প্রকাশ : ১২ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০:০০
পাহাড় ডাকল, সমুদ্র নাচল
টোকন ঠাকুর
গাঙপাড়ের ওপারে কৃষ্ণনগর গ্রাম, এপারে মধুপুর। মাতুলালয় কৃষ্ণনগরেই জন্ম আমার বাবার। বাবা বড় হলেন মধুপুরে, গাঙের এপারে। গাঙের নাম কুমার। এটা শৈলকুপা থানার গাড়াগঞ্জ বাজারসংলগ্ন কাঁচামাটির গ্রাম। এই মধুপুর গ্রামেই আমার বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু আমারও জন্ম মাতুলালয়ে, ভায়না গ্রামে। সেটা হরিণাকু-ু থানায় ঝিনাইদহ জেলার প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ। আমার মা জন্মেছিলেন তার মাতুলালয় সুগ্রীবপুরে, সেটা কুষ্টিয়ার মধ্যে পড়েছে। একদিন, ভায়না গ্রামের সেই মেয়ের সঙ্গে মধুপুর গ্রামের সেই ছেলেটির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকেই আমার বাবা যেমন মধুপুর থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরত্বের ভায়নাতে ভ্রমণে যান, মা’ও তেমন ভায়না থেকে মধুপুরে আসেন শ্বশুরবাড়িতে, হয়তো এটাও এক ভ্রমণ। এভাবেই, বিয়ের সাড়ে চার দশক পার হয়ে যায়। এর বাইরে বাকি দুনিয়া পড়ে থাকে- সেই বাকি দুনিয়া দেখা যায় বইপত্রিকায়, কখনো টেলিভিশনে, কখনো সিনেমার পর্দায়। স্বচোখে দেখা আর হয়ে ওঠে না। এটাই সত্য, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় পঁচানব্বই ভাগ মানুষ কখনো সমুদ্রের সামনে যায়নি, পাহাড়ে ওঠেনি, অরণ্য তো দুরূহ। আমার বাবা-মা’ও সেই কোত্থাও ভ্রমণে যেতে না পারা মানুষদেরই অংশ। অথচ পৃথিবীতেই তাদের বিচরণ, একজন ষাট পেরোনো, আরেকজন ষাট ছুঁই ছুঁই। আমার দুই বোন- তারাও ভ্রমণে যেতে পারে না তাদের চাকরি-সংসারের শেকলে বাঁধা পড়ে। আমার দুই ভাগ্নী- বর্ষা ও তাথৈ। তারাই বা যাবে কোথায়, যেহেতু সংসারের বড়রাই অনড় হয়ে গেছে! এই হচ্ছে ভ্রমণ-সংক্রান্ত বাস্তবতা। আমি সেই পরিবারের সন্তান। আমি দেশ-বিদেশে ঘুরতে ভালোবাসি। দেশের প্রায় ৫৫ জেলায় আমি ঘুরেছি। দেশের বাইরেও গেছি। নিশ্চিত জানি, চাঁদে বা মঙ্গলে যেতে না পারলেও আমি যেমন কুয়াকাটা যাব, সেন্টমার্টিনে যাব, একদিন আমাজন পার হয়ে কোনো এক রাস্তায় হাঁটব, যে রাস্তায় কখনো হাঁটিনি। সাইবেরিয়াতে যাব, এন্টারটিকাতেও যাওয়ার ঝুঁকি নেব। হিমালয়ে তো খুব শিগগিরই যাব, আবার নিঝুমদ্বীপে যাব, গাজীপুরে যাব, কুড়িগ্রামে যাব, তেঁতুলিয়াতেও যাব। যেতে যেতে যেতে যেতে একদিন চলেই যাব। তবে তার আগে, বাবা-মা-ভাগ্নী-বোনকেও কিছুদূর নিয়ে যাব। সেই যাওয়ারই অংশ হিসেবে, এবার বাবা-মা ও মামা বর্ষাকে নিয়ে টানা আট দিনের ট্যুর দিয়ে এলাম, দেশের মধ্যেই। যেসব জায়গায় গেছি, যেখানে আমার বাবা-মা-ভাগ্নী যায়নি কখনো। আবার দু-এক জায়গায় গেছি, যেখানে আমিও প্রথম গেলাম। খুব ভালো লাগারই বটে- এই পারিবারিক মানুষদের নিয়ে ঘোরাঘুরি। আই অ্যাম হ্যাপি, ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু- চট্টগ্রামে মেইলের একটি কেবিনে উঠি আমরা। সারারাত ট্রেন ভ্রমণ। এই প্রথম বর্ষা ও আমার মা ট্রেনযাত্রী হতে পারলেন। বাবা হয়তো কখনো ট্রেনে চড়েছেন, তাও ঢের আগে। ভোরের দিকে ট্রেনের জানলা দিয়ে চোখ পড়ে সীতাকু-ু পাহাড়-লম্বা পাহাড়। কোনোদিন সীতাকু-ু পাহাড়ের কাছে আমিও যাইনি। চট্টগ্রামে পৌঁছেই, কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে আমরা ফের কক্সবাজারের পথে বাসে চেপে বসি। পার হয়ে যাই কর্ণফুলী ব্রিজ-নদী। দুপুরেই কক্সবাজার। দেশের একমাত্র পর্যটন নগরী। হোটেল-মোটেল আর রূপচাঁদা মাছের শহর। সমুদ্র-পাহাড়ের শহর। বাঙালি ও রাখাইনদের শহর। এ শহরে বার্মিজ জিনিসপত্রের কয়েকটি মার্কেট আছে। আছে খেয়াং, সুপ্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আছে দূর সমুদ্র থেকে নিশানা দেখবার বাতিঘর, বাতিঘরটা পাহাড়ের ওপরে। সমুদ্রের দীর্ঘতম সৈকত, অভঙ্গুর সৈকত, কক্সবাজারে। মা-বাবা ও বর্ষার জন্য কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ানো এই প্রথম; ওদের চোখে প্রথম দেখার ঝিলিক। পরদিন সকালে জোয়ারের সময় আমরা সমুদ্রস্নানে নেমেছি। সেই এক উচ্ছ্বাস-আনন্দে ভেসে যাওয়া মুহূর্ত। সমুদ্র মানেই তো ঢেউয়ের পরে ঢেউ, বালি আর বালি। তীরের বালিতে শামুক-ঝিনুক আর লাল কাঁকড়ার আল্পনা। সত্যি, এ বড় আনন্দের ঢেউ, আনন্দের গর্জন। গর্জন তো আসে ঢেউ থেকেই, ননস্টপ।
আমরা গেছি ইনানি বিচে। ইনানি বিচের নির্জনতা মনে লেগে থাকে। ইনানি পড়েছে উখিয়ার ভেতর। ইনানি থেকে ফেরার সময় হিমছড়ি নেমে আমি ও বর্ষা হিমছড়ির পাহাড়ে উঠেছি। পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা। সেই মজা দিতে পারে হিমছড়ির পাহাড়। এছাড়া হিমছড়ির সেই হিমও নেই, ছড়ি বা ঝর্ণাও আজ আর নেই। হিমছড়িতে রয়েছে ছোট্ট একটি বাজার, বার্মিজ মার্কেট। ফলে আমার মা ও বর্ষা কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাথৈয়ের জন্য কেনাকাটা করে। তাথৈর বয়স দুই বছর পাঁচ মাস। এ মুহূর্তে আমার দু’বোন ও তাথৈ রয়েছে ঝিনাইদহে। আমরা আছি এমন একটি রাস্তায়, রাস্তার একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে সমুদ্র। এটা মেরিন ড্রাইভ। বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হাইওয়ে এটা। ইশ্, এ রকম একটি রাস্তায় হাঁটেনি দেশের নব্বইভাগ মানুষ- এটা সত্য। তবে আস্তে আস্তে বাঙালির ভ্রমণবিমুখ বদনাম দূর হচ্ছে। বাঙালিও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছে।
কক্সবাজারের আবহাওয়ায় প্রায় আড়াই দিন পার করে আমরা বান্দরবানের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই।
কেরানির হাট হয়ে বান্দরবানে পৌঁছেই একটি মাইক্রোবাস পাই। আমরা প্রথম যাই বৌদ্ধ জাদি মন্দির বা স্বর্ণমন্দিরে। স্বর্ণমন্দিরটা একদম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। স্বর্ণমন্দিরের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বান্দরবান শহর দেখা যায়। পাহাড়ের উপরে এই মন্দির তৈরি করল কীভাবে?
নীলাচল আরেক সুন্দরের পটভূমি। বান্দরবান শহর থেকে সামান্য একটু দূরে নীলাচলে গিয়ে দেখি, মেঘ এসে ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে পাহাড়ের খাঁজে। ছবি তুলব, না চোখে দেখব এই সৌন্দর্য? নীলাচলও পাহাড়ের উপরে, তঞ্চঙাপাড়ায়। এ পাড়ার নাম টাইগার ছিল। আসলে পুরো বান্দরবানই হচ্ছে পাহাড়ভূমি।
বান্দরবানের সাংবাদিক মনুভাইকে বিশেষভাবে আড্ডায় পেয়েছি। খুবই আড্ডাবাজ মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ কিন্তু মনু ভাই এখন পুরো পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গে মিশে গেছেন, বাঙালি হলেও আদিবাসী হয়ে গেছেন।
সাংগু নদীর মায়া মনের মধ্যে নিয়ে ফিরে আসি চট্টগ্রামে। সার্কিট হাউসে উঠি। পরে যাই পতেঙ্গায়, সন্ধ্যায় সমুদ্র দেখতে। দেখে, দূরে বহির্নোঙরের জাহাজের আলো। বড় অদ্ভুত।
পরদিন গেলাম সীতাকুন্ডু পাহাড়ে। আমাদের জন্য গাড়ি প্রস্তুত করে রেখেছিলেন কবি রহমান হেনরী। হেনরী আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। এখন তো প্রায় দেখা হয় না। ওর সরকারি চাকরি। তবে কবিতায় দেখা হয়, আমাদের কবিতায় দেখা হবে বারবার। কবিতাই আমাদের সম্পর্কের সাঁকো।
সীতাকুন্ডু পাহাড়ের উপরে চন্দ্রনাথ মন্দির। আমি, বর্ষা ও আমার বাবা প্রায় আড়াই ঘণ্টা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের উপরে চন্দ্রনাথ মন্দিরে উঠেছি। ঘেমে-নেয়ে একাকার। পাহাড়ে ওঠা কেমন লাগে বুঝেছে বর্ষা, বুঝেছেন আমার বাবা। মা নিচের জগন্নাথ মন্দির পর্যন্ত উঠেই বললেন, ‘তোরা যা। আমি পাহাড়ে উঠতে পারব না।’ চন্দ্রনাথ থেকে সমতলে নামতেই প্রায় দেড় ঘণ্টা। নামতেও কম ঝুঁকি নয়।
এরপর ফের চট্টগ্রাম শহর। রাতেই আমরা ঢাকার দিকে ফিরে আসব মনস্থির করে ফেলি। দেখতে দেখতে আট দিন কেটে গেল- সমুদ্রে, পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে শরীরে কিছু ক্লান্তিও জমা হলো। কিন্তু মনের মধ্যে জমা হলো অনেক আনন্দ, অনেক উৎসাহ, অনেক চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার মজা। আমার মা-বাবা নতুন কিছু দেখে ফেরার আনন্দে ফুরফুরে, দেখেই বুঝেছি। বর্ষা ছবি তুলেছে শত শত, বর্ষাকে দেখে বুঝি- এই পাহাড়-সমুদ্রের কাছে ও আবার ফিরবে, স্কুল পরীক্ষার পরই।
হ্যাঁ, তখন হয়তো পরিবারের সবাইকে নিয়ে আবার যাব। পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেরোনো কাকে বলে- আমারও তো তা প্রথম জানা হলো।