বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ قَالُواْ إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।
(সুরা বাকারাঃ আয়াত-১১)
২রা আগস্ট ১৯৯০ সাল। সাদ্দাম হোসেইনের অনুগত সেনাবাহিনী তৈল সম্পদে সম্মৃদ্ধ কুয়েতের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে কুয়েত দখল করে নিয়েছে। সৌদী আরব ইরাকী আগ্রাসনের ভয়ে আতংকগ্রস্থ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আরব উপদ্বীপে ইরাককে প্রতিহত করতে সৈন্য সমাবেশ করে যার নাম দেয়া হয় ‘ডেজার্ট শিল্ড’। এর ফলস্রুতিতে অনেক গুলো কুটনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় যা খুব দ্রুত ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এক হতাশাজনক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। ১৭ই আগস্ট, ১৯৯১ সাল, ‘ডেজার্ট শিল্ড’ ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে’ রূপান্তরিত হয়।
সি এন এন এবং বিবিসির মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, এই মিডিয়া গুলো সে প্রোপাগান্ডাতে অংশ নিয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে সাদ্দাম হোসেইনের চাইতে প্রযুক্তি, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অনেক গুন উন্নত একটি শক্তি কিভাবে সাদ্দামের শক্তিকে নির্মূল করে। যেটা মানুষ খুব কমই জানে, তা হোলো, দৃশ্যপটের বাইরে থেকে কিভাবে একটি অভিজাত শ্রেণী এ যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন করল, নিয়ন্ত্রণ করল এবং যুদ্ধের গতিধারা তাদের খেয়াল খুশীমত চালিত করল। মায়াবী বলে একটি গোষ্ঠি, কিভাবে এক ব্যাক্তিকে, যিনি লক্ষাধিক সৈন্যের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিকারী হিসাবে প্রচার করল, যিনি কিনা অতি শীঘ্রই পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে যাচ্ছে বলে বিশ্ববাসীকে জানান দিল। এক ব্যাক্তি, যিনি কিনা রাতারাতি পৃথিবীর ১/৫ অংশ খনিজ তেলের মালিক বণে গেল বলে আওয়াজ তুলল। বাস্তবে ব্যাক্তিটি অসংখ্য দাবার ঘুঁটির মধ্যে মাত্র একটি ঘুঁটি । যে ছিল উপসাগরীয় যুদ্ধের মহাপরিকল্পণার পুতুল নাচের একটি পুতুল, যে পুতুল বাদক দলের সরদারের ইশারায় নাচে। এই গীতিনাট্যের পরিচালকরা কোনো অবস্থাতেই বিশ্বের ঘটনা নিয়ন্ত্রনে আগন্তক নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা এ কাজটি অনেক শতাব্দী ধরে করে আসছে।
ছায়ার ভেতরে বসে তারা প্রতিটি বৃহৎ যুদ্ধ, বিপ্লব কিংবা মন্দার নকশা করেছে। আপনি যা পড়েন, শোনেন এবং দেখেন তার সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে । একটি পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে তারা তাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করতে পেরেছে যারা তাদের মত করে চিন্তা করে, তারা কর্তৃত্বের গুরুত্ব পূর্ণ স্থান গুলোতে তাদের প্রতিনিধিকে দায়িত্বে রাখতে পেরেছে এবং সেই ছায়ার ভেতর থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্ব-ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছে । তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পরিপূর্ণ বৈশ্বিক কর্তৃত্ব অর্জন করা, আর এটা তারা করবে যে কোনো মুল্যে, কোনো কিছুতেই তারা থামার নয়। এটা সেই লক্ষ্য যা ১৯৯০ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (সিনিয়র) এর কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, “ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাস্ট্রগুলোর স্বার্থ বিপন্ন হলেও একটি বৃহৎ ধারণা অর্জিত হবে, যা একটি নতুন বিশ্ব ব্যাবস্থা” [A NEW WORLD ORDER]
এই বৈশ্বিক পরিকল্পনা কিন্তু হোয়াইট হাউজে বসে তৈরী হয়নি। বাস্তবে এর শিকড় প্রায় হাজার বছর পুরনো একটি যুদ্ধে প্রথিত আছে, সালটি হলো ১০৯৫ ঈসায়ী, আর স্থান হলো ক্লেয়ারমন্ট, ফ্রান্স । একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রকৃত পক্ষে গির্জার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো, জনসাধারণের মন-মজ্জার উপর এর শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিলো। গির্জার এই ক্ষমতার বলেই পোপ ২য় এরউইন মুসলমানদের খিলাফতের সাথে ক্রুসেডের যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করার জন্য ক্রুশের যুদ্ধ। ৬৩৭ ঈসায়ী সাল থেকে জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনস্থ ছিল, কিন্তু ১০৯৯ সালে হঠাৎ এর উপর মুসলমানদের শাসনের রক্তাক্ত অবসান ঘটে। ক্রশের নামে মুসলমান নারীদের ধর্ষন ও হত্যা করা হয়েছিল, শিশুদের উপর তরবারী চালানো হয়েছিল, এটা বলা হয়ে থাকে যে, জেরুজালেমের রাস্তায় রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল যার উচ্চতা ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত উঠেছিল। রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখন্ডে একদল সন্ত্রাসী মানুষের উদ্ভব হলো যাদের কোনো অবস্থাতেই প্রতিহত করা সম্ভব ছিলনা যতক্ষণ পর্যন্ত তারা যা চায়, যে কোনও কিছুর বিনিময়ে তা অর্জিত হয়। জেরুজালেমের পতনের বিশ বছর পর একদল সন্যাসী যোদ্ধা ‘ডোম অফ রক’ অবরোধ করে যারা নিজেদের বলতো সোলেমনের মন্দির রক্ষাকারী যোদ্ধা (knight), সহজ ভাষায় ‘Knights Templers.’
জেরুজালেমে ক্রমেই মন্দির রক্ষাকারী যোদ্ধারা ( এখন থেকে টেমপ্লার নামে অভিহিত করা হবে) খ্রীস্টান ধর্ম চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তারা ইহুদীদের গোপন শিল্প চর্চা এবং ইহুদী যাদু বিদ্যা [কাবালা] ও তার সাথে সাথে প্রাচীন কালো আচার আচরণ শিক্ষা করে। ইহুদীরা যখন প্রাচীন মিশরে ফেরাউনদের দাসত্ব করত, তখন এই বিদ্যা পৌত্তলিক দের কাছে থেকে শিখেছিল, তারা পরবর্তিতে ব্যাবিলনে নেবুচাদনেজারের রাজত্বের সময় এই বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধন করে। ১৩০৭ সালে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ এদের (Knight Templers) খ্রীস্ট ধর্ম প্রত্যাখ্যান, সমকামীতা, মূর্তি পুজা এবং কালো জাদু চর্চার অপরাধে গ্রেফতার করেন । ১৩১৪ সালে পোপ ৫ম ক্লেমন্ট তাদের ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করেন এবং সকল সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন। তাদের নেতা চেকথেমোলে কে আটক করে পুড়িয়ে মারা হয়। টেমপ্লারদের কঠোর হস্তে দমন করা হয়, এবং যখন আপাত দৃষ্টিতে মনে হলো তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া অবস্থায় তারা একটি আশার আলো দেখলো এবং নতুন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ব্রতী হলো, কিন্তু তা কোনো মতেই ফ্রান্স নয়, একটি দেশ যা ইংল্যান্ড হতে স্বাধীন হওয়ার সংগ্রামে অবতীর্ণ । দেশটি হলো স্কটল্যান্ড। উইলিয়াম ওয়ালেসের মৃত্যুর সাথে সাথে দেশটির স্বাধীনতা লাভের সকল আশা অস্তমিত হয়। স্কটল্যান্ডে টেমপ্লারদের আগমণ তদানীন্তন খমতাচ্যুত রাজা রবার্ট ব্রুসের নিকট নতুন গোপন অস্ত্র হিসাবে বিবেচিত হলো। দুইশত বৎসর ব্যাপী ইসলামের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের যে অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছিল তা তাদের দক্ষ যোদ্ধা ও নিপুন সমর কুশলী হিসাবে গড়ে তুলেছিলো এবং যে কোনো সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট ছিলো । ১৩১৪ সালে টেমপ্লাররা রবার্ট ব্রুসের সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দিলো এবং সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজদের বিরূদ্ধে অনেক দিনের প্রত্যাশিত শক্তিমত্তা প্রদর্শনের পর ব্যানোক বার্ণ দখল করে নেয়। রবার্ট ব্রুসের দূরদৃষ্টির জয় হলো, মাত্র সাড়ে ছয় হাজার স্কটিশ সৈন্যের নিকট ২৫০০০ সৈন্যের দোর্দন্ড প্রতাপ ইংরেজ বাহিনী অপমানজনক পরাজয় বরণ করে। একটি স্বাধীন স্কটল্যান্ডের স্বপ্ন অবশেষে সত্যে পরিণত হয়। টেমপ্লাররা ধংসের কিনারা থেকে নিজেদের পুনরুত্থান ঘটান এবং পূনর্বার ধংস হতে আর তারা রাজী নন। এখন থেকে তারা রাজাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের গোপন অনুশাসন কে রক্ষার স্বার্থে তাদের মৃত্যু বরণ করতে হবে, আরো পরিস্কার ভাষায় তাদের নামকে মরতে হবে।
টেমপ্লারদের মধ্যে যারা ইউরোপ থেকে পলায়ন করে এসেছিলো তাদেরকে মৃত্যুর পর স্কটল্যান্ডে রোভেলীন চ্যাপ্লেইন এর আঙ্গিনায় সমাধিস্থ করা হয়। যা আজও তাদের উপস্থিতির কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে স্কটল্যান্ডের ক্ষমতা তাদের বংশধরদের হাতে চলে আসে। ১৬০৩ সালে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারীর অভাবে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সুবাদে স্কটল্যান্ডের রাজা ৫ম জেমস ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন, ফলশ্রুতিতে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড যুক্ত হয়ে নতুন এক শক্তি ও রাজত্বের উদ্ভব হয় এবং স্কটল্যান্ডের ওপর টেমপ্লারদের যে ক্ষমতা ছিলো তা ইংল্যান্ড অবধি বিস্তৃত হয় যা পুরো গ্রেট ব্রিটেনকে তাদের হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম করে। একশত বছরের বেশী সময় ধরে তারা তাদের কর্মকান্ড গোপণ রেখে পর্দার অন্তরালে মিলিয়ে যায়, ততদিনে খুব কম মানুষই তাদের চিনত বা জনসাধারণের মানস থেকে তারা হারিয়ে যায়। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই তারা ব্রিটেনের ওপর থেকে তাদের মুষ্ঠি শিথিল করেনি। এই সময় ধরে তারা পরিকল্পনা করছিলো, নতুন ভাবে সংগঠিত হয়ে ক্ষমতার বলয়ের সকল স্থানে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রাজত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৭১৭ সালে ইউরোপে টেমপ্লারদের পুনরাবির্ভাব ঘটে, ইতিমধ্যে সংখ্যায় এবং শক্তিতে অনেক গুন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে এবং তারা তাদের এক নতুন পরিচয় নিতে প্রস্তুত যা অতীত সুনাম/ দূর্নাম হতে মুক্ত। তাদের এই নতুন পরিচয়ের স্বীকৃতি ইংল্যান্ডের রাজা এবং অভিজাত তন্ত্রের মধ্য থেকেই আসে । তারা যে নামটি পছন্দ করে তা অনেকের কাছেই পরিচিত কিন্তু খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই এর অন্তর্নীহিত তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম, নামটি হলো ফ্রিমেসনস ("THE FREE MASONS )
সূত্রঃ RESEARCH BY SIRAJ WAHAJ AND HIS TEAM
বিশ্ব কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় - ২য় পর্ব ( রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন) )
RELATED READINGS:
কামাল আতাতুর্ক কে ছিলেন ইহুদী? ফ্রী-মেসন ?-শেকড়ের সন্ধানে ( পর্ব-৩)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৩২