ওরা কথা বলছে কঙ্কাবতীকে নিয়ে। দৈত্য নাকি ভুল করে কঙ্কাবতীকে বোতলে আটকে ফেলেছে তাও সেটা নাকি আবার পানির নিচে। এখন তো কঙ্কাকে বাঁচাতেই যত তোরজোড়.....
আচ্ছা কত কতই না কিছু নিয়ে মেতে থাকি আমরা। নিজেদেরকে একটা বাক্সের মধ্যে আটকে ফেলি যেন। আর সেই বাক্সটায় অজানা অচেনা কতগুলো নাম যার হয়ত বাস্তবে কোন ছায়াও নেই..... তবুতো আমরা খুশি হই!! আর ছায়াহীন নামগুলোও হয়ে যায় ডাকে সাড়া দেয়া সেই পথিকটি। যে হয়ত চলতে চলতে একটু জিড়িয়ে নিতে চাইছিলো.... একটা গান,, কিংবা দুটো স্তুতি কিংবা কিছুই নয় তবু যেন একটা সুর অবিরাম বাজতেই থাকে বাক্সটায়....
ঘড়িটায় সকাল নটা বাজে। তবু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি অন্ধকার কোথাও বসে আছি। না ঠিক অন্ধকারও নয় একদমই তবে এমন কোথাও যেখানে ছাই রঙা ধূসর কেই শুধু অনুভব করা যায়। যেমনটা আমার রোদ চশমা পরলেও হয়। মনে হয় চারপাশটায় একটা বিষণ্ন ছায়া ছায়া ভাব। একটু নরম কিন্তু মন খারাপ করা। আসলে বোধহয় জানালার বাইরে ছাইরঙা আকাশটাই এর কারণ। ভোর বেলা থেকেই জানালার কাঁচ বেয়ে বর্ষা গড়িয়ে পরছে অনবরত। রাস্তার ওধারটায় লাল নীল রঙের ছাতা মাথার বিন্দুগুলো কালচে রঙের এই আকশটার কাছে যেন একদমই পানসে। এত গাঢ় এই ধূসরতা যে ওর চারপাশের সমস্ত উজ্জল রঙগুলো খুব অনিচ্ছার সাথেই মাথা নুইয়ে ওর মধ্যে মিশে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। আমি মনে মনে একটু হাসলাম,, আজকে একমুঠো লাল চুড়ি পরবো। টুং টাং করে বাজতে থাকা রেশমী চুড়ি.....
আচ্ছা আমি যদি একটা গল্প বলি খুব কি বিরক্তিকর হবে সেটা?? আমি একটা মন খারাপ করা গল্প বলতে পারি এখন। সব সময়ই হয়ত বলি তবে এবারের গল্পটা একটু বেশিই যেন অসহায় অনিচ্ছার।
ত্রেয়া দাড়িয়ে আছে স্টেশনের বাইরে। ও অপেক্ষা করছে। একজন বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা। ওর সামনের যায়গাটুকুতে বেশ কোলাহল। এটা একটা বাঙ্গালী বাজার। খুব কাছেই এক দোকানে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। বলা হচ্ছে পদ্মার ইলিশ। যদিও হাজার মাইল পেরিয়ে শুধুমাত্র শীতলতাকে পুজি করা রুপালী রঙের ঐ জিনিসটায় পদ্মার কোন মাছেরই ছোয়া আদৌ পাওয়া যাবে কিনা কে জানে....
কতদিন মায়ের হাতের সর্ষে ইলিশ খাওয়া হয় না, এটা ভেবে ত্রেয়ার বেশ মন খারাপই হলো!!
তবে ওর মন খারাপ ভাবটা বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না এত ভিড়ের হাওয়ায়। ঠিক কোন দিকে যাবে একটু দাড়িয়ে এটাই ঠিক করার চেষ্টা করছিলো ও। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হতাশই হলো যেনো একটু। বন্ধুর আসতে এখনো ঢের সময় বাকী। একটু মনে হয় বেশিই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে ও আজকে।
কি একটা ভেবে নিয়ে ও বাজারের মাঝখান দিয়েই হাটতে শুরু করলো। ভাবছে সামনেই একটা বাংলা বই এর দোকান আছে ওটাতেই নাহয় একটু ঘুরে আসা যায়।
পার হলো কয়েকটা সেলোয়ার-কামিজের দোকান দু একটা শবজি আর টুকটাক ঘরের জিনিসপত্রের দোকানও। এর মধ্যে একদম হঠাৎই ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে গেলো। শীতের শুরু হয়ে যে গেছে প্রকৃতি ঠারে ঠুরে সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইলো কি!! সেই সাথে আবার নামলো একটু গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও। তবু হাটছিলো ত্রেয়া। ভালোই লাগছিলো ওর। আসপাশ থেকে ভেসে আসা বাঙালী কথপোকথনটাও বেশ উপভোগ্যই বটে। হাটতে হাটতেই ও চলে আসলো একটা পার্কের সামনে। পার্কটার একটা নাম আছে। একটা বাঙ্গালী নাম। ১৯৯৮ এ এই পার্কে এক ২৫ বছরের বাঙালী যুবক কে মেরে ফেলা হয়েছিলো। সেই যুবকের স্মরণেই পার্কটির নাম করা হয় তার পরে। পার্কটার সামনে এসেই ত্রেয়া একটু থমকে দাড়ালো। কি যেন একটু ভাবলো দাড়িয়ে। ভাবলো আর সামনে এগোবে কিনা?? বই এর দোকানটা আরও একটু সামনে গেলেই হয়ত পরবে। আর রাস্তা পার হলেই পার্ক। ওর মনে হলো ও পার্কটিতে যেতে চায়। আবার ভাবছে কিই বা লাভ....ওর কিইবা করার আছে কারও জন্যে। কিন্তু তবুও একটা আদম্য আগ্রহ থেকেই সামনে এগিয়ে গেলো ত্রেয়া।
এই কদিন ধরে বহুবার বহু লোকের মুখে এই পার্কের নাম উচ্চারিত হতে শুনেছে ও। নতুন আসা ছাত্রদের বরাতে এই পার্কটা যেন নতুন করেই আবার সজাগ। যাদেরই নাকি যাবার যায়গা থাকে না এই শহরে ওরা এখানেই বসে থাকে। কখনো দল বেধে কখনো বা একা...কখনো একটা চাকরীর খোজে কখনো বা একজন সাহায্যকারীর আশায়,, কিংবা একটা থাকার যায়গা আবার হয়তবা কিছুই না শুধু হতাশায় নুয়ে পরা ছেলেগুলো কিছু করার নেই বলেই এখানটায় এসে বসে থাকে।
ত্রেয়ার ঠিক জানা নেই কি হয় ওদের সাথে। ও শুধু লোক মুখে শুনেই গেছে। হয়ত একটু খুব বেশিই মন খারাপ হয়েছে ওদের কথা ভেবে আবার একসময় ভুলেও গেছে। তাই পার্কটার সামনে এসে ও কেমন যেন গম্ভির কিন্তু খুব অস্থির হয়ে গেলো ভেতরে ভেতরে।
ও পা চালালো রাস্তা পার হতে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তখনো পরছিলো অবিরাম। ত্রেয়া খুব মনযোগের সাথে দেখছিলো পার্কের ভেতরটা। পার্কের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া একমাত্র রাস্তাটায় স্টিলের অক্ষর গাথা আছে বেশ কিছু। বাইরের রাস্তার আলোয় ওগুলো মাঝে মাঝে চমকে দিচ্ছিলো ওকে। ও খুজছে। আবছায়া অন্ধকারে কেউ কি বসে আছে কোথাও?? এমন কেউ যার হয়ত যাবার জায়গাটি নেই এই শহরে আজকে সন্ধ্যায়। কই নাহ্ নাতো। কেউ তো শুধু শুধু এই বৃষ্টির মধ্যে বসে বা দাড়িয়ে নেই। যাক ত্রেয়া একটু খুশির সাথেই চোখের পলক ফেললো। আসলে লোকে হয়ত বাড়িয়েই বলে। সবাই নিশ্চই ভালো আছে যারা সময়ের প্রয়োজনে এ শহরে আজ ভাগ্যের খোজে....ওরা অন্তত মাথার ওপর ছাদ পেয়েছে কোথাও। যাক ওরা ভালোই আছে,,,,,,
ছেলেটি এগিয়ে এলো ধীরে। মাথা নিচু করে হেটে এলো সে গন্তব্যহীন ভাবে। লম্বায় মাঝারী ধরনের তবে গড়নটা যেন খুব ক্ষীণকায়। গায়ের সাথে আটোসাটো তার শীতের কাপড়। বেশ বড়ই বলা যায় এমন একটা ট্রাভেল ব্যাগ ছেলেটির কাধে ঝোলানো। মাথার সিনথেটিক হুড বেয়ে গড়িয়ে পরছে বৃষ্টির টুপটাপ ফোটা। ছেলেটি হাটছে ধীরে। যেন কিছু একটা মনস্থীর করতে চাইছে ও। ত্রেয়া দম বন্ধ করে সামনে এগোলো। ও নিজেও কি কিছু ভাবছিলো বা বুঝার চেষ্টা করছিলো সে সময়টায়.... তারপর যেন কিছুই হলো না শেষ পর্যন্ত। ওরা দুজন দুজনকে পার হয়ে যে যার মত সামনের দিকে এগিয়ে গেলো....
ত্রেয়ার বন্ধু ঠিক তার সময়মতই চলে এলো। ওরা বসল একটা বুফে রেস্তোরায়। অনেক মজার মজার গল্পও হলো। হরেক রকমের খাবার সামনে। খুব পছন্দের মিট কারিটা তবুও কেন যেন ঠিক খেতে পারল না মেয়েটা। খাবার পর দুষ্টুমি করে একটা মশলা ওয়ালা পান চিবুতে পারলো না আয়েশ করে। কিংবা বই এর দোকানটা থেকে কিনলো না কোন কবিতা সংকলন। কিছুই করলো না সে তার স্বভাব মতন।
সেই একই রাস্তায় ফিরতি পথে হাটতে হাটতে যখন কিনা প্রচন্ড ব্যাং ব্যাং শব্দে মিনিট খানেক আগে পেছনে ফেলে আসা যায়গাটায় একটা পোলো এসে মুখ থুবড়ে পরল শুধু মাত্র সেই সময়টায় ওর মনে হলো,,, আসলে ওর তেমন কোন অনুভূতি কাজ করছে না। এক মিনিট আগে ঐ যায়গাটায় ওর থাকতে পারার সম্ভাবনায়ও ওর তেমন কোন ভাবান্তর নেই।
কিছু একটা তো হয়েছিলো সেই সময়টায়।
ওর চোখে ভেসে উঠলো পার্কের ছেলটির মুখ। ওকে ক্রস করে আসার সময় এক ঝলকের আবছা আলোয় দেখা ছেলেটি। অদ্ভুত একটা শুণ্যতায় ভরা চাহুনীর ছেলেটি। যার চোখে কোন সাহায্য প্রার্থনা ছিলো না ঠিকই। ছিলো শুধু ভয়ংকর এক অনিশ্চয়তার ছায়া....
যার সিনথেটিক হুড বেয়ে ফোটা ফোটা বর্ষা গড়িয়ে পরছিলো। কোলাহলহীন কনকনে সন্ধ্যায় ছেলেটি হাটছিলো ধীরে। হাজার হাজার মাইল পেছনে নিজের পৃথিবীটাকে ফেলে যে এসেছিলো হয়ত অলীক কোন ভাগ্য অন্বেষণে........।।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫৯