কোরান কি স্রষ্টা কতৃক পাঠানো কিতাব না মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে লিখেছে, সেটা নিয়ে ব্যপক আলোচনা হচ্ছে। আমাদের সহ ব্লগার 'যুঞ্চিক্ত' অনেক কষ্ট করে একটি গবেষনা(!) পত্র ছাপিয়েছেন উনার নিজের ব্লগে। হ্যা, সেই 'যুঞ্চিক্ত' এর কথাই বলছি, যাকে 'সৃষ্টিকর্তা নাই' প্রমাণ করে দিতে বলায় বলেছিলেন এরকম প্রশ্ন করার অধিকার নাকি আমার নাই। উনারই নাকি 'সৃষ্টিকর্তা আছে' প্রমান করে দাও টাইপ প্রশ্ন করার অধিকার আছে। যাই হোক, অনেক কষ্ট করে টাইপ করেছন, তাই খুব মন দিয়ে পড়লাম পুরো লেখাটা। একবার নয়, দুই দুইবার। দুইবার পড়ার কারন লেখক (যুঞ্চিক্ত) আসলে কতটা মোহমুক্ত, তা বুঝা। পড়লাম এবং বুঝলাম। কি সেটা বলতে যাব এমন সময় খেয়াল করলাম নীচে লেখা আছে, আরো পর্ব আসতে যাচ্ছে। তাই সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবো ভাবছিলাম। কিন্তু প্রথম পর্বেই এত ছেলে মানুষি কিছু যুক্তি দিয়েছেন এবং সবাই তা নিয়ে এত মেতে উঠেছে, যে চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাহলে শুরু করি-
--
লেখক অনেক খেটে খুটে তৈরি করেছেন লেখাটা কোন সন্দেহ নাই। সেই খাটা খাটনির প্রায় সবটুকুই খরচ করেছেন বিষয়টা 'সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী'দের মনে আঘাত দেয়ার মত অশালীন ভাষায় পরিনত করার ব্যপারে। তাই 'মোহমুক্ত যৌক্তিক বিশ্লেষন' করতে গিয়ে যে কখন অবজ্ঞা সূচক বিষেদাগার হয়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি বেচারা। শুধু তাই নয়, কোরান এবং মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যপারে যে তার চরম খেদ রয়েছে, সেটাও প্রমাণীত হয়েছে। যাই হোক, এসব রেখে মূল পয়েন্টে আসি এবার। তার লেখার মূল পয়েন্টটা কি ছিলো? তিনি তো বার বার একটা অমর বাণীই দিয়ে গিয়েছেন দেখলাম। তা হলো- "আল্লাহর কিতাব যখন, আল্লাহর বাণী, আদেশ নির্দেশই এতে থাকনের কথা। সব কিছুই তাইলে লিখা হওন উচিত্ উত্তম পুরুষ।" পুরো লেখাটাতেই ঘুড়ে ফিরে এই কথাটাই এসেছে এবং এটাকেই তিনি তার আসল যুক্তি হিসেবে নিয়েছেন। এটাও ঘোষনা করেছেন যে পরবর্তী পর্বে এই যুক্তির পক্ষে অনেক রেফারেনস নিয়ে হাজির হবেন।
ভাল কথা... নিয়ে আসুকু তিনি তার রেফারেনস, কোনই সমস্যা নাই। কিন্তু আল্লাহর কিতাব হলে যে তাতে শুধু 'আদেশ নির্দেশই ' থাকবে, এরকম অদ্ভুত যুক্তি তিনি কোথায় পেয়েছেন? যেখানে কোরানেই বলে দেয়া হয়েছে যে, কোরান মুসলমানদের পরিপূর্ন জীবন বিধান হিসেবে অবতীর্ন করা হয়েছে! আবার কোরানে সৃষ্টিকর্তা নিজেই বলেছেন যে, আমাদেরকে কিভাবে দোয়া করতে হবে এবং কিরুপ আচার আচরন করতে হবে তা শিখিয়েছেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে। মুমিনদের জন্য তিঁনিই উত্তম আদর্শ হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। তাই মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন অনুসরনের ব্যপারে আমাদেরকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন কোরানের মাধ্যমে। তো সেখানে মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহ কতৃক শিখিয়ে দেয়া প্রার্থনাগুলোকে আল্লাহর বাণী নয় দাবী করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? দোয়াগুলোকে কি করে তিনি ঐশী বাণী থেকে আলাদা করলেন? এবং নিজের মত করে তৈরি করা ষ্ট্যান্ডার্ড দিয়ে কেন কোরানের ঐশীয়ত্ব খর্ব করতে চান?
তিনি সূরা আল্ আন-আম (6:104) উদৃত করেছেন।
-[ "তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী এসে গেছে| অতএব, যে প্রত্যক্ষ করবে, সে নিজেরই উপকার করবে এবং যে অন্ধ হবে, সে নিজেরই ক্ষতি করবে| আমি তোমাদের পর্যবেক্ষক নই|']-
তারপর নিজের মত করে ব্যখ্যা করেছেন যে ওটা নাকি মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজের বানানো বাণী ছিলো। অথচ এর সাথে রিলেটেড আয়াতগুলো এবং এটির মূল অনুবাদটা (উহ্য অংশ সহকারে) তিনি দেননি যা দেখলে তার দাবীর অসাড়ত্ব প্রমাণ হয়ে যায়। পুরো আয়াতটি আমি কোরান থেকে কোট করলাম-
“তোমাদের কাছে তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে এই সূক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানের (নিদর্শন) এসেছে। অতপর যদি কোন ব্যক্তি (এসব নিদর্শন) দেখতে পায়, তাহলে সে তা দেখতো তার নিজের (কল্যানের) জন্যই। আবার যদি কেউ (তা না দেখে) অন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব তার উপর (বর্তাবে)। (তুমি বলো,) আমিই তোমাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক নই। আমি এভাবেই আমার আয়াতগুলোকে (তোমাদের কাছে) বিধৃত করি। যাতে করে কাফেররা একথা বলতে না পারে যে, তুমি (এসব কথা অন্য কোথাও থেকে) পড়ে এসেছো এবং যারা জ্ঞানী তাদের জন্যে যেন আমি আমার আয়াতসমূহকে সুস্পষ্ট করে দিতে পারি।“
- সূরা আল্ আন-আম (৬:১০৪-১০৫)
পুরোটা পড়ে কি মনে হয়? উনার দাবী কতটুকু ভ্যালিড ছিলো? বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম...
আরো মজার ব্যপার হচ্ছে তিনি তার তথাকথিত মোহমুক্ত বিশ্লেষনে ব্যখ্যার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন-
-[ "মহামতি দাউদ তার ইংরেজী অনুবাদে একটা ফুটনোট অ্যাড কৈরা দিছেন এই বৈলা যে এইখানে 'আমি' বলতে মুহাম্মদরে বুঝানো হৈছে। গবেষক রিচার্ড বেল তার 'আ কমেন্ট্রি অন দ্য কুরান' (1991)এ পরিস্কার কৈরাই বলছেন, 'এই আয়াতের শেষে পরিস্কার বুঝা যাইতেছে যে, মুহম্মদ নিজেই নিজের কথা কৈতেছেন'।" ]-
কোরানের আয়াতের অর্ধেকটা তুলে নিয়ে তার রেফারকৃত গবেষকদের বক্তব্য মেনিপুলট করে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন (‘'এই আয়াতের শেষে পরিস্কার বুঝা যাইতেছে যে, মুহম্মদ নিজেই নিজের কথা কৈতেছেন'’), তা কতটুকু গ্রহনযোগ্য? শুধু তাই নয়, উনি আরো অনেক গবেষকের বাণী উদৃত করেছেন উনার বিশ্লেষনে। তার এইসব কথাবার্তা শুনে পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যায় কোরান নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে তিনি কোরান পড়ার চাইতে জনৈক ব্যক্তিদের কথাকে বেশী গুরত্ব দিয়েছেন এবং নিজের সুবিধামত সেগুলোকে মেনিপুলেট করেছেন। এটা যেন অনেকটা এরকম একটি ব্যাপার যে, তিনি হাতি নিয়ে গবেষনা করার জন্য নিজে হাতি দেখতে না গিয়ে ঐ আটজন অন্ধের কাছে গিয়েছেন যাদের কেউ মনে করে হাতি পিলারের মত বস্তু, কেউ মনে করে হাতি দড়ির মত। তারপর সেখান হতে পসন্দসই একটা বক্তব্য নিজের নিজের মত করে বানিয়ে গবেষনায় রেফারেনস হিসেবে দেখিয়ে দিয়ে হাতি বিষয়ক গবেষক হয়ে গিয়েছেন। ব্যপারটা হাস্যকর নয়কি?
তিনি সূরা আন-আম এর ১১৪ নাম্বার আয়াত দেখিয়েছেন-
-[ আরেকখান আয়াত দেখি। সূরা আল্ আন-আম (6:114):
"তবে কি আমি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন বিচারক অনুসন্ধান করব, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্থ অবতীর্ন করেছেন?" ]-
তারপর এটা নিজের মত ব্যখ্যা করেছেন-
-[ যে কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ উপরের আয়াতটা পড়লেই বুজবার পারব যে, "তবে কি আমি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন বিচারক অনুসন্ধান করব" -এইডা পিওরলি নবী মুহম্মদের কথা, আল্লাহর না। আল্লাহর ত আর ঘটা কৈরা জানা দিয়া নিজের বিচারক খুঁজনের দরকার নাই, কি কন্ ?"]-
মজার ব্যপার হচ্ছে পুরো আয়াতটা তিনি দেননি এখানে। দিলে উনার দাবীটা ধোপে টিকতো না। তাই নিজের সুবিধার্থেই অর্ধেক আয়াত দিয়েছেন। পুরো আয়াতটা আমি দিচ্ছি নিচে দেখুন-
"(আপনি বলুন তবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ফয়সালাকালী অনুসন্ধান করব? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি সুবিস্তারিত কিতাব নাযিল করেছেন। আর আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা জানে যে, তা আপনার রবের তরফ থেকে সত্যসহ অবর্তীর্ণ হয়েছে। সুতরাং আপনি সন্দেহকারীদের অন্তভুর্ক্ত হবেন না।"
সূরা আল্ আন-আম (৬:১১৪)
পুরো আয়াতটা পড়ার পর উনার দাবীর অসাড়তাই খুব পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। কথা হচ্ছে একটি আয়াতের অর্ধেক দিয়ে নিজের মত করে এরকম ব্যখ্যা করাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত ব্যপার? শধু এই আয়াতই নয়, উনি উনার পুরো পোষ্ট জুড়ে আরো অনেক বাণী দিয়েছেন কোরান হতে উদৃত করে, যার প্রায় সবগুলোই এরকম ফেব্রিকেটেড। কোন বাণী অর্ধেক তুলে এনে নিজের মত করে ব্যখা করেছেন। কোনটা ভুল ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই সেগুলো নিয়ে আলোচনার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। (তবে কেউ চাইলে করতে পারি পরবর্তী কোন পর্বে)।
সত্যিকথা বলতে কি, উনার পোষ্টটা হাস্যকর যে এটা নিয়ে প্রতিবাদমূলক একটা পোষ্ট দেয়ার চিন্তাই প্রথমে মাথায় আসেনি। পরে দেখলাম এই ব্লগের নাস্তিকের দল খুব লাফাচ্ছে এসব অর্ধশিক্ষিত যুক্তি পেয়ে। তাই ভাবলাম কিছু বলা দরকার।
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১০:২৯