আমাকে আমি যেন ঠিক চিনতে পারিনা কখনো কখনো। আমিটা যেন
আমার সাথে নেই আর। এই আমি যেন শুধুই ছায়া,,তাইতো আজ আর কোন আঘাতেরই প্রতিফলন নেই। মাঝে মাঝে শুধু পুরনো কিছু আনন্দ এসে একটু হয়তো নাড়া দিয়ে যায়। আমি নিজের মনেই হেসে উঠি কখনো হঠাৎ। কত কি যে মনে পরে আমার।
আমি বড্ড কবিতা ভালবাসতাম। তবে খুব একটা পড়া হতো না কখনোই। তারচেয়ে বরং নিজের মনে আওড়ানোই হতো বেশি। তোমার মনে আছে,,সেই রাতগুলো? সেই রাস্তাটা?হয়তো তোমার আছে মনে,নইলে তোমার শেষ চিঠিটাতে তুমি.......
আমার কলম আর এগোল না,,
উনি ডাকছেন,,
আমার বর। ওনাকে এখনো আপনি করেই ডাকি আমি। বিয়ের প্রায় দুবছর পেরিয়ে গেলো তবু তুমি বলাটা ঠিক রপ্ত হয়ে ওঠেনি আমার। বর কে কখনো আপনি করে ডাকবো এমনটা ভাবিনি কিন্তু এখন ডাকতে গিয়ে আমার যে খুব একটা আফসোস হয় তা কিন্তু না। আহ্ আসছি তো,, এবার ওনার ডাকের উত্তরটা একটু গলা চড়িয়েই দিলাম আমি।
টেবিলে লেখার খাতাটা বন্ধ করে রেখে, উঠে গেলাম নিজের ঘরের দিকে।
- কি হল কিছু লাগবে?
- হুঁ, না তা লাগবে না, আচ্ছা তোমাকে যে বলেছিলাম সুমন, সাদিবের জন্যে কিছু কেনাকাটা করতে, করেছিলে?
-আজকে! আজ তো রবিবার, শুধু আজকের দিনটাতেই আমি একটু বাড়ি থাকি আপনি ভুলে গেছেন? সকালে তো বললাম কাল ক্লাস শেষ করে শহরে যাবো একবার। তখন আপনার ছেলেদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই নিয়ে আসবো মনে করে।
আমার মুখ কালো করা দেখেই হোক আর নয়তো ক্লান্তির কারণেই হোক উনি যেন একটু বিরক্তই হলেন। কপাল কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন খাবার গরম দিতে,খেয়ে শুয়ে পরবেন তাড়াতাড়ি।
এখানকার শীতের এর এই সময়টা আমার বেশ অদ্ভুতই লাগে। এখনো দশটাই বাজে নি কিন্তু বাইরে দেখে মনে হচ্ছে মধ্যরাত পেড়িয়ে গেছে। এখানে একে তো দিনের আলো শেষ হয় তাড়াতাড়ি তার উপরে আমরা থাকি শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। শহরের মত কোলাহল না থাকায় আশেপাশের সবাই সন্ধ্যে হতে না হতেই রাতের খাবার শেষ করে ঘুমের আয়োজন শুরু করে দেয়। আটটা বাজার আগেই মনে হয় নিশুতি রাত চারিদিকে। আমরা অবশ্য বেশ রাত করেই শুতে যাই সেই তুলনায়। কি করবো,
উনি রোজই রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফেরেন বেশ রাত করে। যদিও ওনার আসার অপেক্ষায় আমি না খেয়ে বসে থাকবো এটা উনি আশা করেন এমনটা না তবুও আমার নিজের মনে হয় আমি বসে থাকলে উনি খুশি হন।
আর তার চেয়ে বড় কথা হল আমার নিজেরও একা একা খেতে ভালো লাগে না।
জানলা দিয়ে বাইরের কণকণে ঠাণ্ডা রাতটার দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেলো হঠাৎ। ভেতরে ভেতরে যেন একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ও পড়লো। আমি একে একে খাবারগুলো মাইক্রোওয়েভে গরম করে টেবিলে রাখছি এমন সময় এ ঘর থেকেই শুনতে পেলাম আমার বর কারো সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছেন। কারো ফোন এসেছে। আমি শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে দাড়িয়ে ইশারায় বললাম ফোন রাখতে।
- আপনিই না তাড়াতাড়ি খেতে চাইলেন,, এখন আবার লম্বা গল্প শুরু করে দেবেন না কিন্তু?
ওনাকেও দেখলাম বেশ তাড়াতাড়িই ফোন রেখে এসে খাবার টেবিলে বসলেন। খাওয়া শেষে উনি উঠে গেলে আমি রান্নাঘরে সব গুছিয়ে রেখে শোবার ঘরে এসে দেখি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরেছেন এর মধ্যেই। আমিও বাকী ঘরগুলোর বাতি নিভিয়ে কাপড় বদলে ড্রেসিং কেবিনেটের সামনে এসে বসলাম। আয়নার সামনের ছোট্ট আলোটা জ্বেলে দিয়ে নিজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। রাতে মাখার ক্রিমটার দিকে হাত বাড়িয়েও হাতটা গুটিয়ে নিলাম আবার ভাবলাম কি হবে নিজের যত্ন নিয়ে। একটু নাহয় অবহেলাই করি। ফিরে গিয়ে বিছানার একপাশ দিয়ে আস্তে করে কম্বলের ভেতর ঢুকে গেলাম।
শুয়ে পরলেও কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয় আমার জন্যে। এখন প্রায় প্রতিটি রাতই আমার জন্যে দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর। রাতগুলো যেন কিছুতেই ভোর হতে চায় না এখন আর। আমি ক্লান্তিহীন চেয়ে দেখি রাতের গভীরতা। থম ধরা রাতের নিস্তব্ধতায় আমার সামনে একটু একটু করে এসে দাড়ায় পুরনো আমি রা।
এইতো একটা দৃশ্য ভাসছে চোখের সামনে। তুমি আর আমি রিক্সায়। তুমি কিছু একটা বলছ, আমি মাথা নিচু করে হাসছি আর মাথা নাড়ছি। তুমি বারবার হাত নেড়ে আমাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছ কিন্তু আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হেসেই যাচ্ছি। বাতাসের সাথে আমার খোলা চুল উড়ছে। তুমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছো আমার দিকে। তুমি তখন কি বলেছিলে আজ আর আমার মনে নেই কিন্তু আমার মুখে যে লাজুক লালচে একটা আভা ছিল সেটা যেন আমি এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই। কি অবিশ্বাস্য সুন্দর ছিল সময়টা তোমার সাথে।ছোট্ট মুহূর্তটাতে কত মায়াই না জড়ানো ছিল। ঐ সময়ের খুশিটা এখনো যেন আমার মন ছুঁয়ে যায়,, একটা শূন্যতা তৈরি করে তুমি না থাকার........
হঠাৎ আমার পাশে শোয়া মানুষটা ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠতেই ভাবনার মেঘগুলো যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেলো। চোখ বুজে পাশ ফিরলাম আমি। বুঝতে পারলাম চোখের কোণা দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।
ক্রমশ....।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১২ বিকাল ৩:৫২