ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিলাম। প্যাডেস্টাল ফ্যানটা দিয়ে দিলাম ফুল স্পিডে। বিছানার চাদর পাল্টে একরঙা সাদা দিলাম। বাতি নিভিয়ে জ্বালালাম একটা ল্যম্পশেড। শুধু যদি একটু কমে দম বন্ধ ভাবটা!!
ঘর ভরে গেল কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায়। অন্ধকারের আবছায়া নিয়ে এল একটা নিশ্চুপ বিষণ্নতা।
কিন্তু কই দম বন্ধ ভাবটা যাচ্ছে নাতো!! বরং মনে হচ্ছে ঘরের হীমে ঠিক যেন লাশকাটা ঘরের নিস্তব্ধতা চলে এসেছে। সব যেন চেপে আসছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে... মনে হচ্ছে.....
আমি ছুটে বের হয়ে এলাম। হাতে মোবাইল আর বাসার চাবিটা নিয়ে একটা পাতলা ফিনফিনে শ্যাওলা চাদর গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে এলাম রাস্তায়।
আমি হাটছি।
পার হলাম বাড়ির পেছনের জমজ বোনের মত জড়াজড়ি করে থাকা বাড়ি দুটো। বরাবরের মত পাশ কাটাতে চাইলাম গ্রেভিয়ার্ডটা। তবু কি মনে করে যেন চোখ চলে গেল সেদিনের হোলদে মায়ার পাতা ওয়ালা গাছটার দিকে। মনে হলো গ্রেভিয়ার্ডটা যেন ডাকছে আমায়।
বললাম না।
তোমরা আমার গন্তব্য নও কখনই। আমি প্রাণের কাছে যেতে চাই। আমি যেতে চাই এমন কথাও যেখানে ক্ষুদ্রতর উষ্ণ ভালোবাসা দেখেও কেটে যাবে সমস্ত ক্লান্তি চলে যাবে পাথরের মত ভারী একাকীত্বটুকু....
একমনে কি যেন ভাবছি আমি। পলকহীন তাকিয়ে আছি শুণ্যে যেন। বারবারই সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। বুঝতে পারি চোখ ভিজছে আমার। এক ফোটা কান্না জমা হয় পাপড়ির ডগায়। তারপর সেও অপেক্ষা করে... সে অপেক্ষা করে আরেকটি বিন্দুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে না আমার কান্নারা। বিন্দুর অপেক্ষায় আমার পাপড়িও ক্লান্ত হয়ে বুজে আসে... হায়,,, আমি কাঁদতেও পারিনা!!
আসেপাশের প্রতিটি বাড়ি ঘুমিয়ে গেছে। রাস্তাগুলোয় শুধু ঝড়ে পরা হোলদে পাতাদের দল...
ঠিক যেন দল বেধে বৌ-চী খেলছে ওরা। ল্যাম্প পোষ্টের আলোর বৃত্ত ওদের সাহায্য করছে রানী পাতাকে ঘিরে রাখতে। আর বাতাস..... হঠাৎ আসা একটু হাওয়া ওদেরকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো রাস্তাময়। আমার যথেচ্ছ এলোমেলো পা ফেলায় পাতাগুলোর তাই খুবই আপত্তি!! আমি তাড়াতাড়িই পা চালালাম। ওদের ছেড়ে উঠে গেলাম বড় রাস্তায়। কিছু যেন একটা বিড়বিড়ও করছি আমি....
there is no place to go
I'v been n than again I'll b
just waiting till u take me
till u permit me
having a grave of my won
this is to me
to a gothic me,,don't...........
হঠাৎ গাড়ির শব্দে যেন হুশ হলো। পাশ দিয়ে হাওয়ার মতই উড়ে গেল যেন একটা পোড়শে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলাম আমি গাড়িটার চলে যাওয়ার দিকে। কি করে হঠাৎ আমার মনে হলো যে এটা একটা পোড়শে তাই ভাবছিলাম বোধহয়। হুমম..... মনে পরলো। চিনিয়েছিলে তুমি।
বরাবরের মতই তোমার গাড়ির বড্ড শখ। বাইক, গাড়ি তাও আবার স্পোর্টস কার। তোমার সাথে কতবার যে ঝগড়াই হলো এই গাড়ি দেখা নিয়ে। মনে পরতেই এক চিলতে হাসির ঝলক যেন আমার ঠোটে।
রিক্সায় আমি বকবক করেই যাচ্ছি করেই যাচ্ছি হঠাৎ তোমার দিকে তাকিয়ে দেখি আরে কাকে কি বলছি!! তুমিতো যে কি দেখছ তা তুমিই জানো। আর ধরা পরতেই তোমার আমতা আমতা শুরু। এমন করেই তো না.... হুমম এমনি করেই একদিন আমিও তোমার সাথে দেখা শুরু করেছিলাম। চিনেছিলাম ঢাকার রাস্তায় চলা বড় বড় দামি গাড়িগুলো কিংবা ছোট্ট কিন্তু খুব নামকরা কিছু।
ভালোই লাগত তোমার পছন্দগুলোকে নিজের করে নিতে। ভালোই তো। একটা সময় নিজে নিজেও ঠিক ঠিক গাড়ির নাম বলে তোমায় চমকে দিতে চাইতাম।
আসলে কত কিছু করেই তো তোমাকে চমকাতে চাইতাম আমি। শুধু কখনো বলা হয়ে ওঠেনি যে সবকিছুর মূলেই তুমি ছিলে। তোমায় বোঝানো হয়ে ওঠেনি যে প্রতিটি আমার বদল কিংবা বদলের চেষ্টা.......
আচ্ছা আমি চাইতাম কত কম তাইনা। কত অল্প ছিলো আমার আশা করাটুকু। তবুও সব এমন......
উফ্ আবার সেই দম বন্ধ করা অনভূতি। আমি...... আমি একটু। আমি একটু মুক্তি চাই.... একটু শ্বাস নিতে চাই আমি।
হাটতে হাটতেই বাড়ির কাছের খুব চেনা ব্রীজটার মাঝখানটায় তখন আমি। চারদিকে শুনশান নিরবতা। তারপরই একটা ভোতা শব্দের জানান দিয়ে নিচ দিয়ে চলে গেল একটা ট্রেন। থামলো না ওটা পাশের স্টেশনে। আমি ব্রীজের গ্রীলের খাজে পা রেখে দাড়ালাম।
শীতের শুরুর ঠান্ডা হাওয়া কেন যেন আমায় কাঁপাতে পারছে না একটুও। পারছে না কোন অনুভূতি তৈরি করে দিতে যাতে করে আমি বুঝতে পারি আমার গায়ে সূচ ফুঁটছে। বা ফোটার কথা..... আমি ঝুকে আছি ব্রীজের নিচে তাকিয়ে থেকে। কি যেন ভাবছি আমি।
ভাবছি আমার একটা যায়গার বড় অভাব। নিজের একটা যায়গা। একটা ইট কাঠের দালান নয়। এক প্রস্থ জমি নয়। শুধু একটু চোখ বোজার যায়গা। সবার ওপর অভিমান করেও আমি যেখানটায় নিজেকে খুজে পাব। সমস্ত অপূর্নতা, অপ্রাপ্তীর পরেও যেই যায়গাটাই আমার পরম পাওয়া হবে। একটা রক্ত মাংসের যায়গা চাই কি আমি??
উহু ঠিক তাও নয় তবে??
বারবারই নতুন করে শুরু করতে চাওয়া আমি যখনই ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারি শুধুই মরিচীকার পেছনে ছুটছি খুব বেশিই মনে হয় যে আমার আসলে যাবার কোন যায়গা নেই....
একটা তীব্র ইচ্ছে হঠাৎই আক্রমন করে বসল। আর এইবার যেন একটু কেঁপে উঠলাম আমি ঠিক।
আমার আঙ্গুলগুলো একটু একটু করেই আলগা হচ্ছিলো হীমশীতল গ্রীলের ওপর থেকে। আমি থেমে থেমে শ্বাস নিচ্ছি। একটা প্রচন্ড চাওয়া,,,,, ঠিক যেন অসুরের মত ভর করে আছে এই মুহূর্তের জন্যে আমার ওপর। পায়ের চপ্পল জোড়া খুলে গ্রীলের খাজগুলো পেড়িয়ে একটু সামনে... দু কি তিন মিনিট হয়তোবা........... একটা থ্যাচ করে শব্দ আর তারপর??
তারপর অতল অন্ধকার কিংবা কিছুই হয়ত না..... তা না হোক। অন্তত সব কিছু শেষ তো।
মরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সে সময় এতই প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল যে চোখে একটা তীর্যক আলোর রেখা আমি অনুভব করছিলাম না দেখেও। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
আর তখনই আমার চোখের সামনে ভেষে উঠল একটা ঘর। ধবধবে সাদা টাইলসে মোড়া একটা ঘর। তারপর যেন কেউ ঘরটায় একটা ফোয়াড়া ছেড়ে দিলো। ফিনকির ফোয়াড়া। সাদা ঘরটার দেয়ালগুলো দেখতে দেখতেই ফুটন্ত লাল হয়ে যাচ্ছে আর আমি...... আমি বারবার করে পানি ঢেলে যাচ্ছি তার ওপর। সব ঢেকে ফেলতে হবে সব। কাউকে দেখানো যাবে না এই লালগুলো...... কাউকে না।
আবার তারপরই চোখে পরল মাকে,, দেখলাম আব্বু।
সবাই কেমন বিহ্ব্যল যেন।
তারপর কি কারও ফোন এলো.... আমি বলেই যাচ্ছি বলেই যাচ্ছি তবু যেন কথা ফুরায় না..... আমি বারবার ঘুমের দেশে যাচ্ছি তলিয়ে। দেখলাম একটা সাদা বেড আমি, ডাক্তার, সাথী আর সবাই কেই। তোমাকে খুজলাম কোথাও পাই কিনা?? কই নাহ্ তুমি নেই তো!!
তারপর যেন একটা হীমঘর!! না ওটা হীমঘর নয়তো ওটাতো অপারেশনের টেবিল গো..... উফ্ লোকটা আমার কব্জীতে কি বিচ্ছিরী করেই না কাঁটা ছেঁড়া করছে। কি আশ্চর্য কেউ কিছু বলছে না কেন লোকটাকে। আহ্ আমার লাগছে তো!! প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে.... প্লিজ। আরে!! মা তুমি লোকটাকে কিছু বলছ না কেন?? আমি দেখলাম কতগুলো ময়ূরপঙ্খী রঙের ঝলমলে সূতো। দেখলাম........
চোখ মেললাম আমি। গ্রীল থেকে নেমে এলাম ধীর পায়ে। আমি জানি বাতাসে মিশে থাকা কালো শয়তানটা একটা ভৎর্সনার দৃষ্টিতে আমাকে অভিষাপ দিচ্ছিলো ঠিকই। তবু আমি নেমে এলাম। গায়ের চাদরটাকে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে উল্টো পথ ধরে আবার হাটা শুরু করলাম। কারণ আমি জানি কিছুদূর গেলেই আমার শূন্য ঘরটা আমার অপেক্ষায় আছে.........।।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:৪৪