আমি পাশের পাবলিক টয়লেটে গিয়ে একটু হালকা হয়ে এলাম। নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছেড়ে দিল।
আমরা ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই বান্দরবান এসে পৌছলাম। বাস থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে আমরা চলে এলাম চাঁন্দের গাড়ির স্টান্ডে। কিন্তু রিক্সাওআলা আমাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। রিক্সা আবার ঘুরিয়ে সঠিক স্টান্ডে এলাম। অভাগা যে পথে তাকায় সাগর সুকিয়ে যায়! আমরা চান্দের গাড়ি পেলাম না। রাজার কি এক উনুষ্ঠানে এলাকার কারবারি, গ্রাম প্রধান এরা সকল গাড়ি নিয়ে গেছে। আমাদের এমনিতেই অনেক দেরি হয়েগেছে তাই আমরা চাঁন্দের গাড়ীর অপেক্ষা না করেই বাসে করেই রওনা দিলাম বলিপাড়ার উদ্দেশ্যে।
আমরা সকলেই ছিলাম বাসের সামনের দিকে। চারিদিকের প্রকৃতিক দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল সাথে অন্যদেরও। চারিদিকের উঁচু উঁচু পাহাড়, নীল আকাশ, দূরে পাহাড়ের গাঁ ঘেঁসে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর যখনি নিচের দিকে তাকাই তখনি দেখি আমাদের গাড়ির রাস্তার গাঁ বেয়েই ডালু পাহাড় নেমে গেছে হাজার খানেক ফুট নিচে। বান্দরবান টু রুমার রাস্তাটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। এই রাস্তাটা যেমনি সুন্দর, তেমনি ভয়ানক। কখনো ডানে কখনো বা বায়ে মোড় আবার কখনো আকাশের পথে কখনো বা পাতালের পথে। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা সবাই একটি রুলার কুস্টারে বসে আছি। একটু এদিক সেদিক হলেই সোজা নিচে এবং তার পর সোজা উপরে চলেযেতে হবে। সৌম্য ভাই জানালেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের দলেরা এই অসাধারন সুন্দর রাস্তাটি তৈরি করেছেন। সী লেভেল থেকে এর উচ্চতা প্রায় আড়াই হাজার ফিট উপরে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উপরের হাইওয়ে। এর নাম দেয়া হয়েছে 'পিক ৫৯'। এভাবেই কখন যে আমরা চিম্বুকের বুকে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।
আমাদের বাস দশ মিনিটের জন্য চিম্বুকের টান করা বুকের ওয়াই জাংসনে এসে থামল। এখানে বিডিয়ারের একটি ছোট রেস্টুরেট (ছোট দোকান) আছে। আমরা এখানে নেমে দূরে পাহাড়ের কিছু ছবি তোললাম। সৌম্য ভাই ও রাকিব ভাই এখান থেকে সিংঙ্গাড়া ও বয়েল করা কিছু ডিম কিনে নিলেন। এখানে আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম- বিডিয়ারদের রেস্টুরেন্টে দুই টাকার ভংতির পরিবর্তে ওরা কাস্টমারের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিচ্ছে। এই বিষয়টা আমার কাছে এক প্রকার প্রতারনা মনে হল। যাইহোক আমাদের বাস আবার চলতে শুরু করল। আমরা বাসে বসে সিংঙ্গাড়া ও ডিম সাবার করে দিলাম। এরি মাঝে আমাদের জাকারিয়া ছোট্ট ছোট্ট গ্যাস বোমা ফাটাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল আমরা যেন এক ডার্ষ্ট বিনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই আমরা দুপুরের দিকে বলিপাড়া এসে পৌছলাম। আমরা বাস থেকে নামতেই বিকট জোরে শব্দ হল। না এবার আর আমাদের জাকারিয়া নয়, বাসের চাকা পাংচার হয়েছে তাই এতো জোরে শব্দ। আমি মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই এই বলে আমাদের এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে, যদি চাকা আরো আগে পাংচার হতো তবে আমাদের আরো অনেক লেট হতো। আর এদিকে সকাল নয়টার ভেতর মনা ভাইয়ের বলিপাড়া বাজারে এসে আমাদের অপেক্ষায় থাকার কথা।
আমরা বাজারে এসে একটি দোকানে আমাদের ব্যাগ প্যাক রেখে মনা ভাইকে খুজতে লাগলাম। আমরা কেউ তাকে খুজে পেলাম না। আর এটি কথা এখানে মোবাইলের কোন নেটউয়ার্ক নেই। কিছু এন্টেনা লাগিয়ে ওয়্যারলেস ল্যান্ড ফোন ব্যাবহার করছে। সৌম্য ভাইয়ের ধারনা ছিল মনা ভাই যে ল্যান্ড ফোন থেকে যোগাযোগ করেছিল সেটা এই বাজারের কোন নাম্বান। তাই সেই নাম্বারে ফোন দেয়া হল। কিন্তু জানা গেল এই নাম্বারটি বলিপাড়ার নয় এটি হচ্ছে রুমা বাজারের। কি আর করা এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই। তাই আমাদের দলের নামাজিরা পাসের এক সমজিদে চলে গেল জুম্মার নামাজ আদায় করতে। এই ফাকে আমরা বাকিরা বাজারটা ঘুরে দেখছিলাম। বাজার ঘুরে আমরা একটা ছোট হোটেলে (রেষ্টুরেন্ট!) ডুকে পড়লাম। এখানে আমরা সিংঙ্গারা, জিলাপি ও বিক্ষাত রস পুরি খেয়ে নিলাম। খেতে খেতে রুমা বাজার থেকে একটি জীপ আসল এখানে আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম দেখতে মনা ভাই এসেছে কিনা। কিন্তু না এই জীপে মনা ভাই নেই। এর কিছু সময় পরে নামাজিরা নামাজ পরে আসল। এবার সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম; আমরা এখন দুপুরের খাবার খাব এবং এর মাঝে যদি মনা ভাই না আসে তবে আমরা রুমার দিকে রওনা দিব।
ঐ হোটেলেই ভাত খেলাম। যদিও খাবারের মান তেমন (মোটেই) ভাল ছিল না। কি আর করা এখানেত আর কউ হাজীর বিরীয়ানী নিয়ে বসে নেই। যা ছিল তাই খেলাম। ভাত শেষে চা-র অর্ডার দেওয়া হল। চা খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এটা কি আসলে চা! নাকি অন্য কিছু?
চা পর্ব শেষ করে উঠার সময় আরেকটা জীপ এল বাজারে। আমরা হোটেলের বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। মনা ভাই এবার এসেছে কিনা দেখার জন্য কয়েক দোকান আমরা সকলেই ডু মারলাম। সামনের ফোনের দোকানে আমরা মনা ভাইকে পেয়ে গেলাম সাথে ছিল আরেক ক্রেজি ট্রেকার রাতুল ভাই। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে নিলাম। রাতুল ভাই আজি ঢাকা ফিরে যাবেন তাই রাতুল ভাইকে বিদায় দিয়ে মনা ভাই তরি-ঘরি করে খেয়ে নিলেন। এর পর তিনি আমাদের প্রোগ্রামটা ভালকরে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা প্রথমে বলীপাড়া থেকে বগা লেক যাব। মাঝে আমরা চ্যামা খালের পরে কোন আদিবাসীদের পাড়ায় রাত্রী যাপন করব। এর পরের দিন আমরা খুব ভোরে উঠে বগা লেকের উদ্দেশ্যে রউনা দিব। এর পর বগালেক থেকে চলে যাব স্বপ্নের কেক্রাড়াডং এর চুড়ায়।
ঘড়িতে সময় দুইটার উপরে। মনা ভাই কয়েক জন আদীবাসি কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল আমাদের পথের দিক নির্দেশ। আমরা দশ জন পা বাড়ালাম আমাদের আপন গন্তব্যে। পাহাড়ে খুব দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে তাই আমাদেরও দ্রুত পা চালাতে হবে। তবে আধার নেমে এলেও আকাশে চাঁদ উঠে আসবে আমাদের সংঙ্গী হতে। যাইহোক আমরা যে ট্রেইল ধরে হাটছি তার শুরুর দিকেই পার হতে হল সাঙ্গু নদী। পানি আনেক কমে গেছে। আমি নদীর দুই পারে দেখলাম বর্ষায় এই নদীর পানি কত উপরে উঠতে পারে। আমার মনে হল বর্ষা নদীর পানি প্রায় ২৫-৩০ ফিট উপরে উঠে আসে। আমরা এই নদী পার হলাম ছোট্ট লম্বা এক কাঠের (এক গাছের) নৌকা দিয়ে।
বলিপাড়ায় রুপসী সাঙ্গুর কোলে বিচিত্র ক্যানু সদৃশ্য নৌকায়
নৌকায় মনা ভায়ের সাথে আলাপ হল সুভাষ ত্রিপুরা নামের এক ভদ্র লোকের সাথে। তিনি এক স্কুল টিচার। তার কথা শুনে মনে হল তিনিও আমাদের সাথে কিছু পথ এগুবেন। এর পর নদীর পাড় ধরে বেশ কিছু পথ যাবার পর আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলাম। খুব বেশি উপরে উঠতে হইনি আমাদের কিন্তু আমার ব্যাগ এর কারনে আমার অবস্থা কাহিল। শরীল ঘেমে গেছে, নাক ও মুখ দিয়ে সমানে জোরে জোরে নিঃশ্বাস পরছে। আর মনে মনে বলছিলাম
"আল্লাহ্ বাঁচাও আমারে, সৌম্য মিয়ার পোস্ট পইড়াতো লাফাইতে লাফাইতে চইলা আইলাম, এখনতো রস পড়ে।"আশেপাশের পরিবেশটা সুন্দর ছিল, তাই মনে জোর পেলাম। ছোট ছোট টিলা, জুম ক্ষেত, পাহাড়ের পাশ দিয়ে একে বেকে বয়ে চল সাঙ্গু। কিছুদূর আসার পার আমরা সবাই ছোট বাশের লাঠি নিলাম, শুধু মনা ভাই বাদে। জুম ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হাটার সময় আমার দৃষ্টি আটকে গেল তিন ইঞ্জি ছোট্ট একটি ফুল গাছের উপর।
পাহাড়ী ফুল আমি নাম কি জাননা ০১
আমরা একে একে বেশ কয়েকটা ছোট বড় পাহাড় ও পাড়া পেছনে ফেলে অনেকটা পথ চলে এসেছি। এবার আমরা নিবেদিতা কুমারী মারিয়ার ধর্ম পল্লীর সমনে এসে দাড়ালাম। মনা ভাই এদিক সেদিক তাকিয়ে খুজতে লাগলেন কজন গাইড, যিনি আমাদের পৌছে দেবে চ্যামা খাল। আমরা আজ রাতেই চ্যামা খাল পেরিয়ে যেতে চাই শুনে সুভাষ দা আমাদের বললেন আপনাদের আজ চ্যামা খাল পৌছতে আনেক রাত হয়ে যাবে। আর গভীর রাতে বনের ভিতর দিয়ে চলাফেরা করাটা নিরাপদ হবেনা। আপনারা চ্যামা খাল না গিয়ে মুঙ্গোহা পাড়া নামে ত্রিপুরাদের একটি গ্রাম আছে, ওখানে আমার শশুর বাড়ীতে রাত কাটাতে পারেন। আমরা সবাই রাজী হয়েগেলাম।
কুমারী মারিয়ার ধর্ম পল্লী পার হয়েই আমাদের এক বিশাল ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে হল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে মনে বলছিলাম
[si]"আজ আর যাবার দরকার নাই। আজ রাতটা এই জঙ্গলেই কাটাইয়াদেই"।এসব ভাবতে ভাবতে আমি অনেক পিছনে পরে রইলাম। আছতে আছতে যখন উপরে এলাম দেখি সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি মনে মনে আনন্দ পেলাম এই ভেবে যে, যাক এবার একটু বসে বিশ্রাম নেয়া যাবে।
(ছবিঃ সৌম্য ভাই)
একি আমাকে দেখে সবাই উঠে হাটা শুরু করল। মনা ভাই বলল সবাই উঠেন, অন্ধকারে পাহাড়ে হাটা কষ্টকর হয়ে যাবে। মনা ভাই আমাকে বিশ্রাম নিতে দিলনা। মনা ভাইয়ের উপর খুব রাগ হল, কিছু সময় তাকে মনে মনে বকা ঝকা করলাম। কি আর করা, দলনেতা যখন আমরাই তাকেই বানিয়েছি কথাত শুনতেই হবে তাই বাধ্য হয়েই হাটতে লাগলাম। তবে এবারের পথটা একটু ভাল। আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেছে, ইস্ সব রাস্তা কেন এরকম হয়না?
অনেক দূরে ছোট একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে, গ্রামটা দেখতে সুন্দর লাগছিল। আমার মনে পরম শান্তি দূলা খেল। এই বুঝি সুভাষ দার শশুর বাড়ী। কিন্তু আমার সকল শান্তিকে অশান্ত করে সুভাষ দা জানালেন এটা ম্রো দের গ্রাম। এই গ্রামের নাম রামদু পাড়া। এই পাড়ায় প্রথমেই আমাদের স্বাগত জানাল পাড়ার এক নেতা ... ঘেউ.উ..উ...উ... ঘেউ...ঘেউ।পাড়ার কুকুরকে মনে হল আমাদের দেখে সে মহা বিরক্ত, শুধু ঘেউ... ঘেউ... করছে। ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের মহা উৎসাহ (নাকি কৌতুহল) নিয়ে দেখতে লাগল। আমার মনে হল এরা কোনদিন সমতলের বাঙালী দেখেনি।
এর মাঝে সূর্ষটা যাই যাই করে চিম্বুকের কোলে ঢলে পড়ল। আর অপর পাশ দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল এক ফালি রুপালী চাঁদ। মনে মনে ভাবছি কখন যে বন্য শুকুর আমাদের তারা করবে আর তখনি হবে আসল এডভেঞ্চার। আমরা সকলেই টর্চ বের করে আবার হাটতে লাগলাম। আধার এখনো আমাদের পিছু নেইনি। আমরা যে ট্রেইল ধরে হাটছি এটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পথটা এখনো দেখা যাচ্ছে। তাই আমি টর্চ জালাচ্ছিনা। কারন যে এলাকায় আমরা যাচ্ছি সেখানে বিদুৎ এর ব্যাবস্থা নেই। আর আমার টর্চটা ব্যাটারির না, চার্জ দিতে হয়। আসতে আসতে আমরা জংগলের অনেক ভিতরে চলে এসেছি। চাঁদের আলো এখন আর নিচে পরছেনা। টর্চ জালিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। এই অচেনা জঙ্গলে আমরা কয়েক জন পাগল ছারা আর কেউ নেই। পায়ের নিচে নুরি পাথর, ঝরা পাতার মড় মড় শব্দ আর অনেক দূরে হরিনের ডাক আর বন্য জন্তু যানুয়ারের ভয়।
আমরা এখন যে ট্রেইল ধরে হাটছি তার ডান পাশ ছিল খোলা। নিচে টর্চ ধরেই আঁতকে উঠলাম। টর্চের আলো নিচ পর্যন্ত যাচ্ছেনা। আর আমরা যে পথ ধরে হাটছি সেটা বড়জোর এক ফিটের মত ব্যাস হবে। পা একটু এদিক সেদিক হলেই....
এভাবেই আমরা হেটেছি ঘন্টা খানেক। এর পর আমাদের কাক্ষিৎ শশুর বাড়ী দেখা পেলাম সামনের কয়েক পাহারের পরের পাহাড়ের উপরে। শশুর বাড়ীটা মুঙ্গোহা পাড়ায় অবস্থিত। আমরা আস্তে আস্তে মুঙ্গোহা পাড়ায় চলে এলাম। সুভষ দা তার শশুর বাড়ীর লোকদের সাথে কথা বলে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। আমরা সবাই ব্যাক প্যাক রেখে কাপড় চেঞ্জ করে বিশ্রাম নিচ্ছি। আর এই ফাকে মনা ভাই আমাদের রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করছেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। যাকে আমি রাস্তায় মনে মনে বকেছি আর সেই কিনা বিশ্রামের কথা ভুলে আমাদের খাবারের ব্যাবস্থা করছে।
বাড়ীর বাসিন্দাদের জিগাস করলাম আপনারা পানি আনেন কোথাথেকে? তারা জানালো পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে হবে। উপরেই পানি আছে আপনারা এই পানিই ব্যাবহার করেন। আমরা তাও পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে চলে এলাম। মেহেদী ওজু করল, জাকারিয়া হাত মুখ ধৌওত করল। চারিদিক অন্ধকার, হালকা চাঁদের আলো। এর মাঝে আমি পানির পাইপের নিচে বসে পড়লাম। উয়াও! (ওরে বাবারে!) কি ঠান্ড। তিন কি চার মিনিট আমি পানির পাইপের নিচে ছিলাম। এরপর কাঁপতে কাঁপতে পানি থেকে উঠে এলাম। গোসল করে মনে হল শরীলের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে এক অনাবীল আনন্দ বিরাজ করছে। এর পর শরিফ গোসল সেরে নিল। আমরা আছতে আছতে উপরে উঠে এলাম।
মনা ভাই বাড়ীর উঠানে আমাদের জন্য নডুলছ রান্না করছে। তার চারপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও সেখানে সামিল হলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশে অনেক তারা। সৌম্য ভাই কাকে কাকে যেন আকাশের তারা দেখাচ্ছে। মাথার উপর আকাশটা এত বিশাল ও এত কাছে ছিল যে নির্দিধায় খুজে পেলাম বৃষ, প্রজাপতি, তিমি, মেষ, ত্রিভুজ আর কাল পুরুষতো চোখের সামনেই থাকে সবসময়। তারা দেখা বাদ দিয়ে মনা ভাইকে টর্চ জালিয়ে রান্নায় সাহায্য করলাম।
(ছবিঃ সৌম্য ভাই)
খাবার তৈরি হয়ে গেছে; এবার সাবার করার পালা। আমাদের যে রুমে থকতে দেওয়া হয়েছে তার এক পাশে আমরা আর এক পাশে বাড়ীর লোকজন। মনা ভাই ও বকর ভাই আমাদের মাঝে খাবার ডিস্ট্রিবিউসন করছেন। প্রথমে বাড়ীর লোকজনদের খেতে দিলেন এরপর আমাদের। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজ নিজ প্লেট ধুয়ে ফেলাম। আমাদের অ ব্যবহারিত পলি ব্যাগ একত্রিত করে পুরিয়ে ফেলা হল। এর পর বাড়ীর বাচ্চাদের হাতে চকলেট ও খেজুর দেয়া হল। এর পর মনা ভাই আগামী কালের প্ল্যান বুঝিয়ে দিলেন। এবার ঘুমানোর পালা... আমরা সকলেই মজা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম এক চমৎকার ভোরের আশায়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:৫৩