এর ভেতরে অফিসের নানা ব্যস্ততায় আর মুসা ইব্রাহীমের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হয়নি.. মাঝে মাঝে ব্লগারদের শেয়ার করা ফেসবুক লিঙ্ক থেকে কোন ব্লগের কোন পোস্টে এসে পড়ে চলে যাই। এর ভেতরে খাগড়াছড়িতে একটা ছোটখঅট ট্রেকিং করতে ভ্রমণ বাংলাদেশের সাথে রওনা হয়ে যাই। ভ্রমণ বাংলাদেশ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটা এডভেঞ্চার/মাউন্টেইনিং/ট্রেকিং/ভ্রমণ ক্লাব যাদের সাথে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অভিযানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। মীর শামসুল আলম বাবু ভাইয়ের সাথেও ওখানেই আমার প্রথম পরিচয়। বিভিন্ন অভিযানে রাতের বেলা ক্যাম্প-ফায়ারে বসে আমাদের যেসব গল্প হতো সেগুলোর বেশির ভাগই জুড়ে থাকতো এইসব মাউন্টেইনিং ও নানা দুঃসাহসী কাহিনী ও অভিযাত্রীদের কথা। সুতরাং খাগড়াছড়ি ট্রেকিং এ রওনা হওয়ার সময় বাবু ভাইকে ফোন দিলাম, মুসা ইব্রাহীম সত্যিই এভারেস্ট জয় করেছেন কিনা জানতে চেয়ে। বাবু ভাই এর উত্তর ছিলো, "কি মনে হয়?" তারপর জানালেন তিনি একটু ব্যস্ত আছেন এটা নিয়ে আমাদের পরে কথা হবে।
গত কয়েকদিন ধরে মুসা ইব্রাহীম এর এভারেস্ট জয় করা নিয়ে ব্লগ,ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইন কমিউনিটিতে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তার সূত্র ধরে কিছুক্ষন আগে বাবু ভাইকে আবার কল দিলাম। ঘন্টা খানেকের বেশি সময় ধরে বাবু ভাই নানা কথা বললেন। সেগুলো তুলে ধরার আগে মীর শামসুল আলম বাবু সম্পর্কে ব্লগারদের কিছু তথ্য জানা জরুরী।
বাংলাদেশে ট্রেকিং বা মাউন্টেইনিং বিষয়টা খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও জেনে অনেকে অবাক হবেন যে এই দেশেও প্রচুর ছেলে মেয়ে মাউন্টেইনিং এর উপরে প্রশিক্ষন কোর্স করে ফেলেছেন। এইচএমআই (HMI = Welcome to Himalayan Mountaineering Institute) ও এনআইএম (NIM = Nehru Institute of Mountaineering) থেকে এখন পর্যন্ত ৩৯ জন বাংলাদেশি প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হয়েছেন যারা নিজেদের সার্টিফাইড মাউন্টেইনার বলতে পারবেন। এদের ভেতর শুধুমাত্র একজন আছেন যিনি HMI থেকে মাউন্টেইনিং প্রশিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত। সাদা বাংলায় এদেশে মাউন্টেইনিং প্রশিক্ষন দেয়ার মত অফিসিয়াল স্বীকৃতি আছে শুধুমাত্র এক ব্যক্তির। এই ব্যক্তিই হচ্ছেন মীর শামসুল আলম বাবু। বাংলাদেশে মাউন্টেইনিং নিয়ে লেখা একমাত্র বইটাও মীর শামসুল আলম বাবুর লেখা। বাবু ভাইয়ের আরো অনেক গুন ও পরিচয় আছে যেগুলো দিয়ে লেখা বড় না করে মূল আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক।
ব্লগের সাম্প্রতিক কিছু পোস্টের প্রেক্ষিতে বাবু ভাইয়ের সাথে ঘন্টা ব্যপি আলোচনা থেকে যে তথ্যগুলো ওঠে এসেছে সেগুলো অনেকেই জানেন না বা জানার সুযোগ নাই বিধায় মুসা ইব্রাহীম এর এভারেস্ট জয় করা নিয়ে বিতর্কটা আরো জমজমাট হয়ে যাচ্ছে। আবার এই কথাও সত্য যে আমরা যারা মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় করা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ও যুক্তি তুলে ধরছি তারা কেউই কিন্তু মাউন্টেইনিং সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানি না। একই সাথে বাতাসে অনেক কথা ছড়ানো হয়েছে যেগুলোর কোন সত্যতা নেই, যেমন- পেপসির (ট্রান্সকম) অর্থায়নে পাঠানো মাউন্টেইনার মুহিত এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে মুহিত নাকি ঐ এলাকায় কাউকে জিজ্ঞেস করে মুসা ইব্রাহিম নামের কোন ব্যক্তির সন্ধান পাননি যিনি এভারেস্ট জয় করতে গিয়েছেন (এই কাজটি ইমেল মারফত প্রথম প্রচার করেন সজল খালেদ যার জন্য পরে তিনি ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। সজল খালেদের মেইলের অংশ বিশেষ মন্তব্য-২৩ এ পাওয়া যাবে।) বাবু ভাই জানালেন মুহিত দেশে ফিরে জানিয়েছে যে এরকম কিছু তিনি বলেন নাই। একই ভাবে অতীতের বিভিন্ন ঘটনার বিষয়েও ব্লগ ও ওয়েবে অনেক রঙ চড়ানো হয়েছে বলে বাবু ভাই জানালেন। অতীতের ঘটনা ছাড়াও এভারেস্ট জয় করার পর প্রথম আলোর অতিরিক্ত বাড়াবাড়িমূলক লেখাগুলো বিশেষ করে আনিসুল হকের বিভিন্ন লেখাও নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য এসেছে যেগুলো এই সন্দেহের দাবানলে জ্বালানী হিসেবে কাজ করছে। যেমন, এভারেস্টে চড়তে গিয়ে মুসা ইব্রাহীম লেডারের উপরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন যা আসলে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বাবু ভাই। এছাড়াও আরো বেশ কিছু সঙ্গতিহীন তথ্য তিনি প্রকাশ করেছেন যার একটি হচ্ছে ২০০৯ এ এভারেস্টে বুদ্ধমূর্তি স্থাপণ করা হয়। মাউন্টেইনিং সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা, মুসা ইব্রাহীম ফেরার আগেই পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে স্টোরি তৈরি করতে গিয়ে এবং কাহিনীতে একটু নাটকীয়তা আনতে গিয়ে হয়তো আনিসুল হক নিজের অজান্তেই এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ফেলেছেন যা মুসা ইব্রাহীমের কট্টর বিরোধী গোষ্ঠী চতুর ভাবে ব্যবহার করছে এবং করবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে প্রথম আলোর অতিরিক্ত বাড়াবাড়িও তাঁর জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মুসা ইব্রাহীম যখন এভারেস্ট জয় করতে যাচ্ছিলেন তখন ট্রান্সকমের (উল্লেখ্য, ট্রান্সকম, প্রথম আলো এবং ডেইলী স্টার এর মালিক এক ব্যক্তি) পক্ষ হতে পেপসির স্পন্সরে আরেকজনকে (মুহিত) এভারেস্ট জয় করার জন্য আলাদা ভাবে পাঠানোর আয়োজন করা হচ্ছিলো। বিএমটিসি'র এনাম আল হক'কে তখন আনিসুল হক (তিনি নর্থ আলপাইন ক্লাবের সভাপতি) অনুরোধ করেছিলেন যাতে মুসাকে মুহিত এর সাথে একসাথে পাঠানো হয়। সেসময় এভারেস্ট জয় করার মত টাকা মুসা ইব্রাহীমের ছিলো না অপর দিকে মুহিত এর জন্য ট্রান্সকম পেপসি থেকে স্পন্সর জোগাড় করে দেয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে মুসা ইব্রাহীমকে মুহিত এর সাথে পাঠাতে এনাম আল হক রাজী হননি বা এখানে আরো কিছু ফ্যাক্ট কাজ করতে পারে বলে বাবু ভাইয়ের ধারনা। যেমন, এনাম আল হক এর সাথে মুসা ইব্রাহীমের অতীত তিক্ততা বা ট্রান্সকম গ্রুপের অনাগ্রহ বা পেপসি এর অনুমোদন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে পেপসি ট্রান্সকম কতৃক মার্কেটিং হলেও এর মূল নিয়ন্ত্রকরা থাকেন ভারতে (দিল্লী)। এখন দিল্লী থেকেও বিষয়টি এপ্রুভ করার বিষয় জড়িত। তবে এটাও সত্য যে মুহিত এবং মুসা ইব্রাহীম পরস্পরের প্রতিযোগী হিসেবে এভারেস্ট জয়ে নেমেছিলেন এবং ট্রান্সকম গ্রুপ খুব করে চেয়েছিলো যাতে মুহিত জয়ী হতে পারে মতান্তরে প্রথম আলোর সবাই চেয়েছিলো মুসা আগে এভারেস্ট জয় করুক। (মন্তব্য- ২৩ দ্রস্টব্য)
এখানে আরো কিছু রাজনীতি আছে। যারা হালকা পাতলা ভাবেও এসব ক্লাবগুলোর সাথে জড়িত তারা সেসব রাজনীতির খবর রাখেন। আপাতত সে বিষয়ে বিস্তারিত না জানলেও এটা বোঝা যায় যে যে মুসা ইব্রাহীম বাঙালির চিরায়ত লবিং-গ্রুপি রাজনীতির শিকার। একই সাথে মুসা ইব্রাহীমেরও কিছু ভুল আছে... যেমন তিনি ফেসবুকে অচেনা অজানা বা অখ্যাত কোন ব্লগারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে উত্তেজিত হয়ে বা ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলেছেন (ফেসবুকের স্ক্রিন শর্টগুলোর বিষয়ে)। এ বিষয়ে বাবু ভাইয়ের মতামত হচ্ছে, চারিদিকে এত গ্রুপিং ও অতিরঞ্জিত তথ্যের আদান প্রদানে মুসা বিরক্ত হয়ে থাকতে পারে। এই বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে মুসা ইব্রাহীমের ফেসবুক একাউন্ট থেকে তার প্রিয়জন বা এরকম কেউ লগইন করে হয়তো রাগ সামলাতে না পেরে ওধরনের উত্তর দিয়েছেন। অথবা মুসা ইব্রাহীম নিজেও ওটা করে থাকতে পারেন, যদিও এধরনের কথা বলা তাঁর জন্য শোভন ছিলো না।
এভরেস্টের চূড়ায় বৌদ্ধমূর্তির সাথে মুসা ইব্রাহীমের ছবির বিষয়ে বাবু ভাইয়ের অভিমত হচ্ছে, "হয়তোবা মুসার ক্যামেরা কাজ করছিলো না.. বা ব্যাটারী শেষ হয়ে গিয়েছিলো.. বা যাকে ছবি তুলতে দিয়েছিলেন সে ঠিকঠাক মত ছবি তুলতে সক্ষম হননি"। এভারেস্টের মত খুব উঁচুতে আরোহন করার পর অনেকেই স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা ও কাজ করতে সক্ষম হন না। Altitude sickness বলে একটা বিষয় আছে যাকে AMS(acute mountain sickness), altitude illness, hypobaropathy বা soroche বলেও চিহৃত করা হয়। এই বিষয়ে আগ্রহীরা আরো জানতে গুগলের সাহায্য নিতে পারেন। এসব সমস্যার কারণে মাউন্টেইনাররা স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় Hallucination এ ভুগতে থাকে। ঐ অবস্থায় বুদ্ধ মূর্তির সামনে বসে খুব পোজ দিয়ে ছবি তোলার গুরুত্ব বা বিষয়টা ঠিকঠাক মত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। আর এভারেস্টের মাথায় বুদ্ধ মূর্তির সামনে ছবি-ই এভারেস্ট সামিটের একমাত্র বা খুব গুরুত্বপূর্ন প্রমাণ নয়। এভারেস্ট জয়ী হিলারীও এভারেস্টের মাথায় নিজের কোন ছবি তুলে আনেননি বা আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে কেউ তাঁর এভারেস্ট জয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। আর মুসা ইব্রাহীম কোন ছবি প্রকাশ করেননি এই দাবীও ঠিক না বলে বাবু ভাই জানালেন। তবে অনলাইনে বিভিন্ন লোকের অনুরোধে বা ব্লগার/কমিউনিটি সদস্যদের দাবীর মুখে মুসা ইব্রাহীম কিছু উপস্থাপণ করছেন না কেন জানতে চাইলে বাবু ভাই বললেন, হয়তো কোন একটা সমস্যা থাকতে পারে। সেটা স্পন্সর বিষয়ক হতে পারে বা ভুল কারো পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় মুসা ইব্রাহীম পরিচালিত হয়ে থাকতে পারে।
কেউ সত্যিকার অর্থেই জয় করে থাকলে অন্য আরো মাউন্টেইনারদের কাছে সেই বিবরণ বিশদ ভাবে তুলে ধরলে অভিযানের বিভিন্ন টেকনিক্যাল তথ্য (যেগুলো শুনে মাউন্টেইনাররা বুঝতে পারেন আসলেই সত্য বলছেন না বানানো গল্প) বিশ্লেষণ করে বাদবাকী মাউন্টেইনাররা নিশ্চিত হতে পারেন। তারপর তাদের বক্তব্যগুলো যথাযথ ভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা করা হলে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের বিষয়টি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক হালে পানি পাবে না বলে বাবু ভাই মনে করেন। এই বিষয়ে মুসা ইব্রাহীম ও দেশের নামকরা মাউন্টেইনারদের যৌথ ভূমিকার গ্রহণ করা উচিত।
যাই হোক, আমরা চাই জাতীয় এই অর্জন নিয়ে যেন আর কোন বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।
বিঃদ্রঃ মুসা ইব্রাহীম এর এভারেস্ট জয় নিয়ে বাবু ভাইয়ের একটা লেখা গত ৩০ মে, ২০১০ প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিলো। নানা জনের নানা কথায় কান না দিয়ে মাউন্টেইনারদের বক্তব্যগুলো আমাদের দেখা উচিত। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা কমলে আগমী ৩০ জুনের পর সাম্প্রতিক বিতর্ক ও মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় বিষয়ক আরেকটি লেখা বাবু ভাই দেয়ার চেস্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।