প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
দীর্ঘ এক বছর আবার আসলাম সামুতে। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে গেছে আমার গত একটি বছর। আসলে দীর্ঘ সময় আমি ব্লগ থেকে দূরে ছিলাম, শুধু ব্লগ নয় ইন্টারনেট ও কম্পিউটার থেকেও দূরে ছিলাম। আশাকরি এখন থেকে নিয়মিত হব। দোয়া করেন সিরিজটা যেন তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারি। আর হ্যাঁ, কেমন আছেন সবাই?
আগের পর্ব গুলির ধারাবাহিকতায় আজ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পঠিত ছড়া ও কবিতা সমূহ তুলে ধরলাম।
জন্মেছি এই দেশে
সুফিয়া কামাল
অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভালো লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমুধুর।
আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কণ্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাষা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলী মাখা গায়
বড় গৌরবে মাথা উঁচু করি
মানুষ হইতে চায়।
পরিচয়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একদিন দেখিলাম উলঙ্গ সে ছেলে
ধূলি-পৈরে বসে আছে পা দুখানি মেলে।
ঘাটে বসি মাটি ঢেলা লইয়া কুড়ায়ে
দিদি মাজিতেছে ঘটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে।
অদূরে কোমললোম ছাগবৎস ধীরে
চরিয়া ফিরিতেছিল নদীতীরে তীরে।
সহসা সে কাছে আসি থাকিয়া থাকিয়া
বালকের মুখে চেয়ে উঠিল ডাকিয়া।
বালক চমকি কাঁপি কেঁদে ওঠে ত্রাসে,
দিদি ঘাটে ঘটি ফেলি ছুটে চলে আসে।
এক কক্ষে ভাই লয়ে, অন্য কক্ষে ছাগ,
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ।
পশুশিশু, নরশিশু, দিদি মাঝে প’ড়ে
দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয় ডোরে।
ওদের জন্য মমতা
কাজী নজরুল ইসলাম
এই যে মায়ের অনাদরে ক্লিষ্ট শিশুগুলি,
পরনে নেই ছেঁড়া কানি, সারা গায়ে ধূলি।
সারাদিনের অনাহারে শুষ্ক বদনখানি
ক্ষিধের জ্বালায় ক্ষুণ্ণ, তাতে জ্বরের ধুকধুকানি।
অযতনে বাছাদের হায়, পা গিয়েছে ফেটে,
ক্ষুদ ঘাঁটা তাও জোটে নাকো’ সারাটি দিন খেটে।
এদের ফেলে ওগো ধনী ওগো দেশের রাজা!
কেমন করে রোচে মুখে মন্ডা মিঠায় খাজা?
ক্ষুধায় কাতর যখন এরা দেখে তোমায় খেতে,
সে কি নিরব যাচঞা করুণ ফোটে নয়নেতে!
তোমাদের মা খোকার একটু গা-টি গরম হলে,
দশ ডাক্তার দেখে এসে; এরা জ্বরে মলে-
দেয় না মা কেও একটি চুমুক জলও এদের মুখে
হাড়-চামড়া হয়ে মরে মায়ের বুকে ধুঁকে!
তোমাদের মা খোকা-খুকি ঘুমায় দোলায় দুলে;
এদের ছেলের ঘুম পেলে মা, ঘুমায় তেঁতুলতলে।
একলাটি গো মাটির বুকে বাহুয় থুয়ে মাথা;
পাষাণ-বুকও ফাটবে তোমার দেখ যদি মা তা!
[সংক্ষেপিত]
বাংলা ভাষা
জসিমউদ্দীন
আমার এমন মধুর বাংলা ভাষা
ভায়ের বোনের আদর মাখা।
মায়ের বুকের ভালবাসা।
এই ভাষা- রামধনু চড়ে
সোনার স্বপন ছড়ায় ভবে
যুগ-যুগান্ত পথটি ভরে
নিত্য তাদের যাওয়া আসা।
পুব বাংলার নদী থেকে
এনেছি এর সুর
শ্যস্য দোলা বাতাস দেছে
কথা সুমধুর;
বজ্র এরে দেছে আলো
ঝঞ্ঝা এরে দোল দোলালো
পদ্মা হলো সর্বনাশা।
বসনে এর রং মেখেছি
তাজা বুকের খুনে
বুলেটেরি ধূম্রজালে
ওড়না বিহার বুনে।
এ ভাষার-ই মান রাখিতে
হয় যদিবা জীবন দিতে
কোটি ভাইয়ের রক্ত দিয়ে
পূরাবে এর মনের আশা।
[সংক্ষেপিত]
সুখ
কামিনী রায়
নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?
এ ধারা কি শুধু বিষাদময়?
যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?
বল ছিন্ন বীণে, বল উচ্চেঃস্বরে-
না-না-না মানবের তরে
আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর
না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।
কার্যক্ষেত্র ঐ প্রশস্ত পড়িয়া
সমর অঙ্গন সংসার এই,
যাও বীরবেশে কর গিয়া রণ
যে জিতিবে সুখ লাভিবে সে-ই।
পরের কারনে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারনে মরনেও সুখ,
সুখ সুখ করি কেঁদো না আর,
যতই কাঁদিবে, ততই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রতকে মোরা পরের তরে।
সকাল
হাবীবুর রহমান
কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা সকাল বেলা,
আকাশে ভাসাল আজ আলোর ভেলা।
গাছে গাছে চিক্চিক্
আলো হাসে ফিক্ফিক্
চালে চালে ঝিক্ঝিক্ এ কোন খেলা!
কাঁচা সোনা রোদ মাখা সকাল বেলা।
শাখে শাখে সে আলোর পরশ লাগে।
দিকে দিকে যেন কোন জীবন জাগে।
ফুলে ফুলে উতরোল
জাগরণ কলরোল
বাতাসেতে হিল্লোল প্রভাতী ফাগে!
দিকে দিকে জীবনের পরশ লাগে!
এসো আজ মুঠি মুঠি মাখি সে আলো।
ধুয়ে যাক মুছে যাক মনের কালো।
এ আলোর কুমকুম
দিয়ে যাক রাঙ্গাচুম
মন জুড়ে রেখে যাক অনেক ভালো।
এসো ভাই মুঠি মুঠি মাখি এ আলো।
প্রিয় স্বাধীনতা
শামসুর রাহমান
মেঘনা নদী দেব পাড়ি
কল-আলা এক নায়ে।
আবার আমি যাব আমার
পাহাড়তলী গাঁয়ে।
গাছ ঘেরা ঐ পুকুর পাড়ে
বসব বিকাল বেলা।
দু-চোখ ভরে দেখব কত
আলো-ছায়ার খেলা।
বাঁশবাগানে আধখানা চাঁদ
থাকবে ঝুলে একা।
ঝোপে ঝাড়ে বাতির মতো
জোনাক যাবে দেখা।
ধানের গন্ধ আনবে ডেকে
আমার ছেলেবেলা।
বসবে আবার দুচোখ জুড়ে
প্রজাপতির মেলা।
হঠাৎ আমি চমকে উঠি
হলদে পাখির ডাকে।
ইচ্ছে করে ছুটে বেড়াই
মেঘনা নদীর বাঁকে।
শত যুগের ঘন আঁধার
গাঁয়ে আজো আছে।
সেই আঁধারে মানুষগুলো
লড়ায় করে বাঁচে।
মনে আমার ঝলসে ওঠে
একাত্তরের কথা,
পাখির ডানায় লিখেছিলাম-
প্রিয় স্বাধীনতা।
ঠিকানা
আতোয়ার রহমান
বাংলাদেশে বাড়ি আমার
বাংলাদেশে বাড়ি,
তারই মধ্যে বসে আমি
মায়ের আদর কাড়ি।
ঝড় বাদলে কাঁপি আমি
বানের জলে ভাসি,
তারই মধ্যে মুখে আমার
রোদের মত হাসি।
হাসি নয় রে হাসি নয় রে
আগুন আগুন খেলা,
তারই মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম
ভিনদেশীদের ভেলা।
আর ভেঙ্গেছি হাটের মধ্যে
ভেলকিঅলার হাঁড়ি
বাংলাদেশে বাড়ি আমার
বাংলাদেশে বাড়ি।
মৈত্রী
আবদুল কাদির
সবারে বাসিব ভালো, করিব না আত্মপর ভেদ
সংসারে গড়িব এক নূতন সমাজ
মানুষের সাথে কভু মানুষের রবে না বিচ্ছেদ-
সর্বত্র মৈত্রীর ভাব করিবে বিরাজ।
দেশে দেশে যুগে যুগে কত যুদ্ধ কত না সংঘাত,
মানুষে মানুষে হল কত হানাহানি।
এবার মদের পুণ্য সমুদিবে প্রেমের প্রভাত,
সোল্লাসে গাহিবে সবে সৌহার্দ্যের বানী।
হিংসা দেশ রহিবেনা কেহ কা’রে করিবে না ঘৃণা
পরস্পরে বাধি দিব প্রীতির বন্ধনে,
বিশ্ব জুড়ি এক সুরে বাজিবে গো মিলনের বীণা
মানব জাগিবে নব জীবন-স্পন্দনে।
স্বার্থ-সুখ চাহি না কো, আত্ননিষ্ঠ কেহ মোরা নয়;
পরার্থে করিব বিশ্বে সর্ব বিসর্জন
আমাদের আত্মত্যাগে প্রতিগৃহে নামিবে অভয়
মর্তের মাটিতে হবে স্বর্গের সৃজন।
নোলক
আল মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে-
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
মানুষ জাতি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।...
বংশে বংশে নাহিক তফাত
বনেদি কে আর গর্-বনেদি,
দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ্
দুনিয়া সবারি জনম-বেদী।
জীবনের হিসাব
সুকুমার রায়
বিদ্যাবোঝাই বাবুমশায় চড়ি শখের বোটে
মাঝিরে কন, “বলতে পারিস সূর্য্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে।
বাবু বলেন “সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”
খানিক বাদে কহেন বাবু, “বল তো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বল তো কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু কহেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি।”
আবার ভেবে কহেন বাবু, “বল তো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বল তো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহন লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, “আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, “বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে উঠেছে ঢেও উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকোখানি ডুবল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, “একি আপদ ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল না নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো?” – মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে।“
হে কিশোর,
শোনো
মহাদেব সাহা
একদিন শোনো, এই দেশটাতে
দানবেরা দেয় হানা
পুড়ে ছারখার মাঠের শস্য
মানুষের আস্তানা।
বয় নিরবধি
রক্তের নদী,
শকুনেরা মেলে ডানা,
এই দেশটাতে একদিন শোনো,
দানবেরা দেয় হানা।
শোনো, একদিন এই দেশটাতে
মুক্তিযুদ্ধ হয়-
আমাদের প্রিয় মাতৃভুমির
ঘোচাতে দুঃখ-ভয়;
এই দুটি হাত
স্বাধীন-অবাধ,
হয়ে উঠে দুর্জয়-
হে কিশোর, শোনো,
আমরা সেদিন যুদ্ধ করেছি জয়।
উৎসর্গ- বাংলার সকল কবিগণ কে।
প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন।(১ম পর্ব)
প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন।(২য় পর্ব)
প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন। (৩য় পর্ব)
প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন। (চতুর্থ পর্ব)