মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক
ভূমিকাঃ
কে ছিলেন কামাল আতাতুর্ক? প্রশ্নটা আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন বা সাদা-মাটা । আধুনিক তুরস্কের স্থপতি, যিনি তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর (গাজী), মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ কারী যে ব্যাক্তিটি উসমানী খিলাফতের বিলুপ্ত সাধন করেন, যার নামে ঢাকা শহরে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে , যাকে নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় স্ততি রচনা করেছেন “ কামাল তুনে কামাল কিয়া”। ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে সামান্যতম ধারণা আছে এমন যে কোনো ব্যাক্তি এগুলো জানেন? তাছাড়া মুস্তফা কামাল পাশার সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে আমার লিখা ব্লগ “ মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও ইসলাম বিদ্বেষ” এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি বলেন তুর্কী জাতির পিতা কামাল আসলে তুর্কী বংশোদ্ভুতই নন, তিনি একজন ইহুদী এবং ফ্রী-মেসন, তাহলে অনেকেই হয়ত আঁতকে উঠবেন? আসুন আমরা জানার চেষ্টা করি উপরোক্ত দাবীর কোনো সারবত্তা আছে কি না?
সালোনিকাঃ
মানচিত্রে সালোনিকা’র অবস্থান ( তীর চিহ্নিত)
সালোনিকা (Salonica) এজিয়ান সাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত বর্তমান গ্রীসের একটি সমুদ্রবন্দর এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ১০০ বছর ধরে কন্সটান্টিনিপলের পরেই এটি বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৪৩০ সালে উসমানী সুলতান ২য় মুরাদ সালোনিকা অধিকার করে নেন এবং এ কে উসমানী সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তখন থেকে প্রায় পরবর্তী ৫০০ বছর ধরে এটি সম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং সমুদ্র বন্দর হিসাবে পরিচিত ছিল। শহরটি উসমানী সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তুর্কী মুসলমানেরা এখানে বসবাস করা শুরু করে, শহরের অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল অর্থোডক্স খৃস্টান এবং জাতিগত ভাবে পুর্ব ইউরোপীয়।, উসমানী সম্রাজ্যের পুরো সময় জুড়ে মুসলমানেরা এখানে সংখ্যালঘু ছিল। এ শহরের জনসংখ্যার দ্বিতীয় বৃহৎ পরিবর্তন সাধিত হয় ১৪৯২ সালে স্প্যানিশ ইঙ্কুইজিশনের সময়। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড এবং রাণী ইসাবেলা ইহুদীদের স্পেন থেকে বহিস্কার করেন। উসমানী সম্রাজ্যের তদানিন্তন সুলতান দ্বিতীয় বায়েজীদ ইহুদীদের তার সম্রাজ্যে আমন্ত্রন জানান এবং বসবাসের অধিকার প্রদান করেন। স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের অধিকাংশ তখন সালোনিকাতে বসবাস শুরু করেন করেন। তখন থেকেই শহরটি তিন ধর্মের মিলনস্থলে পরিণত হয়।
সালোনিকাতে তিন ধর্মের নারী
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে উসমানী সম্রাজ্যের বৃহত্তম ইহুদী বসতি ছিল সালোনিকাতে, যা দেখে ইসরাইলের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত হন যে, উসমানী ইহুদীদের নিয়ে ইসরায়েল রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ১৯১৩ সালে গ্রীসের কাছে সালোনিকার পতন হয়, তখন থেকে এটা গ্রীসের অন্তর্গত একটি শহর।
এই সালোনিকাতেই ১৮৮১ সালে আলি রিজা এবং জুবায়দা দম্পত্তির ঘরে শিশু মুস্তফা’র জন্ম হয়।
সাবাতি জেভিঃ
সাবাতি জেভি
সাবাতি জেভি একজন ইহুদী সেফার্ডিক রাব্বি (Sephardic rabbi, সেফার্ডিক বলতে মুলত বোঝায়, যারা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে উসমানি সম্রাজ্যে আশ্রয় নেয়) ছিলেন, এবং কাবালা যাদুবিদ ছিলেন। তার জন্ম ১৬২৬ সালের ১লা আগস্ট স্মিরনা (Smyrna), বর্তমানে তুরস্কের ইজমির এ। তাদের পুর্বপুরুষ ছিল রোমানিয়ান বশদ্ভুত যাদের বসতি ছিল গ্রীসের Patra অঞ্চলে। ১৬৪৮ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে ইহুদিদের বহুল প্রতীক্ষিত মাসিহ বলে নিজেকে দাবী করেন। ইজমিরের ইহুদীরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল, তারা তাকে মাসিহ হিসাবে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানান এবং ১৬৫২ সালে ইজমির থেকে বিতাড়িত করেন ।
নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি কন্সটান্টিনিপল গমন করেন, সেখানে তিনি কিছু অনুসারী জোগাড় করতে সমর্থ হন। সাবাতি সেখান থেকে সালোনিকাতে পাড়ি জমান এবং সম্রাজ্যের বৃহত্তম ইহুদী বসতিতে নিজের ঘাঁটি স্থাপন করেন। তিনি সারা নাম্নী এক পতিতাকে বিয়ে করেন এবং ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত মাসিহ সংক্রান্ত ভবিষ্যিদবাণী প্রমাণ করেন।( তাদের ধর্ম গ্রন্থে ভবিষ্যদবাণী আছে যে মাসিহ একজন অসতী রমণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন) এতে তার অনুসারীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৬৬৬ সালে তিনি আবার কন্সটান্টনিপল গমণ করেন, এবং দাবী করেন রাজমুকুট তার মাথায় স্থাপিত হবে। তার এ দাবীর কারণে সুলতান তাকে গ্রেফতার করেন, তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলা হয়, নতুবা রাজদ্রোহীতা এবং ধর্মদ্রোহীতার কারণে তাকে মৃত্যু দন্ড প্রদান করা হবে। তিনি প্রথমটি গ্রহণ করেন এবং ইহুদী রাব্বির পোশাক বর্জন করে মুসলমানদের পাগড়ি পরিধান করেন। সুলতান তাকে আফেন্দী উপাধি প্রদান করেন এবং ভাতার ব্যবস্থা করেন। তার সাথে সাথে তার তিনশত অনুসারী পরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ইতিহাসে এই ধর্মান্তরিত গোষ্ঠি কে Domneh ( ধর্মান্তরিত ) বলা হয়। সাবাতি জেভি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরও তার ইহুদী ধর্ম চর্চা অব্যাহত রাখেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণ হিসাবে ইহুদীদের বলেন যে, তিনি মুসলমানদের মাঝে ইহুদী ধর্মের প্রচার করছেন। অপরদিকে সুলতানের কানে ব্যাপারটি গেলে তিনি সুলতানকে বলেন, আমি ইহুদীদের ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। তার প্রচেষ্ঠার ফলে তার অনুসারীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। এরা প্রকাশ্য ইসলাম ধর্ম চর্চা চালিয়ে গেলেও সিনাগগে যেত এবং গোপনে বাড়িতে ইহুদী দের আচার –প্রথা পালন করতে থাকেন। আর এ কারণেই ইতিহাসে এদের গুপ্ত ইহুদী ( Crypto Jew) বলা হয়।
১৬৭৪ সালে তিনি তার অনুসারী সহ সালোনিকাতে ফিরে যান এবং ১৬৭৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সালোনিকার জনগোষ্ঠির মধ্যে বৃহত্তম অংশ ছিল Domneh. এরা পরবর্তীতে সম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভুমিকা রাখে। ১ম বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সালোনিকাতে ১৫০০০ Donmeh ছিল, ১৯১৩ সালে গ্রীসে অন্তর্ভুক্তির আগে পর্যন্ত তারা সেখানেই বাস করেন।
ধর্মত্যাগী হিসাবে মুসলমান এবং ইহুদী উভয়ই তাদের ঘৃণার চোখে দেখত। সাবাতি জেভি তাদের যৌনতার দিক দিয়ে উচ্ছৃংখল হওয়ার স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। এদের বিয়ে-শাদী সব সময় নিজেদের মধ্যে হত।
“ বছরে একবার (Donme দের বাৎসরিক ভেড়া উৎসবের সময়) নৈশ ভোজের পর সব গুলো মোম বাতি নিভিয়ে দেয়া হতো, তার পর শুরু হতো বিকৃত যৌনাচার এবং স্ত্রী বদল------ এই আচার অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন টি ছিল সাবাতি জেভির জন্ম দিন...... । তাদের এই মিলনের ফলে জন্ম নেয়া শিশুটিকে ঋষি তুল্য জ্ঞান করা হ্তো।”
আলি রিজা, জুবায়দা ও DONMEH:
তুর্কী জনগোষ্ঠী মুসলিম, ইহুদী এবং খৃস্টানদের মধ্যে এমন কোনো বহুল প্রচলিত পরিস্কার কোনো প্রমান নেই যে, যাতে করে বলা যায় মুস্তফা কামালের পিত-মাতা বা তাদের কেউ একজন Domneh সম্প্রদায় ভুক্ত ছিলেন।
কে ছিলেন তার পিতা আলি রিজা? তার সম্মন্ধে খুব কমই জানা যায়। তিনি সালোনিকাতে একজন কাস্টমস এর কেরানী ছিলেন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর যিনি দুই দুই বার ব্যাবসা প্রচেষ্টায় ব্যার্থ হন এবং মদের ভেতর নিজের আশ্রয় খুজে নেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই তার মৃত্যু হয়।তার আদিনিবাস নিয়ে জীবনী লেখকদের মধ্যে মত-পার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন তিনি আনাতোলিয়ান, কেউ বলেন সালোনিকান কিংবা কেউ বলেন তিনি আলবেনিয়ান। তার মা জুবায়দা আলবেনিয়ান সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মেয়ে, তিনি ইসলামের প্রতি নিবেদিত প্রান একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন।
কিন্তু তার জীবনী লেখকগণ তার নিজের জবানীতে পিতা-মাতার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নরূপঃ
“ আমার বাবা ছিলেন উদার চিন্তার অধিকারী একজন মানুষ, বরং তিনি ধর্মের প্রতি একজন শত্রু ভাবাপন্ন ব্যাক্তি এবং পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি আমাকে এমন একটি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন যে, যেখানে শিক্ষা ব্যাবস্থা কুরান- সুন্নাহ ভিত্তিক নয় বরং তা আধুনিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
ধ্যান-ধারনার এই যুদ্ধে, একটি ছোট কৌশলে আমার বাবা জয় লাভ করেন। তিনি ভান করেন যে, আমার মায়ের উদ্দেশ্য পুরণের জন্য, আমাকে ঐতিহ্য বাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘ফাতমা মোল্লা কাদিন’ এ একটি ইসলামিক স্কুলে ভর্তি করেন......
ছয় মাস অথবা তার কম বেশী পর তিনি আমাকে সেখান থেকে চাড়িয়ে নিয়ে আসেন এবং পুরাতন ‘শেমসি আফেন্দী প্রিপারেটরে স্কুলে’ ভর্তি করেন, যেখানে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে পাঠদান হতো। আমার মা আর আপত্তি করেননি, কেননা তার ইচ্ছা পুরন হয়েছিল। এটা শিক্ষা নয়, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, যা তাকে সন্তষ্ট করেছিল।” (FORWARD, A Jewish Newspaper published in New York, January 28, 1994)
Lord Kinross' compendious 1964 "Ataturk" এ তাকে একজন রহস্যাবৃত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়, সেখানে আরো উল্লেখ করেন যে, আলি রিজা কখনোই তার পারিবারিক ইতিহাস উন্মুক্ত করতে চাইতেননা।
এখানে দেখা যায় আলি রিজার আচরণ একজন Domneh’র আচরণের সাথেই সঙ্গতিশীল।
রেফারেন্সঃ
১। The City of Salonica: A true cross road by Victoria M. Lord
২। Weakipedia
৩।Exposed-ATATURK WAS A CRYPTO-JEWISH CABAL OPERATIVE & FREEMASON!
৪। FORWARD, A Jewish Newspaper published in New York, January 28, 1994
কামাল আতাতুর্ক কে ছিলেন ইহুদী? ফ্রী-মেসন ?-শেকড়ের সন্ধানে ( পর্ব-২)
কামাল আতাতুর্ক কে ছিলেন ইহুদী? ফ্রী-মেসন ?-শেকড়ের সন্ধানে ( পর্ব-৩)
কামাল আতাতুর্ক কে ছিলেন ইহুদী? ফ্রী-মেসন ?-শেকড়ের সন্ধানে ( শেষ পর্ব)
RELATED READING:
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (পর্ব-১)
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (পর্ব-২)
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (পর্ব-৩)
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (পর্ব-৪)
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:২০