পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেল আমাদের বাড়ীর পাশের দেশ, প্রতিবেশি ভারত সরকার বাংলাদেশে আবার কিভাবে আওয়ামি লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনা যায়, সে প্লান চুড়ান্ত করেছে। সে দেশের বহুল প্রচারিত একটি সাময়িকি আউটলুক এর গেল সংখ্যায় এমনই একটা খবর দিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন স¤প্রতি ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জির সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা সাংবাদিক এস এন এম আবদি।
ভারত সরকার, সে দেশের মিডিয়া ও সুশীল সমাজ অত্যন্ত খোলামেলাভাবেই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। কদিন আগে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম খবর দিল শাহবাগের জনতার মঞ্চ ভারতের ইন্ধন আর সহায়তায় প্রতিষ্ঠত ও পরিচালিত হচ্ছে।
এ থেকে এটা স্পষ্টতই প্রতিয়মাণ যে, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পৃথক ও স্বাতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয়। যদি শ্রদ্ধাশীল হতো, তা হলে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে কোন বিশেষ দলকে ক্ষমতায় বসাতে সকল প্রকার আয়োজনে সচেষ্ট হবার কথা নয়।
অধূনা বিশ্বে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন কোন রাষ্ট্র তাদের নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় ভিন্ন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর জন্য সচেষ্ট থাকে পর্দার আড়ালে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌহার্দ ও কুটনৈতিক ভব্যতা বজায় রাখতে গিয়ে তারা তাদের সে প্রচেষ্টাকে সব সময়ই গোপন রাখেন। কালেভদ্রে কোন লক্ষণ প্রকাশ হয়ে পড়লেও তারা তা গোপন করতে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেন। অস্বীকার করেন কুটনৈতিক ভাষায়।
কিন্তু ইদানিং প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে ওরকম কোন নুন্যতম সৌজন্যতার ধারও ধারছে না। ভাবখানা এমন, তারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক কুটনীতির কোন পরওয়াই করেন না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার ও ক্ষমতার বাইরে বিরোধি দলীয় জোট, উভয়ের মধ্যে বর্তমানে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ চলে আসছে। ক্ষমতাসীন সরকার যে কোন মূল্যে আগামিতেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান। আসন্ন নির্বাচনটাকে যেন নিজেদের মত করে করা যায়, এর ফলাফলটা যেন ইচ্ছেমত বানিয়ে নেয়া যায় সে লক্ষ্যে তারা প্রশাসন যেমন সাজিয়েছে, তেমনি বিরোধি দলীয় রাজনীতিকে ধ্বংস করতে, নেতা-কর্মীদের জেলে ভরে, মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করে মাঠ ফাঁকা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তাদের সে প্রচেষ্টার সাথে সাথে প্রতিবেশি দেশের সরকারও যখন একই লক্ষ্যে কাজে নামেন, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে এভাবে উঠে পড়া লাগা কতটা স্বৎপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ? তার উপরে বাংলাদেশী জনগণের জন্য এটাও ভাবার বিষয় হলো, প্রতিবেশী দেশ আমাদের পৃথক স্বাধীন সত্তার প্রতি কতটা উদাসীন হলে প্রকাশ্যে এসব অপ্রতিবেশীসুলভ প্রচেষ্টার কথা ঘটা করে মিডিয়ায় প্রকাশও করতে পারে।
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে কখনই মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি, নেবার কোন লক্ষণও তাদের কর্মকান্ডে নেই। বরং পূর্বসীমান্তে নিজেদের পেটের মধ্যে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই স্বাধীন ভূখন্ডটি যেন তাদের গলার কাঁটার হয়ে আছে। হায়দ্রাবাদ, সিকিম আর কাশ্মীরের মত করে এটিকে গিলে ফেলতে না পারলে সাউথব্লকেরতো বটেই, এমনকি সীমান্তঘেঁষে বাঙ্গালী বাবুদেরও ঘুম হচ্ছে না। কোলকাতার বাবুরা আগ বাড়িয়ে দিল্লির দাসত্বের দড়িখানা নিজেদের গলায় ঝুলিয়ে কৃতার্থবোধ করছেন, পাশাপাশি এপার বাংলা ওপার বাংলা একত্রিকরণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে এটাও ভাবছেন যে, পূর্ববাংলা, তথা স্বাধীন বাংলাদেশও বোধহয় তাদের মত করে অধীনতার রজ্জুকে ‘বিজয়মাল্য’ ভেবে নিজেদের গলায় পরাবে।
দাদাবাবুরা কেবল স্বপ্নের মধ্যে ডুবে থাকলে কোন কথা ছিল না। তারা বরং এ স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে সবরকম প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর থেকে বিগত চল্লিশটা বৎসর এপার বাংলার ইসলামি ভাবগাম্ভির্যময় সাংস্কৃতিকে ভেঙ্গে দিয়ে তদস্থলে বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে উঠে পড়ে লেগেছে এবং আশাতীতভাবে সফলও হয়েছে। এপারে কিছু পরান্নভোজী বিবেকহীন সংস্কৃতিকর্মীর প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইসলামি চেতনাধারীদের ক্ষমাহীন ব্যর্থতার কারণে আজ দু’বাংলার সাংস্কৃতিক বৈপরিত্য প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে ধ্বংস করে দেবার পরে দাদাবাবুরা এখন খোলাখুলি আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। এরই প্রমাণ হিসেবে দেখছি রাষ্ট্রপতি প্রণব বাবু রাষ্ট্রিয় সফরে এলেও শাহবাগের তরুণদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতে ভূল করেননি।
এমনাবস্থায় বাংলাদেশী তরুণ-যুবা স¤প্রদায়ের ক্ষমাহীন নিস্পৃহতা, স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব নিয়ে নিদারুণ উদাসীনতা দেখে আমার পুরোনো ইতিহাস বার বার মনে পড়ে যায়। আমি যেন তাদের এহেন আচরণের মধ্যে ইতিহাসের এক ভয়ংকর প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাই।
মনে পড়ে যায় মুসলিম স্পেনে মুসলমানদের ক্ষমাহীন নিস্পৃহতা আর অনৈক্যের কারণে তাদের স্বাধীনতা হারানোর কথা। ৭১১ সালে তারেক বিন জিয়াদের সেই বিপ্লবী ঐতিহাসিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু হওয়া আর ৭৫২ সালে খলীফা আব্দুর রহমানের হাত ধরে সমাপ্ত হওয়া স্পেন বিজয় পুরো বিশ্বের ইতিহাসকেই চিরদিনের মত বদলে দিয়েছিল।
৭৫৬ সালে (অধূনা স্পেন ও পর্তুগাল) যে আইবেরিয়েন পেনিনসুলা ভূখন্ডের একেবারে উত্তর এলাকায় ‘সান্তান্দার’ আর ‘ওবেদো’ ছাড়া আর কোন ভূখন্ডই ছিল না খৃষ্টানদের হাতে, সেই সেখান থেকেই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ৯৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তারা উত্তর পুর্বের ‘বার্সিলোনা’ শহর থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিমের ‘পোর্টো’ পর্যন্ত দখল করে নেয়। কিন্তু মুসলমানরা তখন ফেকাহশাস্ত্রে মতদ্বৈততার কারণে একে অপরকে কাফের ফতওয়া দিয়ে বিবাদে লিপ্ত। কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বরং এক মুসলিম গোষ্ঠি অপর মুসলিম গোষ্ঠিকে দমনের জন্য খৃষ্টানদের কাছ থেকে সহযোগীতাও নিয়েছে।
১০৮০ খৃষ্টাব্দে তারা যখন মধ্য স্পেন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে, সেই তখনও মুসলমানরা একে অপরকে দমনেই ব্যস্ত। আর এর ফলশ্র“তিতে ১১৬০ এর মধ্যে আধুনিক পর্তুগালের রাজধানী লিসবন, স্পেনের টলেডো, সারাগোসা রাজ্যগুলো মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। এসময় পুরো স্পেন ছোট খাটো ২৩টি মুসলিম রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এসব মুসলিম রাজ্য খৃষ্টানদের সহযোগিতা নিয়ে পাশ্ববর্তি মুসলমানদের শায়েস্তা (!) করতে ব্যস্ত ছিল। চোখের সামনে একের পর এক স্বগোত্রীয় মুসলিম রাজ্যকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হারাতে দেখেও তাদের বোধোদয় হয়নি!
১২১২ সালে যখন খৃষ্টানরা কর্ডোভার দোরগোড়ায় হাজির, সেই তখনও স্পেনের আলেম ও সাধারণ মুসলমানরা আজকের বাংলাদেশের মতই একে অপরের মধ্যে কে কতটা মজবুত ঈমানদার, সে বিতর্কে লিপ্ত। আর এ সুযোগে কর্ডোভা, সেভিল, ভ্যালেন্সিয়ার মত মুসলিম রাজ্যগলো খৃষ্টানরা গিলে ফেললেও মুসলমানরা এক হয়ে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। খৃষ্টানরা তাদের মধ্যে সংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক জিইয়ে রাখে। এ লক্ষ্যে তারা মুসলিম সমাজে বেতনভূক্ত লেখক, বক্তা ও বুদ্ধিজীবি নিয়োগ দেয় সেই সমাজের মধ্য থেকেই।
মুসলিম সমাজের বিবেক বিক্রি করা এইসব তথাকথিত লেখক, বুদ্ধিজীবিরা খৃষ্টানদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ আর বিতর্ককে উপভোগ্যের আকারে চালু রেখেছিলেন। ঐ ভূখন্ডে ২৩টি মুসলিম রাজ্যের মধ্যে ততদিনে (১২৫০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ) এক এক করে উনিশটি রাজ্যই খৃষ্টানরা গিলে ফেলেছে, তার পরেও বাঁকি চারটি মুসলিম রাজ্য নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, একমাত্র সেইসব রাজ্যগুলির তথাকথিত সুশীল সমাজের কারণে। তারা নিজ নিজ এলাকার জনগণকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল মজহাবি বিতর্কে। ঠিক আজকের বাংলাদেশ যেন!
এর ফলে পরবর্তি ২৪২ বৎসরের মধ্যে বাঁকি চারটি রাজ্যও তাদের স্বাধীনতা হারায়। ১৪৯২ খৃষ্টাব্দে গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু আব্দুল্লাহকে চোখের অশ্র“ ফেলতে ফেলতে স্বপরিবারে আল হামরা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। মজহাবী বিতর্ক আর একে অপরকে ঈমানের পরীক্ষায় ধরশায়ী করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সেদিন তাদের বাঁচাতে পারেনি। এর মুল্য যে কেবল তারাই দিয়েছেন, তা নয়। এর মুল্য দিতে হয়েছে তাদের পরবর্তি প্রজন্মকেও। আজও বিশ্বের মুসলমান স¤প্রদায় সেদিনে তাদের সেই নিস্পৃহতার মুল্য গুনে চলেছে!
সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি নিকট অতিতে, আমাদের ভারতবর্ষের মাটিতে। সেক্ষেত্রেও নিস্পৃহ-নিষ্কর্মা গোষ্ঠি তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে নিজেদের অকর্মণ্যতার মুল্য পরিশোধ করেছিল। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। সুচতুর ইংরেজ বণীকরা এক এক করে ভারতবর্ষ দখল করে নিল চোখের সামনে। সব দেখেও তারা কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারল না। স্বাধীনতা তাদেরও হারাতে হয়েছিল। দীর্ঘ দুইটি শতাব্দী টানতে হলো পরাধীনতার গ্লানী।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার হারাতে দেখেও ভারতবাসী কোন শিক্ষা নেয়নি। তারই ফলশ্র“তিতে ১৮৪৩ সালে সিন্ধু হারাতে হলো। এর পরেও তারা মগ্ন রইল নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদে। এ সুযোগে মাত্র একটি বৎসরের মধ্যেই ইংরেজরা ১৮৪৪ সালে গোয়ালিয়র দখল করল। তারপরেও ভারতবাসীর বোধোদয় হলো না! এর ফলও ভোগ করতে হলো ১৮৪৯ এ ভারতের ‘শষ্যভান্ডার’ পাঞ্জাব হারিয়ে। চেতনাহীন ভারতবাসীর নাকের ডগায় এর পরে এক এক করে ১৮৫২তে বার্মা এবং আফগানিস্থান, ১৮৫৩তে নাগপুর, আর ১৮৫৬তে অযোধ্যা বেদখল হলো! আর ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহকে দিল্লি থেকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠিয়ে ভারত বিজয়ের ষোলকলা পূর্ণ করল ইংরেজরা।
এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি গ্রানাডা থেকে পলাশীর বাঁকে বাঁকে লুকোনো গ্লানীময় এ ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা নেবে?