বিগত ৬১ বৎসরে জামাতে ইসলামি যা করতে পারেনি, মাত্র ৬১ দিনে সে কাজটিই শাহবাগী তরুণ প্রজন্ম করে দেখিয়েছে। এ কারণে একজন মুসলমান হিসেবে যেমন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তেমনি শাহবাগীদেরও একটা ধন্যবাদ দিয়ে রাখি। সাথে সাথে আল্লাহপাকের পরিকল্পনাটুকু কতটা সুক্ষ, সে বিষয়টাও উপলব্ধী করার আহ্বান তাদের জানাতে চাই।
একটু খুলেই বলতে হয়। সেই ১৯৪১ সালে জামাতে ইসলামির প্রতিষ্ঠা। পূর্ব পাকিস্থানে, তথা আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু পাকিস্থান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই, ১৯৪৭ এ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গৃহিত রাজনৈতিক স্বিদ্ধান্তটির কারণে ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত দলটির সকল কার্যক্রম বন্ধ ছিল। নেতা-কর্র্মীরা অসংগঠিত অবস্থায় নিজ নিজ গন্ডি, পরিবার ও জীবনে ইসলামি আন্দোলনের ি চর্চা করে গেলেও সেটা একান্তই অসংগঠিত, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে ছিল। ‘জামাতে ইসলামি’ নামে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে আত্বপ্রকাশ করে ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পরেই।
একেবারে শুরু থেকেই আন্দোলনটি বাধার মুখে পড়ে। সেকুল্যারপন্থীরা যেমন এর পেছনে উঠে পড়ে লাগে, তেমনি সরকার এবং প্রশাসনও এ আন্দোলনকে ঠেকাতে তার সকল শক্তি নিয়োগ করে। এর বাইরে সমাজ ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত শক্তি, যারা দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তারাও এ আন্দোলনকে নিজ নিজ অবস্থানের জন্য হুমকি ভাবতে থাকে।
এটাই মুলত ইসলামি আন্দোলনের বৈশিষ্ঠ। ইসলামের সঠিক মতবাদ ও আদর্শের অবিকৃত রুপটাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তার সাথে ঐ সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামিক বা বিকৃত ইসলামিক যে কোন প্রতিষ্ঠান বা শক্তির বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। জামাতে ইসলামির ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম হয় নি। হবার কথাও নয়।
এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ইসলামি আলেম ওলামাদের সাথেও জামাতে ইসলামির আদর্শিক দ্বন্দ প্রায় সূচনালগ্নতেই তৈরী হয়, যা এখনও চলছে। মরহুম মাওলানা মওদুদীর অনেক লেখা ও মন্তব্যের সাথে তাদের দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু এই মতবিরোধটাকে উস্কে দিয়ে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অনুষংগ বানানো হয়েছে একটা পক্ষ হতে। ফলে একই ইসলামের অনুসারী হওয়া সত্তেও জামাতে ইসলামি ও কওমি/খারেজী/দেওবন্দী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিতদের মধ্যে দা কুমড়ো সম্পর্ক।
জামাতে ইসলাািমর উপরে অন্যতম অভিযোগ হলো, তারা ইসলামের নামে ‘রাজনীতি’ করে। কওমি/খারেজী/দেওবন্দী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতদের অনেকেতো জামাত অনুসারীদেরকে মুসলমানই মনে করেন না। এদিকে সেকুলারিষ্টদের পক্ষ থেকে জামাতের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে রাজনীতি করার সেই শতাব্দী পুরোনো অভিযোগতো আছেই।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই ১৯৪৭ সাল থেকে প্রথমত পূর্ব পাকিস্থান ও পরবর্তিতে আজকের বাংলাদেশে জামাতে ইসলামি আজ এই ২০১৩ সাল পর্যন্ত, মাঝের প্রায় পাঁচটি বৎসর (১৯৭১-১৯৭৫) বাদে মোট ৬১টি বৎসরে ইসলামি আন্দোলনের লক্ষ্যে অনেক কাজই তারা করেছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শত চেষ্টাতেও পারেনি। সেটা হলো কাওমি/খারেজী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং দেওবন্দী আলেমদের তারা রাজনীতিতে নামাতে পারেনি।
এদিকে চলতি ২০১৩ সালের বিগত ৫ই ফেব্র“য়ারী থেকে শুরু করে আজ ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত গুনে গুনে ৬১ দিন ধরে ঢাকার শাহবাগে কিছু নাস্তিক, সেকুলারিষ্ট মন মনস্ক তরুণ-তরুণী, ব্লগাররা মিলে যুদ্ধপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, ফাঁসির দাবী নিয়ে ‘প্রজন্ম মঞ্চ’ নামে মঞ্চ বানিয়ে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু যারা পুরো ঘটনার গতিপ্রবাহের প্রতি তীক্ষ নজর রাখছিলেন, তারা খুব ভাল করেই জানতেন, শাহবাগের এই আন্দোলন কেবল জামাতের কয়েকজন নেতার ফাঁসির দাবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা। এটা গড়াবে দেশ থেকে ইসলামি আন্দোলন, ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখার সাথে সংশ্লিষ্ঠ সকল কিছুর বিরুদ্ধে। ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতি ও তদ্বসংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও।
গড়িয়েছেও। ব্লগে যখন কোন কোন ব্লগাররা প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: ও তার সহধর্মিনীদের বিরুদ্ধে জঘণ্যতম ভাষায় কালীমা লেপন করে চলেছে, সরকার তখন নিশ্চুপ থেকেছে জেনে শুনেও! এমনকি আদালত কর্তৃক নির্দেশিত হয়েও তারা কোন পদক্ষেপ নেয় নি। ফলে সালমান রুশদীর চাইতেও জঘণ্যতম ভাষায় লেখা লেখি চলেছে গুটিকতক চিহ্নিত ব্লগার কর্তৃক। আর সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয় সেই একই সময়ে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিরোধি শীরকযুক্ত বিষয়বস্তু অন্তুর্ভূক্ত করে গেছে।
এরকম একটা মোক্ষম সময়েই শাহবাগীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ছাড়িয়ে দাবী জানালো, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, ইসলামি ব্যংক রাষ্ট্রায়াত্ব, ইসলামি টিভি ও পত্র-পত্রিকা বন্ধ করতে হবে বলে! যে হলমার্ক রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা চুরি করল, যে শেয়ার মার্কেট লক্ষ কোটি টাকা লুট করে নিল, তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা নেই! কিন্তু বন্ধ করে দিতে হবে বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যংক, বাংলাদেশের ইসলামি ব্যংক! দেশে হিন্দু-খৃষ্টান-ঐক্য পরিষদ নামের চরম সা¤প্রদায়িক সংগঠন রাজনীতি করতে পারবে, পারবে না কেবল ইসলামি দলগুলো!
ফলে যা হবার তাই হলো। শাহবাগীরা ভেবেছিল দেশের সব মুসলমানই বোধহয় রাজারবাগী, দেওয়ানবাগী, কুতুববাগীদের হাতে বন্দী। তারা ভেবেছিল বাংলাদেশের সব মুসলমানই বোধহয় আটরশীতে তাদের রশী বেঁধে রেখেছে! তারা ভাবেইনি, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৯৩ বৎসরের এক মর্দে মুজাহিদ এখনও বেঁচে আছেন। তাঁর একটামাত্র হুংকারেই দেশের আনাচে কানাচে থেকে আড়মোড়া ভেংগে বেরিয়ে এলেন তারই হাতে গড়া লক্ষ লক্ষ নবীপ্রেমী মুসলমান। কোটি কোটি সাধারণ মুসলমানরাও এগিয়ে এলেন এদের সমর্থনে!
কোথায় কোন অতলে হারিয়ে গেল ‘ব্যালে ডান্স মৌলভী’ শামীম আফজাল! কোথায় হারিয়ে গেল ‘মুরগী শাহরীয়ারে’র অপ্রশস্থ পালকের নীচে আশ্রয় নেয়া প্রমাণিত জঙ্গি সন্ত্রাসী ফরিদউদ্দীন মাসুদ! যে শাহবাগীরা নিত্য হুংকার ছাড়ছিল গেল দুটি মাস ধরে, তাদের গলাও মিলিয়ে গেল!
জেগে উঠলেন দেশে আপামর মুসলমানরা হক্কানী আলেমদের নেতৃত্বে। যে আলেমদেরকে বিগত ৬১ বৎসরেও জামাতে ইসলামি রাজনীতিতে নামাতে পারেনি, সেই একই আলেমদের রাজনীতির মাঠে টেনে আনল শাহবাগীরা মাত্র ৬১ দিনেই!
একেই বলে বুমেরাং। আল কুরআনেতো আল্লাহ পাক বলেই দিয়েছেন ‘ওয়া মাকারুহ, মাকারুল্লাহ, ওয়াল্লাহু খাইরুল মাক্বিরিন। তারা পরিকল্পনা করে, আল্লাহও পরিকল্পনা করেন, আর আল্লাহই উত্তম পরিকল্পনাকারী
বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের এ উপকারটুকু করে দেবার জন্য শাহবাগী তরুণপ্রজন্ম ধন্যবাদ পেতেই পারে। সুধী পাঠক, আপনারা কি বলেন?