অবাক ফাল্গুনঃ প্রথম পর্ব
অবাক ফাল্গুনঃ দ্বিতীয় পর্ব
আজমল ইন্টারভিউর ওয়েটিং রুমে শক্ত হয়ে বসে আছে। ওর দৃষ্টি এখন পাশে বসা লোকটার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। আজমলের দৃষ্টি এখন বাঘের মত। বাঘের মত বলতে যে বাঘের দৃষ্টির প্রশংসা করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। বাঘ শিকার করবার আগে যখন আস্তে আস্তে করে হাঁটে তখন বাঘের দৃষ্টিতে চোর চোর ভাব থাকে। আজমলের দৃষ্টি এখন সেই বাঘের দৃষ্টির মত। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে আজমল খামোখা বাঘের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই― ও তাকিয়ে আছে কারন পাশে বসা লোকটা এখন মোবাইলে ১০০ টাকার কার্ড ঘষছে—রিচার্জ করবে বলে। আজমল স্পষ্ট লোকটার কার্ড দেখতে পারছে। তাই ও এখন বিশাল প্লানে আছে যাতে করে কার্ডের নাম্বারগুলো ও লোকটার আগে নিজের মোবাইলে প্রবেশ করিয়ে ১০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। বাহ, কি চমৎকার বুদ্ধি—কি চমৎকার চুরি! একেই বলে ডিজিটাল চুরি। ডিজিটাল বাংলাদেশে অবশ্যই ডিজিটাল চুরি হবে।
লোকটা অবশ্য বেশ স্বাস্থ্যবান। যদি বুঝতে পারে যে আজমল ওর মোবাইল কার্ডের ১০০ টাকা চুরি করবার ইচ্ছায় নিয়োজিত আছে তাহলে কোন উদ্ভট কান্ড ঘটিয়ে বসতে পারে। উদ্ভট কান্ড না ঘটালেও যদি আজমলে শরীর ধরে ঝাকির মত কিছু একটা করে দেয় তাহলেই শেষ। দেখতেও কিরকম গুন্ডা গুন্ডা লাগে।
১০০ টাকা পেতে গিয়ে কি দুর্ঘটনা হবে তা ভেবে তো লাভ নেই বরং একশ টাকা পেলে কি হবে সেটাই আসল কথা। আজমল যেরকম কৃপন তাতে ১০০ টাকা দিয়ে অন্তত তিনমাস মোবাইলে কথা বলতে পারবে। তিনমাস আরামে থাকবে এটা ভেবেই খুশিতে আজমল মনে মনে লাফিয়ে উঠল। ও এসেছে ইন্টারভ্যু দিতে—এম্নিতেই ইন্টারভ্যুর পিছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এসময় ১০০ টাকার সুযোগ মিস করা উচিত না।
লোকটার কার্ড ঘষা শেষ। এখন নাম্বার মোবাইলে লেখা শুরু করে দিয়েছে। আজমলের একটু আশঙ্কা ছিল যে নাম্বার লেখার সময় লোকটা অন্যদিকে ফিরে নাম্বার লেখা শুরু না করে। এখন সে সন্দেহ কেটে গেছে। গাধাটা এদিকে ফিরেই কার্ড রিচার্জ করছে। এটাকে গাধা বলা উচিত হয়নি। যার কারনে আজমল ১০০ টাকা পাবে তাকে গাধা বলা উচিত না। মটকু বলা যেতে পারে। আজমল যদি ১০০ টাকা নিয়ে যেতে পারে তাহলে এই মটকু নিশ্চয়ই কিছু বুঝবে না।
মটকুর পাঁচটা নাম্বার প্রবেশ করা শেষ এদিকে আজমলের আটটা নাম্বার শেষ। আর মাত্র কয়েকটা নাম্বার! উত্তেজনায় আজমলের বুক কাপছে। ওকে অবশ্যই মটকুর আগে কার্ড ভরতে হবে― আর সেটা করতেও বেশি দেরী নেই।
আজমলের যখন মাত্র দুইটা নাম্বার ঢুকান বাকি তখন তপু এসে আজমলের পাশে বসল। (তপুকে যারা চেনেন না তারা অবাক ফাল্গুনের আগের পর্বগুলো পড়তে পারেন। তাহলেই বুঝবেন তপু আসলে কি?)
তপু একটু অসতর্কভাবে বসেছিল (আসলে ইচ্ছা করেই ওভাবে বসেছিল), তাই আজমলের গায়ে ধাক্কা লাগল। আজমলের হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। আজমল কয়েক মুহূর্তের জন্য মোবাইলের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল— এইমাত্র যা ঘটল তা ও বিশ্বাস করতে পারল না। আজমল সাথে সাথে মোবাইল উঠাল। উঠিয়ে আবার নাম্বার প্রবেশ করাতে গেল কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। মটকুর নাম্বার ঢুকান শেষ! ওর কার্ড রিচার্জ হয়ে গেছে।
আজমল তপুর উপর ক্ষেপে উঠল।
আজমল চিৎকার দিয়ে বলল, ওই মিয়া, দেইখ্যা চলতে পারেন না। আমার মোবাইলটা তো শেষ করে দিলেন!
তপু হেসে বলল, আপনি ভাই গন্ডার নাকি! গন্ডারের রাগ হতে আপনার মত সময় লাগে। আপনি যেমন আপনার মোবাইল পড়বার পাক্কা তিন মিনিট পরে রেগে গেলেন—গন্ডারও কিন্তু এরকমই করে!
গন্ডার তো আপনার সম্বুন্ধি তাই আপনারে বলে দিয়ে গেছে! আমারে দেখলে কি গন্ডারের মত লাগে?
আজমলের পাশে বসা আসল গন্ডাররূপী মটকু বলল, কারে দেখতে গন্ডারের মত লাগে? (মনে হয়, ওনাকে প্রায়ই মানুষ গন্ডার বলে ডাকে।)
আজমল ক্ষীণস্বরে পাশে বসা মটকুকে বলল, ভাই, আপনারে কিছু বলি না। আপনি কিছু না।
অ। মটকু ঝিমাচ্ছিল— আজমলের কথা শুনে পুনরায় ঝিমাতে শুরু করল।
তপু ওদের অবস্থা দেখে হেসে দিল।
আজমল আরও রেগে গেল। বলল, হাসবার কি হইল? আমারে এখন মোবাইল সারাবার দাম দিতে হবে।
তপু বলল, আপনার মোবাইলের তো কিছুই হয় নাই।
আমার মোবাইলের যে কিছু হয় নাই সেটা আমি বুঝব। আপনি বলার কে?
ক্ষেপছেন কেন?
ক্ষেপছি কেন তা এখনো বুঝেন নাই। তাড়াতাড়ি আমার মোবাইল ঠিক করার টাকা বাইর করেন।
আপনি কেন আমার উপর ক্ষেপছেন তা কিন্তু আমি বুঝেছি! আমি সব দেখেছি।
মানে কি! কি বুঝছেন আপনে?
সেটা এখানে বললে আপনার ক্ষতি হতে পারে।
আজমল সামান্য ভয় পেল। ওর বয়সী যুবকটাকে ও প্রথমে বোকা ভেবেছিল। এখন তো চালাক বলে মনে হচ্ছে।
আজমল বলল, দূর মিয়া, কি সব বলতাছেন!
তাহলে এইমাত্র আপনি কি করতে চাচ্ছিলেন তা আমি বলেই ফেলি—কি বলেন?
আপনে এখান থেকে যান তো।
যাব কেন? মোবাইল সারাবার টাকা দেব না? (তপুর মুখে হাসি।)
আরে যান তো মিয়া, আমার সাথে ক্যাচাল পাইরেন না।
১০০ টাকা একটুর জন্য ফসকে গেল—তাই না?
আজমল থ হয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, আপনি মনে করছেন কি? আপনি যা বলবেন সবাই তা বিশ্বাস করবে? শোনেন আমার সাথে ঝামেলায় আসতে চাইয়েন না। নিজে ঝামেলায় পড়বেন।
আপনি যা করছিলেন তা সব মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছি। ভিডিও টা আপনার গন্ডারভাইকে দেখাই কি বলেন?
এই কথাটা অবশ্য মিথ্যা। তপু আসলে মজা করে বলেছে। এই লোকটার সাথে কথা বলে তপু মজা পাচ্ছে খুব।
আজমল এবার ভয় বেশিই পেল। নরম গলায় বলল, ভাই, আপনে ইন্টারভিউ দিতে আসছেন না?
হ্যাঁ।
কিছু মনে করবেন না ভাই, একটু এইদিকে আসেন তো― আপনার সাথে কথা বলি।
আজমল তপুকে অন্য এক দিকে টেনে নিয়ে বসাল।
আজমল বলল, ভাই, আপনে কি আমারে বিপদে ফেলতে চান।
তপু হাসিমুখে বলল, বিপদে ফেলব কেন? আমি তো আপনার মোবাইল সারাবার দাম দিতে চাই।
আজমল বলল, শুধু শুধু মশকরা কইরেন না। আমারে এখন বিপদে ফেলে আপনার কোন লাভ হবে না। বিপদ কাটানোর জন্য আপনারে যে টাকা দিবো তাও আমার কাছে নাই। পকেটে আছে মাত্র ৫০ টাকা। এই টাকা নিতে চাইলে নিতে পারেন। বাকি সব টাকাই তো ইন্টারভিউর পিছে খরচ করলাম।
ইন্টারভিউর পিছনে খরচ হয়েছে কত?
একথা জিজ্ঞেস করেন কেন? আপনি কোন খরচ করেন নাই?
না।
বলেন কি! টাকা কিছুই দিলেন না আর চাকরি পাবেন― এটা তো হতে পারে না।
আপনি কত টাকা দিয়েছেন তা তো বললেন না।
আজমল খুশি হল। লোকটাকে অন্য প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে আনা গেছে। এখন আর মোবাইল নিয়ে কথা নাও বলতে পারে।
আজমল বলল, এইসব গোপন ব্যাপার। এগুলা সবাইরে বলতে নাই। তবে আমার যে চাকরি হবে― তা আমি নিশ্চিত।
তাই নাকি!
অবশ্যই। আজমল উদাস হযে বলল, আপনি যদি টাকা না দিয়ে থাকেন তাইলে আপনার এখন ইন্টারভিউ দেয়া-না দেয়া একই কথা।
এমন সময় তপুর ইন্টারভিউর জন্য ডাক পড়ল।
আজমল হাসি মুখে বলল, ভাই, ভাল থাকবেন। ইন্টারভিউ ঠিকমত দিয়েন।
আজমলের মনে এখন খুব ফূর্তি। যাক, শেষ পর্যন্ত এই ব্যাটার হাত থেকে বাঁচা গেল!
তপু ইন্টারভিউর রুমে ঢুকল। ও ঠিক করল এই ইন্টারভিউর বসকে কিছু একটা না করে ও এখান থেকে যাবে না। একটু আগে তপু বাসের গুন্ডাদের শাস্তি দিয়েছে। সে তুলনায় তো এটা কিছুই না।
চলবে---
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১১ দুপুর ২:১৩