সমকালীন বাংলা কবিতার অঙ্গ-সৌষ্ঠব, গতি, ছন্দ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে এক প্রাণবন্ত আড্ডা হয়ে গেল গত ৭ আগস্ট ২০০৯ 'সমকাল'-এর দপ্তরে। সমকাল-এর সাহিত্য সাময়িকী 'কালের খেয়া'র উদ্যোগে এ আড্ডায় অংশ নেন বিশ শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে একুশ শতকের প্রথম দশকের উল্লেখযোগ্য কবিরা। হাজার বছর ধরে চর্চা হয়ে আসা বাংলা কবিতা এ মুহূর্তে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে বা বাংলা কবিতার সামনের পথপরিক্রমাই বা কী_ তাই নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে আড্ডায়। আড্ডায় উল্লেখযোগ্য অংশ 'কালের খেয়া'র পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে পত্রস্থ হলো। লেখাটি গ্রন্থনা করেছেন নয়ন আদিত্য এবং কিংকর বিশ্বাস
সভাপতি
গোলাম সারওয়ার
স্বাগত বক্তব্য
আবু সাঈদ খান
অংশগ্রহণ
আল মাহমুদ
রফিক আজাদ
কামাল চৌধুরী
ফার ুক মাহমুদ
রিফাত চৌধুরী
টোকন ঠাকুর
ফেরদৌস মাহমুদ
নিতু পর্ণা
বিজয় আহমেদ
সঞ্চালক
নাসির আহমেদ
ফারুক আহমেদ
গোলাম সারওয়ার : কবিতা আমরা পড়ি বা না পড়ি, লিখি বা না লিখি কবিতা সময়ের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে চিরদিন বেঁচে থাকবে। কবিতার জন্য এটিই হলো আসল সত্য। এখানে আল মাহমুদ ভাইসহ অনেকে আছেন। সবাইকে শুভেচ্ছা। কবিতা এমন একটি স্রোত এটি স্তব্ধ হওয়ার নয়। জীবন স্তব্ধ হতে পারে কবিতা স্তব্ধ হবে না। কবিতা আমি খুব একটা বুঝি না তবে বোঝার চেষ্টা করি। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। কিন্তু ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকে ছড়া লেখার অভ্যাস ছিল। এখনও মাঝেমধ্যে লিখি, পড়ি। আমি মনে করি আমাদের কবিতা অনেক এগিয়ে গেছে এবং আরও এগিয়ে যাবে।
আবু সাঈদ খান : আমাদের বাংলা কবিতার বয়স অনেক। যখন লেখা আবিষ্কার হয়নি, তখনও আমাদের কবিতা ছিল। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের হাত ধরে সেই কবিতা আধুনিকতা লাভ করেছে। কবিতার এগিয়ে যাওয়া থেমে নেই। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ প্রমুখের হাত ধরে কবিতা অগ্রসর হচ্ছে। এটি একটি অগ্রসরমান বা গতিশীল সাহিত্য। আমাদের সাহিত্যের বড় একটি জায়গা জুড়ে রয়েছে বাংলা কবিতা।
আজ এই অগ্রসরমানতার ক্রম ইতিহাস আমাদের কবিদের কাছ থেকে শুনব। এখানে আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, ফারুক মাহমুদ, কামাল চৌধুরী, রিফাত চৌধুরী, টোকন ঠাকুরসহ বর্তমান সময়ের অনেক তরুণ কবি ও রয়েছেন। সমকালের আয়োজিত এ আড্ডার মধ্য দিয়ে সেই কথাগুলোই উঠে আসবে।
আমি এখন সমকালের ফিচার সম্পাদক কবি নাসির আহমেদকে সভা পরিচালনার জন্য অনুরোধ করছি।
নাসির আহমেদ : সাঈদ ভাইয়ের কথার সূত্র ধরেই বলি, আমাদের অর্থাৎ বাংলা কবিতার বয়স হাজার বছরের বেশিই হবে। 'চর্যাপদ' বাংলা কবিতার প্রথম স্মারক এবং বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন হয়েছে মূলত মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে। আর সেটিকে ব্যাপকতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর_ এ কথাগুলো আমাদের জানা। রবীন্দ্র-উত্তরকালের যে কবিতা বিশেষ করে ত্রিশের দশকের কবিতার ধারা_ আমি মনে করি যা এখনও নিঃশেষিত নয়; তারই বর্ধিতাংশ গত ৪০-৫০ বছর চলছে সেই জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীদের পথ ধরে এবং তার পরবর্তীকালে, পঞ্চাশের দশকের দু'জন প্রধান কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ_ যারা বাংলা কবিতায় বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তবে একটি বিষয়কে আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে এড়িয়ে যাই, তা হলো দেশভাগের পর যারা কবিতা লিখেছেন তারা সবাই মুসলমানি কবিতা লিখেছেন। চলি্লশের শুধু দু'জন কবি সেক্যুলারধারা ধরে রেখেছিলেন। এ দুই কবির একজন আহসান হাবিব, অন্যজন আবুল হোসেন। আর একজন শক্তিমান কবি ফর্রুখ আহমদ। কিন্তু ধর্ম তাকে গ্রাস করেছে যার কারণে তার কবিতায় গভীরতা সত্ত্বেও যে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা তা তিনি পাননি। সৈয়দ আলী আহসানের মতো পণ্ডিত কবির কথাও একই ভাবে চলে আসে। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে বিশেষ করে ১৯৫৮ সালের সেনাশাসনকে কেন্দ্র করে যে নতুন দ্রোহী জোয়ার এসেছিল পূর্ব বাংলার কবিতায়, এর মধ্যে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে গণআন্দোলন তা আরও একটি নতুন বাঁকের সৃষ্টি করে। যার কারণেই অনেক অসাধারণ কবিতার জন্ম হয়। আল মাহমুদের 'ট্রাক ট্রাক ট্রাক/শুয়োরমুখো ট্রাক আসছে/দুয়োর বেধে রাখ।' ষাটের দশকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কবিতা এসেছে বাংলা সাহিত্যে। আবার নান্দনিক কবিতাও যে সৃষ্টি হয়নি তা নয়। রফিক আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ যত না রাজনৈতিক তারচেয়েও বেশিমাত্রায় নান্দনিক। এটিও সেই সময়ই প্রকাশিত হয়। ৭০-এর দশকে বাংলা কবিতা আরও একটি বাঁক নেয়। স্বাধীনতার যুদ্ধ, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময় নতুন স্বপ্নকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় অসংখ্য কবি ও কবিতা। আমার মনে হয় সত্তরের দশকে আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কবির আবির্ভাব হয় এবং এখনও পর্যন্ত এদের অনেকে কাব্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত আছেন। রফিক ভাই এ বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন।
রফিক আজাদ : সত্তরে সত্তর দশকের কবিরা তো ছিলেনই, এর মধ্যে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিরাও সে সময় লিখেছেন। বিপুলভাবেই লিখেছেন অর্থাৎ তাদের শ্রেষ্ঠ ফসল কিন্তু সে সময়ই উঠেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন যে দেশ আমরা অর্জন করেছি তার প্রকাশ অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে কবিতায় বেশি উঠেছে।
একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, আমাদের কবিতার চর্যাপদ থেকে শুরু করে দীর্ঘ যে রাস্তা, এ রাস্তা মাঝে মধ্যে বিস্ময়করভাবেই বাঁক নিয়েছে। মধ্যযুগে বৈষ্ণব কবিতার চর্চা হয়েছে অনেকের হাতেই। কিন্তু আমরা যে চারজনকে পাই তারা সবাই বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। যেমন চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাসকে এখনও আমার নিকটতম কবি বলেই মনে হয়। যার মধ্যদিয়ে উঠে এসেছিল_ 'শোন ও মানুষ ভাই/সবার উপর মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই' কবিতাটা শোনার পর মনে হয় যেন আজকের কবি। কবিকে আসলে দশক বা শতক দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। কবি চিরকালীন। তবে বড় ক্যানভাসে ভাবতে গেলে ওই দশকের হিসাব চলে আসে। সময়কে ধারণ করেই সময়কে অতিক্রম করতে হয়। এখানে বলতে হয়, ১৯৩০ সালেই মূলত বাংলা কবিতার পালাবদল ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে মানসিকতা ও চিন্তার পরিবর্তন আসে। তবে এটা সত্য, বাংলা কবিতার যে অর্জন তা আমাদের সবার। দশকের হিসাব মূলত ১৯৩০ থেকে শুরু হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ পশ্চিমাদের কাছ থেকে নেওয়া। কিন্তু এটা প্রতীয়মান, প্রত্যেক দশকেই কবিতার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমাদের প্রধান কবি আল মাহমুদের কাছ থেকে তার কথা শুনব।
আল মাহমুদ : আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস একটু অন্য রকম। আমাদের কবিতা নিয়ে যেসব আলোচনা-সমালোচনা হয় তা আমি অতটা গ্রাহ্য করি না। কথা হলো, বাংলা কবিতার আধুনিক পর্যায়টি কীভাবে শুরু হয়েছে তা বিচার করে দেখতে হবে। একটা কথা আছে বাংলা কবিতাতেই। সেটা হলো-
দিনের বেলায় কাকের ডাকে বউ মূর্ছা
যায় আর রাত হলেই কামারু যায়।
এটা থেকে বোঝা যায় বাংলা কবিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সতীসাধ্বী কোনো বিষয় নয়। বাংলা কবিতার আধুনিকতর পর্যায় যেটা আমরা আমাদের হাতে পেয়েছি সেটা অত্যন্ত জটিল এবং সমালোচনায় দগ্ধ হওয়ার মতো বিষয়। এ জন্য আমার সবসময় মনে হয়েছে, জীবনানন্দ দাশ বা যারা আধুনিকতর পর্যায়গুলোকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন, তাদের কবিতায় সবই আছে অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সবই আছে কিন্তু তার কবিতায় দেশ নেই।
রফিক আজাদ : এখানে আমি মাহমুদের সঙ্গে একমত নই।
টোকন ঠাকুর : আচ্ছা মাহমুদ ভাই শেষ করুক, তারপর আমরা বলি।
মাহমুদ : ঠিক আছে। রফিক তোমার বক্তব্য কী শুনি।
রফিক আজাদ : বেলা-অবেলা-কালবেলা, রূপসী বাংলা পুরোটাই তো দেশ। এখানে দেশ নেই কোথায়? বরং তার বিদেশের অংশ খুবই সামান্য। জীবনানন্দ বাংলার কাদা, জল, মাটিতে লেপ্টে আছেন এবং তার যে উচ্চারণপদ্ধতি_ তা একেবারেই বাঙালিদের সহজাত উচ্চারণ। তাকে তো আমরা এভাবেই পাই।
আল মাহমুদ : আমি তো বলেছি, জীবনানন্দ দাশ বা ত্রিশের দশকের কবিকুলের পুরোটাই। তাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশ ছিল না। একটা কবিতা বলি_
আমরা খুঁজেছি হরেক বইয়েতে আপন দেশ
দেশের মানুষ ঘুরিয়েছে শুধু ডাইনে-বাঁয়ে
এতেই ঠিক বোঝা যায় তিনি ঠিকই বলেছেন। দেশের মানুষ ঘুরিয়েছে শুধু ডাইনে-বাঁয়ে। আসলে তাদের কোনো দেশ ছিল না।
দেশ যাকে বলে। আমার দেশ, আমার আমার জন্মভূমি, আমার। এই শব্দটা যেভাবে বলা হয় সে অর্থে তাদের কোনো দেশ ছিল না।
আবু সাঈদ খান : শব্দের অর্থ ঠিক আছে তো?
আল মাহমুদ : আমার কথা শেষ করতে দেন। তখন তারা দেখলেন যে, কবির তো একটা দেশ লাগে! কবির তো দেশ না হলে চলে না। তখন তারা দেশে ফিরতে চাইলেন। সবার বয়স তখন ষাটের উপরে। ফিরলেন তারা। কিন্তু কে কোথায়? বুদ্ধদেব দেশে ফিরলেন; কিন্তু সেটা 'মহাভারত'-এ। তার দেশ হলো মহাভারত। এরকম প্রত্যেকে ফিরেছেন কিন্তু ঠিক জায়গায় অর্থাৎ দেশে ফিরতে পারেননি। বরং পঞ্চাশের দশকে কবিরা দেশের কথা বলেছেন। তাদের একটা দেশ ছিল। দেশ কোনটা? বাংলাদেশ। ওই সময় তাদের কবিতায় দেশের যে চরিত্র ফুটেছে সেটা এ রকমই ছিল। দেশহীন একটা জেনারেশন।
তো আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা বুঝিয়ে বলতে গেলে এই বলতে হয় যে, ওইসব কবির দেশ ছিল না। তারা দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তারা অবশ্য দেশে ফিরেছেন; কিন্তু সেটা মহাভারত হয়ে গেছে। এই যে ট্র্যাজেডি, এই ট্র্যাজেটিটা বাংলা কবিতার জন্য ভালো কি মন্দ তা জানি না। কিন্তু কবিতার নানা বাকবিতণ্ডায় অনেক চমকপ্রদ বক্তব্যের সৃষ্টি হয়েছে। এবং ক্রমাগত তারা আধুনিকতার দিকে হাত বাড়িয়েছেন।
আমরা আধুনিক কবিতার মর্মকে যদি স্পর্শ করতে চাই তাহলে দেখা যাবে, সত্যিই কি আমরা আধুনিক? আমাদের আধুনিকতা যথার্থ ছিল না। আমাদের আধুনিকতা খণ্ডিত ছিল।
যা হোক, আমি যেটা বলতে চাই, অনেক বাঁক ঘুরে আমাদের বাংলা কবিতা তার একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে। এটা আমি মেনে নিচ্ছি। এটা মেনে নিচ্ছি যে, অনেক বাকবিতণ্ডা হয়ে রক্ত ক্ষয়ে বাংলা কবিতার একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছে।
এখন আপনারা কবিতা বলতে যা বুঝেছেন, একে কেন কবিতা বলা হবে তার ভালো কোনো যুক্তি আছে কি? অবশ্য আমি এ সভায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাইনি। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন যে, প্রশ্নটা উত্থাপন করতেই হলো।
যারা কবিতা রচনা করেন তারা সবাই আধুনিকতাকে বেশি জোর দেন। কিন্তু কবিতা সবসময় সেটা দাবি করে না। কবিতা আধুনিকতাকে প্রচণ্ড বিষয় মনে করে না। সাহিত্যের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই কবিতা পিছিয়ে পড়াকে অবলম্বন করেছে। এবং নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। কবিতা সবসময় আধুনিকতাকে হৃদয়ে ধারণ করবে। এটা কোন সূত্র বলেছে? কে বলেছে? প্রতিক্রিয়াশীলতাও কবিতা হতে পারে। কবিতার মতো বিষয় নিয়ে খেলা যায় না। কবিতা নিজেই সব ভোগ, সব প্রকাশ এবং নিজের ধারণাকেই তুঙ্গে তুলে রাখে, সবসময়।
আমি যখনি আধুনিক কবিতার ইতিহাস ঘাঁটতে গেছি তখনই দেখেছি যে, অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আঁকড়ে ধরে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। কবিতা কাদের জন্য লেখা হয়? যারা এমনি তুঙ্গে আছে, আধুনিক বক্তব্যকে ধারণ করে আছে। এমনি আবার প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে মুখ ফিরিয়েছে।
টোকন ঠাকুর : আমি জানতে চাচ্ছি প্রতিক্রিয়াশীলতাকে অবলম্বন করেও ভালো কবিতা লিখেছেন বা লিখে যাচ্ছেন এমন কারও কথা কী বলবেন? বাংলা কবিতায়।
আল মাহমুদ : অঙ্গনো ঘনোপন শুনো বিয়াতি
কানের চোরে নিল অধরাতি
শশুড়ি নিজ যায় বহুরি জাগঅ
কানের চোরে নিল কাগই মাগই
বাংলা কবিতার প্রাচীনস্তর এ রকম ছিল।
রফিক আজাদ : প্রতিক্রিয়াশীলতার কথা বললে প্রগতিশীলতার কথাও আসে। আধুনিকতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলতা বা প্রগতিশীলতার সম্পর্ক নেই। কবিতা দু'রকম হতে পারে। সেটা পাঠক বিচার করবে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে গ্রহণ করবে না ফেলে দেবে। কিন্তু বাংলা কবিতায় এটা প্রমাণ হয়েছে যে, প্রতিক্রিয়াশীলতা গ্রহণ হয়নি, যার প্রধান প্রমাণ হলেন ফর্রুখ আহমদ। মানুষের ভেতরের শুভ ব্যাপারটি আসল। প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আমরা শুভ বলে মনে করি না। জীবনানন্দের কথায় ফিরে যাই। তার লেখায় একফোঁটা প্রতিক্রিয়াশীলতা নেই। অথচ তিনি নিচে নামতে নামতে বিছানা, বালিশ, মাটির কাছে চলে এসেছেন। তার কণ্ঠেই সমসাময়িক চিন্তা-চেতনার বিষয় উঠে এসেছে।
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
পৃথিবঅ অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া
বেলা-অবেলা-কালবেলায় সম্পূর্ণ দেশের প্রেক্ষিত আছে। তার সাংঘাতিক অবদান হলো বোধ কবিতার ইতিহাস চেতনায় তাকে তো অচেনা মনে হয় না। আমাদের চেনা জগতের একজন বলেই মনে হয়। বুদ্ধদেবের কথা এসেছে। তার দেশ যদি মহাভারত হয় ক্ষতি কি? আমরা তো কল্পনায় বাস করতে পারি। আমি এক দেশের নাগরিক হয়ে যদি নিজেকে সমগ্র বিশ্বের নাগরিক ভাবি তাহলে কি কোনো দোষ আছে? বরং আর একটু পরিসর বাড়ল। দেশ কি থাকতেই হবে? পৃথিবীতে আজ হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু, দেশহীন। মাহমুদ দারবিশের বেদনার যে চিত্র পাওয়া যায় তা তো আমাদের স্পর্শ করে। আমি মনে করি যার ভূমি নেই তার ভূমির প্রতি মায়া বেশি। আমি মনে করি কবিতাকে বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ না করাই ভালো।
ফারুক আহমেদ : এ পর্যন্ত বাংলা কবিতা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা পঞ্চাশ এবং ষাট দশক পর্যন্ত_ সত্তরে এসে আমাদের কবিতায় কী কী অনুষঙ্গ যুক্ত হয়। দাঁড়ায় কোন অবয়বে, তাই এখন শুনবো কবি ফারুক মাহমুদের কাছ থেকে।
ফারুক মাহমুদ : বাংলা কবিতার প্রায় পাঁচ দশকের কবিদের নিয়ে এই আড্ডা আয়োজনের জন্য সমকালকে ধন্যবাদ। একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ ও স্বাধীনতা। স্বাধীনতা-উত্তরকালের যে সময় সেটা হলো আমাদের সত্তর দশক। এখানে এসে আমরা স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা_ দুটি জিনিসকেই ধারণ করেছি। অর্থাৎ সত্তরের দশকে যেসব লেখক ও কবি এসেছেন তারা এ দুটো জিনিসকেই ধারণ করেছেন। যার কারণে সে সময়ের কবিতায় এ দুটো জিনিস পাওয়া যায়। আমি মনে করি সত্তর দশক বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি স্বপ্নময় বাগান।
এ বাগান থেকে এত সুগন্ধি আর এত বিচিত্র ফুল এখানে ফুটেছে সেটা বাংলা কবিতার ইতিহাসে ব্যাপকতার সৃষ্টি করেছে। আমার মনে আছে, সে সময় একঝাঁক তরুণ কবি বেরিয়েছিল। যার সংখ্যা ৩০০-র কম নয় এবং এখনও প্রায় ২০-২৫ জন কবি নিয়মিত কবিতা লিখছেন। লেখা ভালো কী মন্দ তার বিচার আলাদা বিষয়। এ দশকে এসে আমরা বিশাল একটা ক্যানভাস আবিষ্কার করেছি। পরাধীনতার সঙ্গে স্বাধীনতার তুলনা করলেই দেখা যায় স্বাধীনতা কী বিশাল ব্যাপার। আমরা সামরিক শাসনের উত্থান দেখেছি। যার কারণে সে সময় আমরা যারা কাব্যচর্চা শুরু করি তাদের ভাষায়, শব্দে ওই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। 'আমি যা বলতে চাই তা হলো আমাদের কবিতা বিবর্তিত হতে হতে অনেক দূর চলে এসেছে। আর আধুনিকতা বলতে যেটা বুঝায় সেটা কবিতার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শূন্য দশকে এসে কবিতা যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে তা চলি্লশ, পঞ্চাশ, ষাট কিংবা সত্তরের দশকের চেয়ে অনেক আলাদা। সেটা ভাষায় এবং বর্ণনায়। কিন্তু এখন যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কবিতা চর্চায় যারা আছেন তাদের অনেকেই মনে করেন কবিতা হবে বহুরৈখিক আবার অনেকে বলতে চান কবিতার মধ্যে পরম্পরা থাকতে হবে। কবিতা যেখানে শুরু হয়েছে শেষে সেখানে নাও থাকতে পারে। কবিতা বহুদিকে যেতে পারে। আমার প্রশ্ন হলো তরুণ বন্ধুদের কাছে তারা এ বিষয়টিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন। আর আমরা সনাতনী যে বিষয়টি বলি_ ছন্দের বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ছন্দ অন্য একটি রচনা থেকে কবিতাকে আলাদা করে। ছন্দ নানাভাবে থাকতে পারে। এই যুগে এসে ছন্দের চরিত্রও পাল্টে গেছে। আমাদের তরুণ কবিবন্ধু যারা আছেন, তারা এ বিষয় নিয়ে কী ভাবছেন সেটা জানতে চাইব।
রিফাত চৌধুরী : আধুনিকতা শব্দটি অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতা কী এটা আমরা এখনও শনাক্ত করতে পারিনি। ঝাপসা একটা ব্যাপার রয়ে গেছে। আর একটা ব্যাপার_ প্রতিক্রিয়াশীল, ছন্দ, দেশ ইত্যাদি বিষয় আমাদের এ আড্ডায় উঠে এসেছে। আমি আসলে মনে করি কবিদের কোনো দেশ নেই, থাকতে পারে না। কবিদের দেশ তার কবিতাই। আর দেশের রচনার মধ্যে কোনো বিষয় যদি লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে তো থাকতেই পারে। দেশ কোনো কবি বা সাহিত্যিককে কখনোই আপন করে নেয়নি। দেশ সবসময়ই বড় লেখককে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতিহাস তার প্রমাণ।
মাহমুদ ভাই দেশ ও জীবনানন্দ নিয়ে কথা বললেন, রফিক ভাইও বললেন। জীবনানন্দ বাংলায় কবিতা লিখেছেন, দেশ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, এখনও আমরা জীবনানন্দকে প্রত্যাখ্যান করে রেখেছি। কেন রেখেছি? কারণ উনি সারাজীবন অসামাজিক কবিতা লিখেছেন। আমরা পাঠ করা কবিতার মধ্য দিয়ে জেনেছি কবিরা আসলে অসামাজিক জায়গা থেকে কথা বলে। পৃথিবীর একটি জিনিস আমি দেখতে পাব না সেটি সামাজিক। পিকাসোর গোয়ের্নিকা, কামরুল হাসানের কিছু ছবি, যা অসামাজিক বটে।
আমি মনে করি বাংলা কবিতা নেই। বাংলা কবিতা শেষ হয়ে গেছে। এখন আমার কথা হলো নবীন যারা আসছেন তারা কীভাবে ভাবছেন জানি না। তবে কবিতা লিখতে বা কবিতাকে বাঁচাতে একটা জগৎ তৈরি করতে হবে। জগৎটা তৈরি করতে না পারলে কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। একমাত্র রাবীন্দ্রিক সর্বগ্রাসী পটভূমি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন জীবনানন্দ দাশ, নজরুল, জসীমউদ্দীন।
ছন্দের বিষয়ে আমার মতো যেটা, আধুনিক কবিতা আসলে ছন্দহীন। ছন্দহীন এই অর্থে এখন পর্যন্ত আমরা যেসব ছন্দ পেয়েছি তা সব সাধুভাষার। কিন্তু আমি লিখছি কথ্য ভাষায়। কিন্তু নিতে হবে সাধুভাষার ছন্দকে। সুতরাং এখানেই ছন্দপাত ঘটে গেছে।
আল মাহমুদ : আধুনিক কবিতার চরিত্র ছন্দহীন নয় বরং তার উল্টোটা। মেজাজের দিক থেকে সে গীতিপ্রবণ। আধুনিক কবিতার হৃদয় ছন্দপ্রবণ অর্থাৎ গীতিপ্রবণ স্বভাব তার।
রিফাত চৌধুরী : আপনি যেটা বলছেন সেটা আমি বুঝেছি। আমাদের ভাসমান ছন্দের কথা নয় আমি বলছি যেসব ছন্দ আমরা আবিষ্কার করেছি সেগুলোর কথা এসব ছন্দ আধুনিক কবিতায় মেলে না।
আল মাহমুদ : অনেকে বলেন, আধুনিক কবিতা ছন্দহীন, ছন্দ থাকবে না। এটা একটা ভুল ধারণা।
রিফাত চৌধুরী : যখন বিনয় মজুমদার বলেছেন, সারাক্ষণ মাত্রার দিকে নজর আমার কিন্তু উনিও তো একজন আধুনিক কবি। আমি বলছি_ যে ছন্দগুলো প্রতিষ্ঠিত সেগুলোর কথা। জীবনানন্দ অনেক বড়মাপের কবি বলেই ছন্দ নিয়ে লিখেছেন কিন্তু পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তার ছন্দকে হারিয়ে ফেলেছে।
টোকন ঠাকুর : নব্বইয়ের দশকের কবিতা কর্মী আমি। এখানে দু'দফা আলোচনা করব। এক. আগের শোনা আলোচনা থেকে কিছু প্রসঙ্গ, দুই. আমার ওপর চাপানো কিছু প্রশ্ন।
কবির দেশ। কবির একটি স্বতন্ত্র দেশ নিজের মধ্যে তৈরি হতে থাকে। সেই দেশটি পঞ্চাশের, ষাটের ও সত্তরের দশকের দেশ। কিন্তু কবির মনের মধ্যেই আসলে একটি দেশ রচিত হতে থাকে। আর কবিও সেই দেশেই বাস করতে চান। আর তার কবিতাতেই প্রকাশ বা প্রতিপালিত হতে থাকে।
ছন্দ কবির কবিতার ভেতর দিয়েই রচিত হয়। আগের রচিত ছন্দ হয়তো তাকে সাপোর্ট করে। তবে নতুন একটি কবিতা রচনা হওয়ার মুহূর্তে নতুন একটি ছন্দ রচনা হতে থাকে। কবির আগের পাঠ, অভিজ্ঞান ও সামর্থ্য অনুসারে ছন্দটি রচিত হয়। ফলে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আমি আজ পর্যন্ত জানি না। কিন্তু আমি আমার মতো করে লিখি। লেখার সময় মোটেই ভাবি না এটা ছন্দে পড়ল, কী পড়ল না। কিন্তু আমি এটা বুঝি কবিতার অনেক উপাদানের মধ্যে ছন্দ একটি উপাদান, যা একটি কবিতা তার অন্যান্য উপাদানের মতো করে ছন্দকেও নেয়। দেশ কবির মাথার মধ্যে আছে। বুকের মধ্যে আছে। তার প্রেমিকাই তার দেশ। এটাই বড় আকারে হয়ে উঠলে বিনয় মজুমদারের দেশ গায়ত্রী চক্রবর্তী। বাংলা ভাষায় হয়তো বিনয় জানাচ্ছে তার একটা দেশ আছে। আল মাহমুদ বলেছেন, প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে ভালো কবিতা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমি বলব কবিতাটা যখন একজন কবি লিখতে চান, তখন তার মনের মতো একটি ভুবন তৈরি করে। প্রতিক্রিয়াশীলতা একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাষা। সেখানে কবি এই শব্দটিকে কী জন্য আনবেন? যদি তিনি কবিই হয়ে থাকেন। তখন তার দায়িত্ব পড়ে যাচ্ছে নতুন একটি সমাজ কাঠামো নির্মাণের প্রশ্নে। সেক্ষেত্রে আমি কবি রিফাত চৌধুরীর সঙ্গে একমত। কবির কোনো দেশ নেই। যেখানে স্বাধীনতার সংজ্ঞা প্রতি মুহূর্তে, প্রতি সময়ে, প্রতি শ্রেণীগতভাবে পাল্টে যাচ্ছে। কেননা রাত ২টার সময় যে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আবার একই সময় রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ওই পুলিশই প্রটোকল দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই স্বাধীন দেশে। ফলে স্বাধীনতা দু'জনার কাছে দু'রকম। ফলে দেশ একটি ধারণামাত্র, আধুনিকতাও একটি ধারণামাত্র একজন কবির কাছে। ছন্দও কানে শোনা একটি ধারণামাত্র। ঝরনাও তো একটা ছন্দে প্রবাহিত হয়। কিন্তু কোন ছন্দে? আমি বলতে পারব না।
ছন্দ, গন্ধ, বর্ণ, বাংলা শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের সম্পর্ক নিয়ে নিজের মনের কথা বলতে। সত্যিকারের আধুনিক একটি দেশ স্বাধীন একটি সমাজ, আমার মনোজগতের এক সুন্দর দেশের জন্য আমি এখনও কবিতা লিখি। তা ছন্দে থাকল কি-না, আধুনিকতায় পড়ল কি-না বা বাংলাদেশের মধ্যে পড়ল কি-না এসব নিয়ে আমার ভাবনা নেই।
কামাল চৌধুরী : অগ্রজ কবি আল মাহমুদ ও রফিক আজাদসহ আমরা কবি বন্ধুরা সমকাল-এর মাধ্যমে এক জায়গায় আড্ডায় বসেছি। আমি আসলে মাঝে মধ্যেই ভাবি কবিরা নিজেদের প্রতি একটি ভিন্ন ধারণা পোষণ করে। টোকন যেটা বলল, কবিদের দেশ নেই। এটা ঠিক। কারণ যদি বোধের কথা বলি, কল্যাণের কথা বলি তাহলে সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গেই আমাকে একাত্ম হতে হবে। সেই অর্থে কবিতার যেমন দেশ নেই তেমনি যে কোনো শিল্পীরই কোনো দেশ নেই। কিন্তু আমি মনে করি কবিদের আসলে এতটা সাবজেক্টিভ হওয়া ঠিক নয়।
যদি বলা হয় কবিতা কেন লেখেন? একেকজন একেক কথা বলবে। কেউ বলবে আমি আসলে অন্য কিছু পারি না বলে কবিতা লিখি। কারও কারও ক্ষেত্রে এটা অবশ্য ঠিক। কেউ কেউ বলেন আমি যা বিশ্বাস করি, আমার যে বোধ সেখান থেকে কবিতা লিখি। কেউ বলবেন আমি আঘাত করতে চাই, সত্যকে লিখতে চাই। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সত্যটা কী? সালভাদরের সত্য আর আমার সত্য এক রকম নয়। আবার রসুল গামজাদি তার এক লেখায় বলেছেন, আমি আমার মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চাই। আমি এই পাহাড়ের মানুষগুলো যে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নের কথা বলতে চাই। আবার সবকিছু ভেঙে দাদাইজম যখন একটি নতুন জায়গায় দাঁড়াতে চেয়েছে তখন তার সত্য আর আমার সত্য এক হবে না। সুতরাং কবিতা হলো একটি মনোজাগতিক বিষয়। উত্তম কবিতা হলো সেটি যেটি এক জায়গা থেকে যে কোনো বাক্যবন্ধকে একটি সমুণ্নত জায়গায় নিয়ে যায়। যেমন হোমারের ইলিয়ট। সে সময় তো আরও অনেক লেখা হয়েছে কিন্তু হোমারের বর্ণনাভঙ্গির কাছে অন্য লেখাগুলো টেকেনি। না টেকার কারণে ইলিয়টকে বলা হয়েছে সে সময়ের সৃষ্ট মহাকাব্য।
কবির কাজ হলো দৃশ্যের সঙ্গে নতুন দৃশ্যের যোগ করা। যদি নতুন দৃশ্য যোগ করতে না পারে, নিজের ভেতরে কোনো অনুরণন তুলতে না পারেন, সে অনুরণন যদি পাঠকের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে আলোড়ন তুলতে না পারে। তাহলে কিন্তু সেটা কবিতা হিসেবে বিবেচ্য থাকে না। আমার কাছে সেটাই শ্রেষ্ঠ কবিতা_ যেটা পাঠ করলে আরও দশটা কবিতা লেখার উৎসাহ পাওয়া যায়।
নিতুপর্ণা : এতক্ষণ নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। অনেক প্রশ্ন ও উত্তরও এসেছে। তো আমি ওই প্রসঙ্গগুলোতে না গিয়ে বরং একটি বিষয়ে কথা বলতে চাই, যা আমাদের এ সময়ে কবিতায় বা কবিদের মধ্যে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা হলো ছন্দ। আধুনিক কবিতা বা সমকালীন কবিতা আমাদের বিষয়; কিন্তু এখানে আমরা আমাদের কবিতা, অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। অর্থাৎ কবিতা-যাপনকেই শেয়ার করছি। আমি কবিতাকে কীভাবে দেখি? কীভাবে বুঝি? আগে কবিতাগুলোকে কীভাবে বুঝেছিলাম সেটা। কিন্তু আমাদের মূল বিষয় বা আজকের আড্ডার বিষয় তা নয়।
কবিতা একটা নির্মাণের ব্যাপার, মানুষ হয়ে ওঠার ব্যাপার। একজন মানুষ আধুনিক হওয়ার জন্য যেসব উপাদান দরকার সেসব যদি না থাকে তাহলে একটা কবিতা সমকালীন হওয়া খুব কঠিন। আজকের দিনে বসে যদি আমি রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের ভাষায় কবিতা লিখি তাহলে আমার কবিতা সমকালীন হচ্ছে না। অতীতের অনেক বিষয়কে আয়ত্ত করে আধুনিক হয়ে লেখাটাই আধুনিকতা।
৭০ দশকের পর ৯০-এর কবিতাগুলো আলাদা করা যায়। এই আলাদা করার পেছনে অবশ্যই বিশ্ব রাজনীতি যুক্ত আছে। কিন্তু আমাদের সময় সত্যিকার অর্থেই কোনো স্বপ্নের জায়গা দেখছি না। আমাদের যে জায়গাটা বিচ্ছিন্ন যা আছে, সেখানটায় লিখে পেঁৗছানোর চেষ্টা আছে।
নাসির আহমেদ : আসলে কবি সবসময়ই সমকালীন এবং তা সমাজ ও বাস্তবতাবহির্ভূত নয়। স্বাধীনতার পর, এরশাদের পতনের পর কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর সে সময়ের কবিতাগুলোতে এ বিষয়গুলোর প্রাধান্য যেমন ছিল বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদের উত্থান, দেশের যে সার্বিক অবস্থা ও সমকালীন কবিতায় প্রকাশ পায় এবং পাবে। এখন ফেরদৌস মাহমুদ আমাদের এই আলোচনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
ফেরদৌস মাহমুদ : ভলতেয়ার একজন কবি; কিন্তু তার হওয়ার কথাছিল বিজ্ঞানী। তার কবি হওয়ার কারণ ভারি অদ্ভূত, সে সময় ধারণা ছিল আগুন হচ্ছে একটা উপাদান। তার ইচ্ছা হয়েছিল তিনি আগুনকে মাপবেন। যার কারণে তিনি বিভিন্ন প্রকারের লোহা পুড়তে থাকেন এবং পোড়া লোহা নিয়ে আগুনকে মাপেন। কিন্তু আগুন মাপতে গিয়ে তিনি আগুনে পোড়ার ফলে লোহার মধ্যে এক ধরণের রঙ দেখতে পেলেন, যা ভলতেয়ারের মধ্যে ভিন্ন এক অনুরণনের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের রঙও তাকে আকৃষ্ট করে। এই রঙই তাকে নিয়ে যায় সাহিত্যের দিকে। তিনি কিন্তু ভাবতেনও না, তিনি এভাবেই এক সময় কবি হয়ে উঠবেন।
এখন কথা হচ্ছে, কোনো এক অজানা কারণে নিজের অজান্তেই কবি যেহেতু কবিতার পথে আসেন তাহলে একজন কবিকে উপদেশ দিতে যাওয়াটা এক ধরণের দুঃসাহসের কাজ! অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি কবিকে ছন্দ শিখতে হবে এই কথাটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। একজন যখন কবি হয়ে ওঠেন ছন্দবোধ তার মধ্যে এমনিতেই থাকে। একজন কবি আসলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এক ধরনের নিজস্ব পাঠের মধ্য দিয়েই যান। ফলে অ্যাকাডেমিক ছন্দ তার জানা থাকে, কিন্তু এই বিষয়ে তার খুব একটা মাথব্যাথা নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি ছন্দটা মানতেও পারেন নাও পারেন এতে আসলে কিছুই যায় আসে না।
কবি আসলে তার নিজস্ব চলা, চিন্তা-ভাবনার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থেকে লিখতে থাকেন। যার কারণেই বর্তমান সময়ে এসে অ্যাকাডেমিক ছন্দের অভাব দেখা দিচ্ছে এবং এটাই স্বাভাবিক। এই সময়ের কবিরা আসলে কবিতার মধ্যে দিয়ে কথা বলে, একটা ভাবনাকে-অনুভ্থতিকে কবিতার মধ্যে, কবিতায় অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার মত চিত্রকল্প তৈরি করে নিজেকে প্রকাশ করে।
সময়টা আসলে প্রকৃতই ছন্দ মুক্তির। যা সমরসেন, ভাস্কর চক্রবর্তী অনেক আগেই করেছেন। এখন ছন্দ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ করা অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজকের সময়ে এসে সবকিছু খণ্ড খণ্ডভাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমরা ক্ষুদ্র একটি জায়গা থেকে বড় এটি পরিসর দেখতে চাই, যা আমাদের প্রচলিত ছন্দের সঙ্গে যায় না। যা ছন্দ থেকে মুক্ত হওয়ার আরও একটা কারণ। এবং সম্ভত শব্দই ঈশ্বর এই কথাটাও এখন অপ্রাসঙ্গিক।
বিজয় আহমেদ : বিষয়টি সমকালীন কবিতা। আমি বা আমরা যারা কবিতা লিখি তারা আসলে কোথায় যেতে চাই। আমাদের মাত্রা-বিন্দু ও সমাপ্ত বিন্দু কী? মাত্রা পথটা কী। মূল বিষয় হলো আমরা আসলে কবিতার দিকেই যেতে চাই। সেটা যেভাবেই হোক। আর রিফাত ভাইয়ের সঙ্গে আমিও একমত, কবিরা আসলেই একটু অসামাজিক। তারা সব অসামাজিকতা নিয়ে কবিতার দিকে যেতে চান। আর আমি বা আমরা যারা সমকালীন কবিতা লিখি তারাও সবকিছু নিয়ে কবিতার দিকে যেতে চাই। এটা কবিতার মাত্রা। ছন্দের যে বিষয়টা, সেটা হলো ছন্দ কাঠামোগত একটি সূত্র, এটি মানার কোনো দরকার নেই। এবং কবিতার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। আল মাহমুদের একটা কবিতা আমাকে ব্যাপক টানে_
ও পাড়ার মেয়ে রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার
তবু মেয়ে কবিতা বোঝে না
এখন পর্যন্ত জানি না এটা কোন ছন্দে লেখা। কারণ কবিতার ছন্দ নয়, কবিতার মূল বিষয়টাই আমাকে টেনে নিয়েছে। সুতরাং ছন্দ প্রয়োজনীয় নয়। কারণ কবিতার নিজস্ব একটি উচ্ছ্বাস আছে, একটা স্রোত আছে, যা দিয়ে কবিতা এগিয়ে যায়।
আল মাহমুদ : সমকালের আয়োজিত কবিতা বিষয়ক আড্ডায় এসে আমার অনেক ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এ কারণেই যে, এই সময় কবিতা নিয়ে ভাববার ও আলোচনা করবার মতো যোগ্য লোক তৈরি হয়েছে। এটা অবশ্যই আনন্দের কথা। আমি মনে করি সমকালীন গদ্য নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। কারণ অনেকেই ধারণা করছেন আমরা যে কবিতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি এটা হলো এক ধরনের পশ্চাৎপদতা। আমি নিজেও অবশ্য মনে করি আধুনিক গদ্য সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। কারণ গদ্যেই আধুনিকতা প্রকট হয়। সবাই বলেন, আমিও বলি। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে তা হয়নি। হয়েছে কবিতা নিয়ে।
টোকন ঠাকুর : কারণ এখানকার কবিতাই সমৃদ্ধ কথাসাহিত্য দুর্বল। সেজন্য সেটা নিয়ে আলোচনা হয় না।
আল মাহমুদ : হতে পারে সেটা। কিন্তু আমি তা মনে করি না। এ বিষয় নিয়ে তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমার ধারণা কবিতার পাশাপাশি আমাদের কথা সাহিত্যও সমকথ্য। উল্লেখযোগ্য গদ্য এ দেশে রাখা হয়েছে। হয়তো খুব বেশি না। কিন্তু উপন্যাসও লেখা হয়েছে এবং তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যা-ই হোক, তীক্ষষ্ট সব কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আজকের আড্ডা খুব ভালো হয়েছে।
ফারুক আহমেদ : আজকের আয়োজন, বলা যায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। আমাদের দু'জন প্রবীণ কবি আল মাহমুদ ও রফিক আজাদ ভাইসহ অনেকে ছিলেন। স্রেফ কবিতা নিয়ে এ ধরনের নিপাট আড্ডা হয়ে ওঠে না। আমাদের দেশে দেখা যায় কথাসাহিত্যের বই বিক্রি হচ্ছে দেদারছে; কবিতার বই হয়তো ততো নয়। কিন্তু কথাসাহিত্যেকের হয়ে এদেশে এখনও কবিরাই বেশি জনপ্রিয়। এবং সবসময়ই আমাদের সাহিত্যের বাঁকবদলের মূল জায়গাটায় থাকে কবিতা। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সাহিত্যের সারাৎসার কবিতা দিয়ে শুরু হয়ে কথাসাহিত্যে যায়। সুতরাং প্রতিনিধিত্ব বলতে যা বোঝায় এখন পর্যন্ত কবিরাই সে জায়গা দখল করে রেখেছেন। যে কারণেরই হোক বর্তমান সময়ে উপন্যাসের যে প্রসার তার বিপরীতে কবিতা বাঙলা সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা। আমার মনে হয় আগামী ২০-৫০- ১০০ বছর বাংলা সাহিত্য বা ভাষায় কবিতার রাজস্ব অক্ষুন্ন থাকবে।
আজকের এ আড্ডা আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো আমাদের সময়ের বিভিন্ন দশকের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে সাম্প্রতিক ভাবনার সঙ্গে পাঠকদের মেলবন্ধন ঘটানো। আশা করি এ আড্ডার ভেতর দিয়ে কবিতা সচেতন পাঠকরা খানিকটা হলেও এ বিষয়টি অনুভব করতে পারবেন।