প্রশ্ন: একজন লেখক হয়ে নির্বাসনে থাকতে কেমন লাগে?
তসলিমা নাসরিন: আমার জন্য এটি খুব কষ্টকর। আমার মনে হয় না আর কোনো লেখক এমন নির্বাসিত হয়েছেন কিনা। অনেক ক্ষেত্রে সরকার বদলেছে, দেশের পরিস্থিতি বদলেছে তারা আবার দেশে ফিরতে পেরেছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এর কোনোটিই হয়নি। কেউ আমার জন্য মত পরিবর্তন করেনি। তবে এখন সয়ে গেছে। আমি চাইলেই বাঙালিদের সঙ্গে থাকতে পারি। আমি শুধু নির্বাসিতই নই, আমাকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখানে আমার কোনো ভুল আছে বলে মনে করি না। আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে আমার বইগুলোকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো সংবাদপত্র আমার লেখা প্রতিবেদন ছাপে না। আমার জন্য এটি খুব ভয়াবহ অনুভূতি। যখন ফতোয়া জারি করা হলো, আমাকে রীতিমতো হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। সবাই শুনে অবাক হবেন যে, বুদ্ধিজীবীরা আমার পক্ষে কথা বলেনি। এমনকি সম্প্রতি কলকাতায় আমার বই নির্বাসনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। আমি খুব অবাক হয়েছি। অবশ্য এর আগে ২০০৮ সালে যখন আমাকে কলকাতা থেকে নিষিদ্ধ করা হয় তখনও খুব অবাক হয়েছিলাম। বাংলাদেশে যেমন সবাই মুখ বুজে ছিল ঠিক তেমন কলকাতাতেও হয়েছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাহসের অভাব রয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাসন প্রকাশিত হয়েছে এবং সেটির মোড়ক উন্মোচন হয়েছে এটি অবাক করার মতো বিষয় নয়?
তসলিমা নাসরিন: এটি করা হয়েছে অনানুষ্ঠানিকভাবে। মাত্র একটি অনলাইন পত্রিকা বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। এর মানে কিছুই বদলায়নি। এইতো কিছুদিন আগে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে কারণ তার কাছে ‘লজ্জা’ বইটি পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন: প্রায় দু’যুগ ধরে দেশের বাইরে আছেন, দেশের কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি মিস করেন?
তসলিমা নাসরিন: আমি আমার দেশে ফিরবার অধিকারটুকুই মিস করি। মানুষ হিসেবে আমার নিজের ঘরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। কেন আমার সে অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। যারা এটি করছে তারা অন্যায় করছে।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আপনার কলকাতা প্রবেশাধিকার দেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ। বিষয়টি কি আপনাকে হতাশ করেছে?
তসলিমা নাসরিন: আমি অনেকবার বিভিন্নভাবে তার কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি এবং কোনো কাজও করেননি। এখন আমি নিশ্চিত যে তিনি আমার কলকাতা যাওয়া অনুমোদন করবেন না। আমার এক বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন, কলকাতায় যারা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিল নির্বাচনী প্রচারণার সময় মমতার সঙ্গে তাদের দেখা গেছে।
প্রশ্ন: ভারত নারীদের জন্য চতুর্থতম বিপদজনক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গণমাধ্যমের এক জরিপে। একজন নারীবাদী হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
তসলিমা নাসরিন: ভারত সরকারের জন্য নিসন্দেহে এটি খুবই দুঃখজনক একটি বিষয়। আসলে এখানকার মেয়েদের অধিকার নিয়ে কেউই সচেতন নয়। যার ফলে কন্যাশিশুর ভ্রুণ হত্যা, ধর্ষণ, যৌতুকের কারণে মৃত্যু ও পারিবারিক নির্যাতন বেড়েই চলছে। এসবের বিরুদ্ধে এ দেশে কোনো শক্ত প্রতিরোধ দেখিনি। নারীদের কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই যারা লড়াই করবে। আমি আমার প্রতিটা লেখার মাধ্যমেই চেষ্টা করি নারীদের অবস্থানের বিষয়টি গণমানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে।
প্রশ্ন: আপনার ভারত থাকা নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি?
তসলিমা নাসরিন: ভারত সরকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে থাকার অনুমতি দিয়েছে। যদিও আমি ইউরোপের একজন নাগরিক কিন্তু ভারতে থাকতে আমি শান্তি পাই। ভারতের নারীদের নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। আমার কাজে যদি নারীদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় তবে আমি আমার জীবনের একটা মানে খুঁজে পাব।
প্রশ্ন: আবার জন্ম নেয়ার সুযোগ পেলে নিজের কী বদলে ফেলবেন?
তসলিমা নাসরিন: হয়তো এ জীবনে যে সব ভুল করেছি সে জীবনে করব না। কিন্তু আমার লেখা ও আমার চেতনা অপরিবর্তিত থাকবে। আমি অযৌক্তিক কারণে নির্বাসিত। আমি বোঝাতে চাই আমারও অন্যান্য নারীদের মতো অধিকার আছে। কারো ভুল বোঝার জন্য আমাকে কেনো কষ্ট পেতে হবে? আমি কোনো ভুল করিনি। আমি স্বাধীনতা, সাম্য, ববর্রতা, ও ধর্মান্ধতা নিয়ে কথা বলেছি। আমি প্রার্থনা করি এই মানুষগুলো সুস্থ হয়ে উঠুক যাদের পাগলামির জন্য আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: জীবনে কিসের জন্য অনুতাপ করেন?
তসলিমা নাসরিন: আমার মায়ের জন্য আমি অনুতপ্ত। তার সঙ্গে আমি অন্য সবার মতো বাজে আচরণ করেছি। যেমনটি আমার বাবা করতেন। সম্ভবত আমার বাবা আমাকে প্রভাবিত করেছেন এমন ব্যবহার করার জন্য। আমি কখনোই ভুলতে পারবো না যখন তিনি ক্যান্সারে ধুকে ধুকে মরেছেন আমি তার কোনো সেবা করিনি। তার অসুখটাকে আমি গুরুত্বই দিইনি। বাবা কোনোদিন আমার মাকে ভালোবাসেননি। সবসময় তাকে উপেক্ষা করেছেন। একই ব্যবহার তিনি আমার কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি ছিলেন নিপীড়িত। আমি নিপীড়িত নারীদের নিয়ে কত প্রবন্ধ লিখেছি অথচ কোনোদিন খেয়ালই করিনি এই নিপীড়িত নারীর জন্য আমার কিছু দায়িত্ব আছে। যখন আমি মেডিক্যালে পড়েছি তিনি সব সময়ের জন্য আমার পাশে ছিলেন, অথচ যখন তার নিজের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ল, যখন তার সেবা দরকার ছিল আমি কিছুই করিনি তার জন্য। আমার কাছে যে রোগীই আসতো আমি তার জন্য কিছু করেছি। কিন্তু তাকে আমি উপেক্ষা করেছি। এমন কি আমি জানতামই না তার ক্যান্সার হয়েছে। যদি প্রথম থেকেই তার চিকিৎসা করতে পারতাম। আমার খুব কষ্ট লাগে তিনি বেঁচে থাকতে আমার ভালোবাসা তাকে দেখাতে পারিনি। তার মৃত্যুর পর থেকে আমি কেঁদেই চলেছি।
সূত্র এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১২ সকাল ১১:৫০