বাসের টিকেট চেকার।
আমি চমকে উঠলাম। চোখ খুলে অবাক চোখে তাকালাম লোকটার দিকে..........
এই দেশে সবসময়ই যে বাসে টিকেট চেক করে তা কিন্তু না। হটাৎ হঠাৎই এদের আবির্ভাব হয়। তখন টিকেট দেখাতে না পারলে এরা বেশ বড় অংকের ফাইন করে।
টিকেট চেকার আমাকে দ্বিতীয়বার টিকেটের কথা বলায় আমি যেন বোধ ফিরে পেলাম। ব্যাগে হাত দিয়ে টিকেট বের করে দিলাম লোকটার হাতে। সে তার হাতের যন্ত্রটা দিয়ে ভ্যালিডিটি চেক করে আমাকে আমার টিকেট ফেরত দিল।
টিকেট চেকার চলে যেতেই সিটে হেলান দিয়ে নিজের হাত দুটোকে গালে ছোঁয়ালাম। সময় আর কতকাল আমাকে বারবার একই যায়গায় নিয়ে গিয়ে দাড় করাবে?
বারবার সেই সাইন্স ল্যাব এর মোড়ে গিয়ে থমকে যাবে আমার স্বপ্নেরা! আর কতবার সেটা নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে আমার!
নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগল।
গালে ছোঁয়ানো হাতদুটো যেন ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে আছে। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আমার নামার সময় হয়ে এসেছে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। ওমা তিনটে বেজে গেছে!
আমাকে খুব দ্রুত কেনাকাটা করতে হবে। এখানে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র দুটো ঘণ্টা সময় আমার হাতে। মনে মনে একটা লিস্ট করে ফেললাম কী কী কিনবো তার।
বড় বড় সব দোকান।
ঘুরতে ঘুরতে দোকানগুলোর শোকেইছে সাজিয়ে রাখা কত কিছুতেই না চোখ আটকে যায়। একবার দেখেও আবার চোখ ফিরিয়ে নেই আমি। একটা সময় ছিল যখন কেনাকাটার নেশা ছিল খুব। তোমাকে ধরে নিয়ে যেতাম বা কখনো আম্মাকে। নিজের চেয়ে তোমার জন্যে, বাসার জন্যে, মা-বাবার জন্যে কিনতেই বেশি ভালো লাগতো। একবার তোমার জুতো কিনতে গিয়ে সারা ঢাকা শহর চষে ফেললাম আমরা। তুমি হাল ছেড়ে দিলে কিন্তু কোন মতেই আমার কিছু পছন্দ হয় না। মনে আছে শেষে তুমি কান্না কান্না চেহারা করে বলেছিলে,
আজ থেকে আমি হিমু হয়ে গেলে কেমন হয়?
আমি আর জুতোই পরলাম না। খালি পায়ে হাঁটা হাঁটি শুর করলাম। জুতো কেনার আর ঝামেলাই থাকলো না, কি বলও?
আমি হাসতে হাসতে তোমার ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম পরের দোকানটায়।
আজকেও আমাকে জুতো কিনতে হচ্ছে। তবে সেটা কাউকে সঙ্গে করে নয়। আমার বরের দুই ছেলে, সুমন আর সাদিব। ওদের দুজনেরই জামা-জুতোর মাপ আছে। তাই দিয়ে পছন্দ করে কিছু কাপড়চোপড় আর ফুটবলের জুতো কিনতে হল।
ওদের আমি কখনোই সামনা সামনি দেখিনি ছবিতে ছাড়া। কিন্তু ওদেরকে আমার পর মনে হয় না খুব একটা। আমার বিয়ের সময় ছোট ছেলেটা ছিল চার আর বড় জন ছিল ছয় বছরের। ওরাও এই দেশেই থাকে ওদের মায়ের সাথে তবে অন্য শহরে। আমার বর প্রায় প্রতি উইক এন্ডেই চলে যান ছেলেদের কাছে।
হয়তো ওনার ছেলেরা কখনো জানতেও পারে না প্রতিবার তাদের জন্যে তাদের বাবার নিয়ে যাওয়া জামা-জুতো কত আদরেই না কিনে দেই আমি। ওদের কথাই বা বলছি কেন!
ওদের মাই কি জানে, যখনই আমি কোনও ভালো গয়না বা কাপড় কিনি উনি বলেই দেন ওদের মায়ের জন্যেও যেন নিয়ে আসি।
প্রথম দিকে খুব অস্বস্তি হত।
মনে হত এ কেমন ঘর আমার? যেখানে অদৃশ্য কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি ঘুরে বেড়ায় আমারে না বলে কয়ে।
তারপর দিনে মাসে বছরে....
এই অদৃশ্য মানুষগুলোও ধীরে ধীরে আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। হয়তো ওরা সেটা কখনোই জানবে না। আমার মনে হয় জানবার দরকারই বা কি। ঐ মহিলার নাও ভালো লাগতে পারে তার বরের প্রতি আমার অংশীদারিতে। তার হয়তো কোন অতীত নেই। তার স্বপ্নেরা হয়তো এই লোকটিকে ঘিরেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তার ঐ সামাজিক মর্যাদার যায়গাটুকু নেয়ার লোভ আমার কোনোদিনই হয়নি। আমি কখনোই চাইনি সমাজে স্বীকৃত ভাবে ওনার বউ হিসেবে যায়গা করে নিতে।
আমি তো বউ হয়েছিলাম। কেউ একজন খুব আদর করে আমাকে বউ করে বাসরে নিমন্ত্রণ করেছিলো।
জানি, তুমি হয়তো আড়ালে হাসছ আমার এই কথায়। ভাবছ এই কথা বলার যোগ্যতা তো আমি হারিয়েছি অনেক আগেই। যদি তুমি সত্যিই এমন ভাবে বলতে তাও আমি কিছুই উত্তর করতাম না। আসলে কিছুই তখন বলার থাকত না আমার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম।
মা আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের কাগজটা দেখিয়ে বলেছিল এগুলো কি? আমার সব ছাপিয়ে মনে হল তুমি কোথায়। তাই জিজ্ঞেস করাতে আমার দিকে যেন অভিশপ্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন আমার মা।
আমি পাগলের মত জানতে চাইছিলাম তুমি কেমন আছ। তার উত্তরে সজোরে আমার গালে এক চড় বসিয়ে দিয়ে মা বলেছিলেন বাড়ি চল।
সবার চিন্তা ছিল কি করে আমার এই কুকীর্তির দুর্নাম থেকে ফ্যামিলিকে বাঁচানো যায়।
বাড়িতে সব আত্মীয় স্বজনদের ভিড় আর ফিসফিসিয়ে কথা বলা। সে যে কি অদ্ভুত অসহ্য সময়। মাকে বার বার করে অনুরোধ করছিলাম অন্তত একবার আমাকে জানাতে তোমার কী অবস্থা? একবার আমাকে যেতে দিতে তোমাকে দেখতে?
আমার কোন অনুরোধই আমার মাকে টলাতে পারেনি তখন এতোটুকুন।
তোমার মারা যাবার কথা জানতে পারি তিনদিন পর।
মিলি এসেছিলো বাড়িতে। ঐ যে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ফর্সা করে মেয়েটা। আমি আমার ঘরের বিছানায় শান্ত হয়ে বসেছিলাম। ও এসে আমার পাসটায় চুপ করে বসল কিছুক্ষণ। জানালো ডিপার্টমেন্টের সবাই তোমার বাড়ি গিয়েছিলো। খুব কাঁদছিলেন তোমার মা। আর বারবার করেই আমাকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন তার ছেলেকে মেরে ফেলার জন্যে। মিলি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার খুব চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ওর কীংকর্তব্যবিমুড় চাহনী আমাকে বুঝিয়ে দিল আমার অবস্থান। সেদিন আমি কাঁদতে পারিনি। অসাড় লাগছিলো সবকিছু।
তোমাকে ছাড়াই বাকিটা জীবন বেঁচে থাকতে হবে এই ধাক্কাটাই এতো বড় লাগছিল যে নিজের বিধবা হবার দুঃখটুকু আলাদা করে কোন কষ্ট তৈরি করতে পারেনি তখন।
মিলি চলে যাবার পরও একটা লম্বা সময় পর্যন্ত চুপ করে বসে ছিলাম আমার বিছানাটাতে। সেদিনের পরও বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে বহুদিন পর্যন্ত আমি ঐ বিছানতেই চুপ করে বসে থাকতাম।
কেনাকাটা শেষে রাস্তার পাশের একটা কফি শপে বসে কফি খাচ্ছিলাম আর মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া করছিলাম পুরনো এই কথাগুলো।
কফি শপটা বেশ বড় সড়ই। ভেতরকার সাজগোজ একটু পুরনো আমলের ইংরেজ ধাঁচের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচু ধরনের কিছু বড় বড় চামড়ার সোফা পাতা আর সাথে নিচু ছোট গোল টেবিল। একদিকে একটা বড় কাউন্টারের মত। শপটার বাইরের দিকের দেয়ালটা পুরু স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি। তাই ভেতরে বসেই বাইরের রাস্তাটা পুরোটাই দেখা যায়।
আমি বসেছি কাঁচের দেয়ালটার সাথে লাগানো একটা সোফায়। মুগ্ধ হয়ে তকিয়ে আছি চারটেতেই হঠাৎ করে নেমে আসা রাতটার দিকে। দোকানগুলো প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে নয়তো বন্ধের প্রস্তুতি চলছে। আমার চারপাশে ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। আমার নিজের মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই। নিজের কেনাকাটার ব্যাগ গুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে আমি টেবিলে রাখা কফির মগের দিকে ঝুঁকে বসে আছি। মগটাকে দুহাতে ধরে কফির উষ্ণতাটুকু নিজের ভেতরে নিয়ে নিতে চাইছি।
আমার পাশের একটা লম্বা সোফায় বসা দুটো ছেলেমেয়ে। ছেলেটা মেয়েটার জামার সামনের বোতামগুলো নিয়ে খেলছে। জামার বোতামগুলো ফিতে দিয়ে জড়ানো ভারি কারুকাজ করা। ছেলেটা দুষ্টুমি করে বোতামগুলো যেন খোলার চেষ্টা করছে। যেই পারছে না অমনি মেয়েটা খিলখিল করে হেসে গিয়ে ভেঙ্গে পরছে ছেলেটার গায়ের উপর।
ছবিটা দেখতে দেখতেই চোখে আমার ভেসে উঠলো কোন এক মেঘলা দিনের কথা।
মুহূর্তেই চলে গেলাম এক ধোঁয়াটে দিনের ভালোবাসার স্মৃতিতে......
ক্রমশ......।
া
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১২ বিকাল ৫:১৭