ষোড়শ শতাব্দীর ভারত। ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারী মাত্র তের বৎসরের কিশোর আকবর সিংহাসনে আসীন হন। সূফী টাইপের মানুষ দাদা সম্রাট বাবরকে আকবর দেখেননি, তাঁর সান্নিধ্যও পাননি। তবে বাবা হুমায়ুনের সান্নিধ অল্পদিনের জন্য হলেও পেয়েছিলেন। হুমায়ুন ছিলেন খুবই নরম মনের মানুষ। ক্ষমা, মহত্ত, উদারতা, সততা, আল্লাহভীরুতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পিতা হুমায়ুন সিংহাসন হারিয়ে পালিয়েছিলেন, ক’বৎসর পরে তা পূণরুদ্ধারও করেন।
আকবরের জন্ম হয়েছিল পলাতক অবস্থায় পথে, রাজপ্রাসাদে নয়। আকবর লেখাপড়ার সুযোগ পাননি এ কারণেই। তের বৎসরের অশিক্ষিত অথবা খুবই স্বল্পশিক্ষিত কিশোর আকবর সম্রাট হলে চারপাশে জড়ো হয় সুযোগ সন্ধানী কিছু হিন্দু রাজপুত। সুবিজ্ঞ বৈরাম খাঁ’র কারণে আকবর এদের হাত থেকে অনেকটাই নিরাপদ রইলেন। কিন্তু যুবক আকবরকে পেয়ে বসল রিপুর তাড়না। পাঁচ বৎসর না যেতেই তিনি বৈরাম খাঁর অভিভাবত্বকে অস্বীকার করে তাকে অব্যহতি দিলেন। আঠারো বৎসর বয়সে নিজেই সর্বসর্বা। চাটুকার রাজপুতরা খেতাব দিল ‘দিল্লিশ্বর’! কেউবা ডাকল ‘জগদ্বীশ্বর’ বলেও!
কেবলই কি তাই? আকবরের মনস্তুষ্টিতে নামল প্রতিযোগীতায়। কে কার আগে সম্রাটের সাথে নিকট সম্পর্ক স্থাপন করে তার প্রিয় ভাজন হবে, সে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল। অম্বর ও জয়সালমীরের হিন্দু রাজারা নিজেদের রাজকন্যাকে আকবরের কাছে উপহার পাঠালো। সম্রাট সে উপহার (!) গ্রহণ করে রাজকুমারীদ্বয়কে বিয়ে করলেন।
কেবল তাই নয়, মহামান্য সম্রাট তাতেও ক্ষান্ত দিলেন না, দিতে পারলেনও না! কারণ, আমদানী ছিল খুব বেশী! সম্রাটের কৃপাপ্রার্থী হিন্দু ঠাকুররা এক এক করে কেউবা নিজ কন্যা, কেউবা নিজ বোনকে সম্রাটের হেরেম পাঠাতে থাকলে মহানূভব সম্রাটও দয়া করে সকলকে গ্রহণ করে নিজের রক্ষিতা বানিয়ে রাখলেন! পরবর্তি জীবনে উপহার পাওয়া অম্বরের রাজা ভগবান দাস ও মাড়োয়ারের রাজা উদয়সিংহের দুই কন্যার সাথে শাহজাদা সেলিমসহ দুই পুত্রের বিয়ে দিয়ে দেন।
বাদশাহ এসব রক্ষিতার জন্য শানদার প্রাসাদ করে দিতে লাগলেন মূল রাজপ্রাসাদের বাইরে মাঠের মধ্যে। সেইসব প্রাসাদগুলো ঘিরেই গড়ে উঠতে থাকল নাগরিক সুবিধাদী, কারণ সম্রাট প্রায়ই এসব বালাখানায় তাশরীফ আনেন! সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারাদার নিয়োগ দিতে হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, হাজার হলেও সম্রাটের রক্ষিতা বলে কথা কিনা! এভাবে একের পর এক প্রাসাদ গড়ে উঠতে উঠতে সেই ফাঁকা মাঠটিই একটা শহরের রুপ নিল। দিল্লির অনতিদূরে আজকের ফতেহপুর সিক্রীই হলো সেই শহর।
আকবরের প্রসাদে এইসব রাণী ও রক্ষিতারা মুসলিম সম্রাটকে বিয়ে করলেও, বা তার রক্ষিতা হিসেবে থাকলেও ধর্মে কর্মে সকলেই ছিল স্বাধীন। নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালনে প্রত্যেকেরই ছিল আলাদা পুজোর ঘর, দেব-দেবী, মন্দির। সবকিছুই মহানূভব সম্রাটের টাকায়। আর আকবর ও তার সভাসদ, এমনকি তার অগণিত সন্তানরাও মজে রইল মদ আর নষ্টামিতে।
সুফী সাধক বাবরের নাতী আর আল্লাহভীরু হুম্য়াুন-হামিদা বানূ’র সন্তান অশিক্ষিত আকবর সম্রাট সেজে রাজপরিবারে অনৈসলামিক পৌত্তলিক ও ব্যভিচারি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করলেন। আর তার রসদ সরবরাহ করে চলল হিন্দু সভাষদরা।
ততদিনে ভারতবর্ষে বাণিজ্যের নামে পর্তুগীজ বণিকরা আনাগোণা শুরু করলেও রাজমহলে তারা তখনও ঠাঁই পায়নি। এরই মধ্যে ঘটল আরও এক ঘটনা। ইংল্যন্ডের ডারবিতে জন্ম নেয়া লন্ডনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী রালফ ফিচের (জধষঢ়য ঋরঃপয ) ব্যবসা মন্দা। ইংল্যন্ডে কোন আশার আলো না দেখে তিনি স্পেন হয়ে পারস্য ও শেষে ভারতবর্ষে গেলেন ব্যবসার বাজার খুঁজতে। ভারতে পৌছে তার চোখ কপালে ওঠে সম্পদ আর ঐশ্বর্য , বিত্ত আর বৈভব দেখে! চতুর রালফ অচিরেই রাজদরবারে আসন গেড়ে নেয়। মাতালে মাতালে বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি।
এই প্রথমবারের মত মোগল রাজদরবারে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটল। সেটা সেই ১৫৭৭ সালের ঘটনা। রালফ দেশে তার এক বন্ধুর কাছে ফিরতি স্বদেশী জাহাজের মাধ্যমে চিঠি লিখে পাঠান ভারতের বিষ্ময়কর ঐশ্বর্য আর সম্পদের বিবরণ দিয়ে। সে চিঠিতে বর্ণিত অবিশ্বাস্য ঐশ্বর্যের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে ইংল্যন্ডবাসীরমত তা অচিরেই রাণী প্রথম এলিজোবেথের দৃষ্টিতেও পড়ে। (চিঠিটি ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ এ ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান নামক পত্রিকায় পূন:প্রকাশিত হয়েছিল )
ষোড়শ শতাব্দীর ইংল্যন্ডের জনসংখ্যা ছিল পচিশ লক্ষের মত। অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ ইংল্যন্ড বেকারত্বের ভারে জর্জরিত ও অর্থনৈতিভাবে এক মহামন্দায় নিপতিত ছিল। প্রায় দশ হাজারেরও বেশী ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিল উপদ্বীপটি। রাণী তা হতে নিস্তারের পথ খুঁজছিলেন।
রাণী এলিজাবেথের অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও লেখক জন ডী (ঔড়যহ উবব ১৫২৭-১৬০৯)। ইংল্যন্ডের জনগণ যখন দু’বেলা পেটপুরে খেতে পায় না, সেই সময়েই তিনি রাণীকে বিশ্বব্যাপি একটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। ইংল্যন্ডের ইতিহাসে ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার’ শব্দটিও এই স্বপ্নদ্রষ্টা সর্বপ্রথমবারের মত ব্যবহার করলে ইংল্যন্ডের কুলীন সমাজ টিটকারীভরে ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে তা উড়িয়ে দেয়! তাকে উপহাসও করে অনেকে।
এই জন ডী’র পরামর্শেই রাণী এলিজাবেথ ১৫৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘এলিজোবেথ লিভেন্ট কোম্পানী’ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তুরস্কের ইসলামি খেলাফতের সাথে তারা ব্যবসা শুরু করে। রাণী এলিজাবেথ তার এই কোম্পানীরই একজন দূত হিসেবে রালফ ফিচকে ভারতবর্ষে পাঠান। সাথে সম্রাট আকবরের রাজদরবারে রালফকে ইংল্যন্ডের দূত হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্রও দেন।
আগের সফরে রালফের সাথে সম্রাটের বন্ধুত্ব গড়ে উঠার সুবাদে সম্রাট আকবর রালফকে সাদরে গ্রহণ করেন ইংল্যন্ডের রাণীর দূত হিসেবে, কুটনৈতিক মর্যাদায়। ভারতবর্ষে বিনাশুল্কে ব্যবসার অনুমতিও দেন। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ‘এলিজাবেথ লিভেন্ট কোম্পানি’র গভর্নর ও রাণীর দূত হিসেবে রালফ ফিচ কেবল ব্যবসাই করেননি, তিনি মোগল রাজমহলে হিন্দত্ববাদীতার আক্রমণে ইতোমধ্যে কলুষিত হওয়া ইসলামি সংস্কৃতিকে আরও বেশী কলুষিত করেছেন।
সেই শুরু। রাজমহলে আগে ছিল কেবলমাত্র হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিক সংস্কৃতির একচ্ছত্র দাপট। আর এখন থেকে আসন গাড়ল ইউরোপীয় খৃষ্টবাদী সংস্কৃতির ভোগবাদী রুপ। ভোগবাদীতার ইউরোপীয় রুপে সম্রাট আকবরও বিনোদনে ভিন্নমাত্রা পান। একই আস্বাদনে উদ্বেলিত হলো রাজদবারের অন্যান্য রাজপুত্ররাও। এভাবেই ভেংগে পড়তে থাকে ভারতে মুসলিম সমাজব্যবস্থার রক্ষাকবচ; ইসলামি সংস্কৃতি।
রাজ্য পরিচালনায় নিয়োজিত, রাজ্যের ভালমন্দের দায়িত্ব ছিল যাদের হাতে, সেই তাদের মন মগজ হতে ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ ও নিষ্ঠা দূর হতে থাকে। বাড়তে থাকে বিচ্যুতি ইসলামি জীবনধারা হতেও। উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ‘ঘুঁষ’ নামক মহৌষধের জন্মও সেই তখন থেকেই। এই মহৌষধের সফল প্রয়োগে পলাশীর বিপর্যয়ই কেবল নয়, হালের পদ্মাসেতু কেলেংকারীরও জন্ম বটে!
বিচ্যুতির এই ধারাবাহিকতাতেই আকবর একদিন ভাবার সাহস পেলেন, ইসলাম নয়, তিনি একটা ধর্ম তৈরী করবেন, যা তার সকল প্রজাবৃন্দ, একাধারে হিন্দু, মুসলিম আর খৃষ্টান বন্ধুদের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে! হিন্দু রাজপুত সভাষদ, আটশত রক্ষিতার গর্ভে জন্ম নেয়া, তাদের সান্নিধ্যে অনৈসলামিক সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা রাজপুত্ররা এবং ঐ একই পরিবেশে সময় কাটাতে অভ্যস্ত আলেম নামধারী কিছু আফিমখোর পাঁড় মাতাল এবং আকবর, সকলে মিলে দ্বীন-এ-ঈলাহি করেছিলেন ইসলামের বিপরিতে।
সেটাই শেষ ঘটনা নয়। যে সংস্কৃতির লালন ও বিস্তার ঘটেছে রাজপ্রসাদে, তার কাছে আল্লাহর একত্ববাদ অসহ্য। রাজদরবারে ও রাজপরিবারে তখনকার প্রজন্ম অন্য সব ধর্মকে সহ্য করলেও ইসলামকে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই আকবরের পরবর্তি বংশধরদেরও আমরা একই ভূমিকায় দেখি। আকবরপুত্র সম্রাট জাহাঙ্গির আর সুফি দরবেশ মুজাদ্দিদে আলফেসানী আহমদ রহ: এর দ্বন্দের কথাতো ইতিহাস! সম্রাট শাহজানের পুত্র দারাতো আলকুরআনের বিপরিতে জগাখচুড়ি মার্কা এক ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন! নাম দিয়েছিলেন ‘মাজমাউল বাহরাইন’ অর্থাৎ ‘সাগরদ্বয়ের মিলন’। হিন্দু ও মুসলমান দুই স¤প্রদায়ের মিলন ঘটাবে, এমন এক ধর্মীয় গ্রন্থ!!
তের বৎসরের কিশোর সম্রাট আকবরের অন্তর হতে ইসলামি সংস্কৃতি নির্বাসিত হতে শুরু করেছিল, আর পরিণত বয়সে সেই শুন্যস্থানই পূরণ করতে তারই মাথা হতে উদ্ভাবিত হচ্ছে, দ্বীন ই ইলাহি! এক জিন্দাপীর আলমগীর ছাড়া প্রায় একই কথা খাটে পরবর্তি প্রতিটি মোগল শাসকের বেলায়। পৃথিবীতে কোন শুন্যস্থানই শুন্য থাকেনা। তা ভরাট হবেই, হতেই হবে। নিয়মটা কেবল পদার্থবিদ্যারই নয়, পৃথিবীরও বটে!
এবার পাঠক ভাবুন আজকের বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ইসলামি চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে সরেছে। রুশদী কিংবা তসলিমা নাসরিন যে কথা লেখার সাহস পায়নি, সে কথাই নির্দ্বিধায়, নি:শঙ্কচিত্তে লিখেছে মুসলিম বাবা-মা’র ঘরে জন্ম নেয়া তরুণ ‘থাবাবাবা’ ওরফে রাজিব।
এরকম ‘থাবাবাবা’ শত শত, হাজার হাজার নয়, বরং লক্ষ লক্ষ আছে বাংলাদেশে। এদের এই মানসকিতা একদিনে তৈরী হয়নি। ’৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্থান হয়ে বাংলাদেশে ইসলামি সাংস্কৃতির স্থলে পৌত্তলিক ও ধর্মহীন সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর সযতœ প্রয়াস চলছে। মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতারা ইসলামের নামে রাজনীতি করলেও অনেকেই নিজেদের পরিবার এবং ব্যক্তিজীবনে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা ও লালন করেননি, ফলে তাদের ঘর থেকেই বেরিয়ে এসেছে কট্টর ইসলামবিদ্বেষী সন্তান, যাদের অনেকেই আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়, তথাকথিত ‘প্রগতিশীল শক্তি’র পূরোধা হিসেবে!
বিগত চারটি দশক বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতিবীদরা ইসলামি সাংস্কৃতির বিস্তার ও অপসংস্কৃতি রোধে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেননি। লেখালেখি, মিডিয়া ও প্রকাশনা, গান-নাটক-সিনেমা এসব তাদের কাছে ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে বিবেচিত হয়নি ‘আনূগত্যের গুরুত্ব’ বিষয়ক বক্তৃতার বিপরিতে। ছায়ানটের বিপরিতে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি, গড়তেও দেননি। কারণ সেটা নাকি ‘সংগঠনের ভেতরে আরও একটা সংগঠন’ সৃষ্টির শামিল। অর্থাৎ ‘শৃংখলাভংগ’। একটু আধটু প্রচেষ্টা যারা করেছেন, এখনও করছেন, তারা যে বিশাল বৈরিতার মূখোমুখি হয়েছেন, তা বর্ণনাতীত।
ফল কি হয়েছে? সেটা জানার জন্য আজ শাহবাগে যেসব তরুণ হাজির হয়েছে, তাদের জীবনাচারে চোখ দিন। চোখ দিন বাংলা ব্লগে কি লেখা হচ্ছে, কারা লিখছে, সেদিকে। সেখানেই প্রশ্নটির জবাব রয়েছে। এখনও সময় আছে, যারা এই দেশ, এই ভূখন্ড, এই উম্মাহ আর ইসলামি আন্দোলন নিয়ে ভাবেন, যারা ‘শাহবাগী নাস্তিকতা’কে রুখতে চান, তারা ইতিহাসের বাঁক থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
ধনঁধৎরভ@ুধযড়ড়.পড়স