ছবিটা দেখতে দেখতেই চোখে আমার ভেসে উঠলো কোন এক মেঘলা দিনের কথা।
মুহূর্তেই চলে গেলাম এক ধোঁয়াটে দিনের ভালোবাসার স্মৃতিতে......
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে।
তারমধ্যে সারাদিন আমরা একসাথে। কখনো রিক্সায় কখনো সিএসসি ক্যান্টিনের ঝাপরা গাছগুলোর নিচে আর কখনোবা চারুকলার দোতলার টানা বারান্দায়। আড্ডা, আড্ডা আর আড্ডা। কথার যেন আর শেষই হয়না সেদিন। এদিকে দুজনেই ভিজে একসা। তবুও বাড়ি ফেরার নাম নেই। ঝরঝর বৃষ্টি সারাদিন আর আমরা কদমের ঝাড়ে জড়াজড়ি করে দুটো পাখি যেন ঠিক। তারপর তোমার একটা ফোন। তুমি একটু বাড়ি যাবে। আমায় সাথে করেই রওনা হলে। তোমার বাড়ির সামনে এসেই আমার হাত-পা কাঁপুনি আর তাই দেখে তুমি হেসেই কুটিপাটি। তোমার বাড়ির চিলেকোঠায় আমাদের বৃষ্টি বিলাস। একটু একটু করেই কাছাকাছি হচ্ছিলাম যেন আমরা। আমার ভেজা চুলে মাখামাখি হয়ে তুমি ব্যস্ত হলে আমার জামার বোতাম নিয়ে। আমার জামার বোতামগুলো ছিল বেশ ভারি কাজের, একসারিতে লম্বা করে ফিতে দিয়ে একটার সাথে আরেকটা পেঁচিয়ে লাগানো। তাই হঠাৎ করে তুমি বুঝতে পারছিলে না কি করবে। তোমার মুখের ওপর থেকে আমার ভিজে চুলের গোছা সরাতে সরাতে বলেছিলাম কি চাও বলতো?
তুমি ঘোর লাগা চোখে উত্তর করেছিলে একবার দেখবো তোমায়। দেখবো সুধু একটুক্ষণ। নাহয় দূর থেকেই, তবু দেখবো। দেবে না?
এক একটা ফিতের বন্ধনী খুলেতে গিয়ে আমি লজ্জায় লাল হয়েছিলাম। ভিজে কাপড়ের কিংবা তোমার চাহনির শিহরণে একটু কেঁপে কেঁপেও উঠছিলাম। দূর থেকে তুমি তাকিয়ে ছিলে অপলক। আমি বন্ধ চোখেও অনুভব করতে পারছিলাম উন্মুক্ত খঞ্জনীর ভাজে তোমার মাতাল হওয়া। আমি ঠিক জানি আমার চোখের পাতার তিরতির কাঁপুনি তোমায় জানিয়ে দিচ্ছিল আমার মরমে মরে যাওয়াটুকুন। তোমার মুগ্ধতা রবিঠাকুরের আওয়াজে বলে উঠেছিলো......
একি মানবীর স্তন,,শুভ্র সাদা শঙ্খ যেন জোড়......
আমি আজও ভাবি। প্রতিবার আমি অবাক হই এই ভেবে, তোমার সেই চাহনী আমাকে উলঙ্গ করেনি, যেন আবৃত করেছিলো শৃঙ্গারে।
সেই দুপুরের ঐ একটুখানি সময়। ঐ সময়টুকুতে কোন বন্ধনীর সীলমোহর ছিল না, ছিল না কোন সামাজিক স্বীকৃতি। তবুও কতই না মায়ায় জড়ানো আমার সেই দুপুর। মেঘলা কোন দুপুরে চোখ বন্ধ করে আমি আজও চেষ্টা করি সেই সময়টুকুকে ফিরিয়ে আনতে আমার মানষপটে। অনুভব করতে চাই তোমার চাহনীর সেই ভালোবাসা মাখা মুগ্ধতা।
এই দুটো বছর ধরে কতই না রাত গেছে যখন আমি দেখেছি নিজেকে অন্যের চোখে নির্যাতিত হতে। কাঁচা মাংসের গন্ধে লোভী হওয়া চোখের হিংস্রতায় ভীত হয়ে আমি তাই বারবার তোমার সেই চাহনী খুঁজতে থাকি ক্লান্তি হীনভাবে।
বাড়ি ফিরে শাওয়ার নিচ্ছিলাম। নেমে আসা হালকা গরম পানির ধারাটা শরীরের প্রতিটি অংশের ক্লান্তিকে যেন শুষে নিচ্ছিল। হয়ত মনের ক্লান্তিও কিছুটা, নয়ত শাওয়ারের পর মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব কোথা থেকে আসতো। গিজারের ঝিম ধরা একটানা শব্দটা কেমন যেন নেশার মত অবশ একটা অনুভূতি তৈরি করে। শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আমি কি যেন একটা ভেবেই যাচ্ছি, এই ভাবনার যেন কোন শেষ নেই।
চারদিকে সুনসান নীরবতা। আশেপাশের প্রতিটি বাড়ির আলো নিভে গেছে অনেক আগেই। আমি ভুলে গেছি সাবানের কথা কিংবা শ্যাম্পু ।মনে আছে শুধু আমার দাড়িয়ে থাকাটুকু আর গিজারের একটানা ঝিম ধরা শব্দটা।
ভাবছি আমি।
আমাকে নিয়ে ভাবছি। সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত। সব ভেবে ফেলছি একবারে কিংবা এমুহূর্তকে ভেবে চলেছি সারাক্ষণ।
আমি জানি না। আমি আর কিছুই জানিনা। সুধু জানি আমি আমার জীবনের এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যেখান থেকে যাবার আর কোন জায়গাই নেই।
জীবনের যে পথটুকুর শুরু হয় মা-বাবাকে ছেড়ে নিজের মত করে চলার, সে পথের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমার পুরোটা পথ কেটেছে তোমাকে সঙ্গী করে। কিন্তু এই সময়টার খুব অল্প সময়ই তুমি সাথে ছিলে আমার। তোমাকে ভালবেসেছিলাম বলাটা বোধহয় ভুল হবে, বলতে পারি তোমাকে সর্বাঙ্গে আত্মস্থ করেছিলাম। কিন্তু তবুও তোমায় হারিয়েছিলাম প্রথমেই। সেটা কি নিজের দোষে না ভাগ্যের সে হিসেব আজ আর করতে ইচ্ছে করে না।
আজ শুধু জানি তুমি ছিলে না।
আর তোমার ঐ না থাকাটুকু থেকেই আমার বিভীষিকার শুরু যেন।
বিয়ের দিনই তুমি মারা গেলে। রেখে গেলে একটুকরো কাগজ। আমাদের বিয়ের কাগজ। ঐ একপাতা কাগজের এত শক্তি!
সে বদলে দিলো আমার জীবনের সমস্ত হিসেব। আমি হয়ে গেলাম অপয়া। কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে, বিয়ের দিনই বরকে মেরে ফেলে, এতই অপয়া।
আশেপাশের লোকজনের এই ঘটনাটা জানতে খুব একটা দেরি হলনা। বাড়িতে প্রতিবেশীদের আনাগোনা বেরে গেল। সবার মুখে সান্ত্বনার বানী আর চাহনীতে ঝরে পরত ছিঃ ছিঃ। নিজের কাছে, নিজের বাড়ির লোকদের কাছে আমি তখন যন্ত্রণার বলয় মাত্র। যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে বাবা-মা পাগল হয়ে উঠলেন। আমাকে আবার বিয়ে দিয়ে দিলেই শুধুমাত্র পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব এমন পরামর্শ আত্মীয় স্বজনরা দেওয়া শুরু করলো। আমার তখন তোমাকে হারানোর কষ্ট থেকেও বড় হয়ে দেখা দিলো নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
দিনের পর দিন আমি পাগলের মত কাটালাম। আমার চিন্তা করার শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সেই সময়টায়। হয়ত পাগল হয়ে যেতাম পুরোপুরি আর বিয়ে হয়ে যেত আবার খুব বড় কোন অঙ্কের লোভের বিনিময়ে।
কিন্তু তেমন কিছু হওয়ার আগেই একটা চিঠি এলো বাড়িতে। আমার স্কলারশিপের চিঠি।
এক দুপুরে সবাই বিয়ের দাওয়াতে আর বাড়ির কাজের মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকায় যখন একটানা বেল বাজতেই থাকলো। খুব দ্বিধার সাথে দরজার সামনে দারিয়ে খুলবো কি খুলবো না ভাবতে ভাবতেই নব ঘুরিয়েছিলাম। পিয়ন চিঠিটা আমার হাতেই দিলো।
খুশি হয়েছিলাম কিনা জানি না, তবে ঐ প্রথম মনে হয়েছিলো আবার আমি একটু বাঁচতে চাই।
কাউকে না জানিয়েই পুরোটা ব্যবস্থা করলাম। এমনকি প্লেনের টিকেটের টাকার জোগাড়টাও করেছিলাম বিভিন্ন জন্মদিনে বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়া গয়নাগুলোকে একসাথে জড়ো করে নিয়ে নিউমার্কেটের এক গয়নার দোকানে বিক্রি করে দিয়ে। মনে আছে আমার ডিপার্টমেন্টের এক ম্যাডামের কাছে গিয়ে সব খুলে বলেছিলাম। উনি আমাকে আমার বরাবরের ভালো রেজাল্টের জন্যে বেশ পছন্দ করতেন। সে জন্যই হোক কিংবা নিজের বিবেক বোধের কারণেই হোক, উনি আমাকে যাবতীয় সমস্ত সাহায্যই করেছিলেন যতটুকু ওনার দ্বারা করা সম্ভব ছিল সেই সময়। যখন বাড়ির সবাই আমার বিয়ে ঠিক করে দিন তারিখের চিন্তায় ব্যস্ত এমন সময় এক সন্ধ্যায় বাড়ি ছাড়লাম।
হাতের ছোট্ট ব্যাগে দুটো ঠাণ্ডার কাপড়, কাউকে না জানিয়ে নেয়া যায় এমন দু একটা টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর পড়াশুনার সমস্ত কাগজপত্র, সাথে মনে প্রচণ্ড ভয়। এই নিয়ে পার হলাম হাজার হাজার মাইল।
এই দেশে যেদিন প্রথম পা রাখি শুধু কোথায় থাকবো এটুকু জানা ছাড়া আর তেমন কিছুই জানা ছিল না আমার। তবুও বেঁচে গেলাম আমি। এই অপরিচিত রুক্ষ ঠাণ্ডার দেশে বেঁচে গেলাম। কিন্তু আমি কি আসলেই বেঁচে যেতে পেরেছিলাম?
"রবি ঠাকুরের লেখাটুকু অনেক আগে কোথাও পড়েছিলাম। যদি কোথাও অনিচ্ছাকৃত রদবদল হয়ে থাকে তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থী"
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৬