somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিবিয়া যুদ্ধে আমি এবং আমাদের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স - পর্ব ৮ (শেষ)

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২২ শে অক্টোবর, শনিবার।
সকাল দশটার দিকে আমরা খামসিন থেকে বের হয়ে সিরতের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সাথে প্রচুর পরিমাণ খাবার-দাবার। যাচ্ছি একটা ট্রাকের পেছনে চড়ে। খামসিনের চেক পয়েন্ট থেকে এই বিদ্রোহীরা এই ট্রাকওয়ালাকে রিকোয়েস্ট করে আমাদেরকে উঠিয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দেখলাম যুদ্ধের গাড়ি তেমন নেই, কিন্তু সাধারণ পিকআপে আর ট্রাকে করে মানুষ দামী দামী গাড়ি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন সহ দামী দামী জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন দোকানপাট এবং বড়লোকদের বাড়ি থেকে লুটপাট করা জিনিস এগুলো।

ট্রাকওয়ালা আমাদেরকে জাফরান জাজিরার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিদ্রোহীদের কয়েকটা গাড়ি এসে আমাদের পাশে থামল, কিন্তু গাড়িতে উঠালো না। বরং বলল, আমরা কেন এসেছি? সিরত মানুষের বসবাসের যোগ্য না। সিরতে হয়তো কাউকে থাকতেই দেওয়া হবে না। হয়তো পুরো সিরতটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু একটু পরেই বিদ্রোহীদের অন্য দুইটা পিকআপ এসে আমাদেরকে তুলে নিল। পিকআপের পেছনে যেখানে আমরা উঠলাম সেখানে দেখি একটা তলোয়ার রাখা। দেখেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার! সবার হাতে হাতে রাইফেল, সেটাকে মোটেই ভয় লাগছে না, কিন্তু গাড়িতে তলোয়ার দেখেই মনে হচ্ছে এরা বুঝি তালেবানপন্থী। তবে এরাও আমাদের সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করল। আমাদের সাথেই প্রচুর খাবার-দাবার, এরা নিজেদের গাড়ি থেকে বাচ্চাদের হাতে আরো বিস্কিটের প্যাকেট, দুধের প্যাকেট ধরিয়ে দিল।

গাড়িদুটো আমাদের গলির মুখে এসে থামল, আমরা গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছি, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের পেছনে কামালের ভাই মোহাম্মদের গাড়ি এসে থামল। মোহাম্মদের পাশে মোত্তালেবও আছে। দুজেই নেমে এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম আম্মু আর তিথি কোথায়। বলল সবাই ভালো আছে, নিরাপদে আছে। গার্বিয়াতেই আছে বুড়ীদের সাথে। মনের গভীরে যে অনিশ্চয়তা আর অজানা একটা শংকা ছিল, এক মুহূর্তেই সেটা দূর হয়ে গেল। মোহাম্মদ, মোত্তালেব সহ আমরা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। এলাকার প্রতিটা ঘরের দরজা খোলা। আমাদের ঘরে ঢুকে দেখি পুরা ঘর একেবারে লন্ডভন্ড। জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড়, কাগজ-পত্র সবকিছু মাটিতে, ঘরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম চালের বস্তাগুলো জায়গা মতোই আছে। লুটপাটকারীরা তার নিচে উঁকি মারে নি, তাই নিচে লুকানো আমাদের মূল টাকাপয়সাগুলো বেঁচে গেছে। ব্যাংকের কাগজগুলোও পাওয়া গেল মাটিতে। কিন্তু জরুরী অবস্থার জন্য হাতের কাছে রাখা আব্বুর দুই হাজার দিনার (প্রায় এক লাখ টাকা), আব্বুর ওয়েল্ডিং মেশিন, দামী মোবাইল ফোনগুলো, বাংলাদেশী স্কুলের ওয়াইম্যাক্ম ডিভাইস যেটা আমার কাছে রাখা ছিল, সবই গেছে। তবে টিভি, কম্পিউটার, প্রিন্টার এসব ভারী জিনিস কিছুই নেয় নি। বেডরুমের লোহার দরজা লক করা ছিল, সেটা গুলি করে ভাঙ্গা হয়েছে। সেই গুলি আয়না ভেদ করে পেছনের দেয়ালে ঢুকে গেঁথে আছে।

প্রথমে ভেবেছিলাম আমার সাতশ দিনারও বুঝি গেছে, কিন্তু একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার রুমে একটা তাক এবং দুটো টেবিল ছাড়াও তিনটা বড় বড় বক্স ভরা বই খাতা আর কাগজ-পত্র ছিল। লুটপাটকারীরা প্রথমে বাক্সগুলো উল্টে সব খাতাপত্র মাটিতে ফেলেছে। এরপর তিন ধাপ বিশিষ্ট তাকের উপরের দুটোর সবকিছুও ফেলেছে। কিন্তু এতক্ষণে তারা কিছুই না পেয়ে ধরে নিয়েছে এর কাছে বইখাতা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তাই তারা নিচের তাকটি আর চেকই করে নি। আর তাই সেটার মধ্যে থাকা আমার সাতশ দিনার বেঁচে গেছে। লুটপাট নিশ্চয়ই মিসরাতার লোকেরাই করেছে, কিন্তু একটা জিনিস প্রমাণ হল যে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে আমাদের ঘরে ঢুকেছিল, তারা লুটপাট করেনি। কারণ তারা আমাকে এই জায়গায় কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে দেখেছিল।

কিছুটা গোছগাছ করা শুরু করতেই মোত্তালেব আর মোহাম্মদ বলল, তারা এখন গার্বিয়াতে ফিরে যাবে। আমরাও তাদের সাথে চললাম। যাওয়ার সময় দেখলাম এলাকার ভেতরে এখনও অলিতে গলিতে দলবেঁধে লুটপাটকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জায়গায় জায়গায় যারা গাদ্দাফীর পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি করেছিল, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে। অনেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত গার্বিয়াতে গিয়ে হাজির হলাম। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই বুড়ী আমাদেরকে দেখে চিত্‍কার করা শুরু করল, ওয়েন হাসিনা, তা'ল ইয়া হাসিনা, জা' তালহা, জ' তাহা! অর্থাত্‍, হাসিনা (আম্মুর নাম) কোথায়, হাসিনা এদিকে আসো, তালহা এসেছে, ত্বোহা এসেছে!

বুড়ীর চিত্‍কার শুনে আম্মু আর তিথি ছুটে এল। আম্মু আমাকে আর তালহাকে, আর তিথি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। ঘরের মধ্যে আমি মোটামুটি দয়ামায়াহীন, কঠোর, নিষ্ঠুর ধরনের মানুষ হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু সেই আমিও চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে এল, চশমা খুলে হাতে নিতে হল। দীর্ঘ ২২ দিন পর আমরা একে অন্যের দেখা পেলাম। লিবিয়ার যুদ্ধ আরও দুদিন আগে শেষ হলেও আমাদের যুদ্ধ শেষ হল আজ। অবসান ঘটল সকল রকম অনিশ্চয়তার।

পৃথিবীতে কি কাকতালীয় বলে কিছু আছে? এটা কি কাকতালীয়, নাকি আল্লাহ‌্‌র অনুগ্রহ? আমরা যদি আর দশ মিনিট পরে ঘরে পৌঁছতাম, বা মোহাম্মদ যদি আর দশ মিনিট আগে ঘরে পৌঁছত, তাহলেই আর কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের দেখা হতো না। মোহাম্মদ যখন ফিরে গিয়ে বলত, আমাদের ঘর খোলা, ঘরে লুটপাট হয়েছে, কিন্তু আমরা ঘরে নেই, তখন আম্মুর অবস্থাটা কি হতো?

আম্মুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, তারা প্রথম দিকে খাবারের বেশ কষ্ট করেছে, কিন্তু আমাদের মতো এতো জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে নি। প্রথমে দিন আ'তেফ হামজা সহ রক্বম তালাতা থেকে বের হয়ে গার্বিয়াত-এর দিকে যাত্রা শুরু করতেই তারা দেখতে পায় সেদিকের সবগুলো রাস্তা বিদ্রোহীদের দখলে। রাস্তায় বিদ্রোহীরা গাড়ি থামিয়ে প্রতিটি ব্যাগ চেক করেছে, কিন্তু কারো কিছুই নেয় নি, কাউকে কিছু বলে নি। এরপর গার্বিয়াতে এসে দেখে গার্বিয়াতও সম্পূর্ণ তাদেরই দখলে। আ'তেফ, বুড়ী, উলা এরা সিরতের শতশত মানুষের মতোই সম্পূর্ণ গাদ্দাফীর সাপোর্টের, স্বভাবতই প্রথম প্রথম বিদ্রোহীদের ভয়ে অস্থির ছিল। কিন্তু দিনে দিনে বিদ্রোহীদের আচার-ব্যবহার দেখে ধীরে ধীরে সবাই সাহস ফিরে পেয়েছে। কয়েকদিন যাওয়ার পর বিদ্রোহীরা নিজেরাই ঘরে এসে প্রচুর খাবার-দাবার দিয়ে গেছে। কয়েকটা পয়েন্টে নিয়মিতভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়, আ'তেফ এমনিতে বিদ্রোহীদেরকে দেখতে না পারলেও সময় মতো গিয়ে সেখান থেকে খাবার-দাবার নিয়ে আসে।

গার্বিয়াতে দুদিন কাটিয়ে সোমবার আমরা ঘরে ফিরে এলাম। সারাদিন গোছগাছ করে সময় কাটালাম। এলাকা এখনও ফাঁকা। দুই-একজন করে মানুষ ফিরে এসে ঘরবাড়ি দেখে আবার ফিরে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের বাসাই বসবাসের অযোগ্য। দেখা গেল সিরতের প্রতিটা বাসাতেই লুটপাট হয়েছে। একটা বাসাও বাকি রাখে নি তারা। চুরি এখনও হচ্ছে, তবে খালি বাড়িগুলোতেই। যেসব বাসায় মানুষ আছে, সেসব বাসায় কেউ ঢুকছে না। আলিম আংকেলদের সাথে দেখা হল মুক্তাদের বাসায়। জানা গেল তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গার্বিয়াতেই ছিল। এখন তারাও বাসায় ফিরে এসেছে। নবী স্যার, রমজান আংকেল আর সৌরভরাও গার্বিয়াতে তাদের সাথে একই জায়গায় গিয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে তারা ত্রিপলীতে চলে গেছে।

মঙ্গলবার সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি আর শাওন ভাইয়া গেলাম সৌরভদের বাসায়, দামী জিনিসপত্র কিছু পেলে ঘরে এনে রাখব। তা না হলে দেখা যাবে সেগুলোও চুরি হয়ে গেছে। এক সময় তো ওরা ফিরে আসবেই, তখন জিনিসগুলো কাজে লাগবে। আমরা একটা গ্যাস সিলিন্ডার, কম্পিউটার, হীটার এনে মাত্র ঘরে ঢুকেছি, এমন সময় দেখি রমজান আংকেল, নবী স্যার আর সৌরভের আব্বা কালন আংকেল এসে হাজির। কেউ আমরা কারো আত্মীয় না, তবুও সবার চোখেই পানি। জানা গেল, তারা আসলে ত্রিপলীতে যায় নি, বিদ্রোহীরা তাদেরকে মিসরাতার কাছাকাছি একটা আবাসিক এলাকায় আশ্রয় দিয়েছে। ঐ এলাকাতে বিদ্রোহীদের একটা ক্যাম্প আছে এবং সেখানকার চারতলা ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে সিরত থেকে পালিয়ে আসা আশ্রয়প্রার্থীদেরকে স্থান দেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে যাওয়ার পর থেকে গত তিন সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের খাবার-দাবার থেকে যাবতীয় ব্যবহার্য প্রতিটি জিনিস বিদ্রোহীরাই দিয়েছে। কোন কিছুর অভাব সেখানে তাদের ছিল না। তাদের কাছ থেকে আরও জানতে পারলাম বেনগাজীর বিদ্রোহীরা সরকার আংকেলদের এলাকায় ঢুকে তাদেরকে এবং আজিম আংকেলদেরকে উদ্ধার করেছে। তারা এখন বেনগাজীতেই আছে। মোটামুটি বাংলাদেশীরা সবাই নিরাপদেই আছে। সবাই-ই কম বেশি ঝুঁকির মধ্যে দিনগুলো কাটিয়েছে, কিন্তু কেউই হতাহত হয় নি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।


ডিসেম্বর ২০১১

যুদ্ধ শেষ হয়েছে দেড় মাস হল। সিরতে ফেরার পর প্রথমে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি সহ পুরো শহরের যে অবস্থা ছিল, যেভাবে প্রতিটা কারেন্টের পিলার ভেঙ্গে পড়েছে, যেভাবে রাস্তাঘাট ভেঙ্গেচুরে ছিল, ভেবেছিলাম তাতে কারেন্ট আর নেটওয়ার্ক আসতে বছর খানেক সময় লেগে যাবে। আর পুরো শহরকে পূর্বের অবস্থায় তুলতে সময় লাগবে দশ বছর। কিন্তু দেখা গেল বাস্তবে সেরকম হয়নি। কুরবানীর ঈদের আগেই রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছিল, ঈদের পরপরই কারেন্ট এবং নেটওয়ার্কের কাজও শুরু হয়ে গেল। নভেম্বরের মাঝামাঝিতেই পুরো শহরে কারেন্ট এবং নেটওয়ার্ক চলে এল। শহরে লোকজনও ফিরতে শুরু করল। দোকান পাটও মোটামুটি চালু হওয়া শুরু করল, জিনিস পত্রের দামও সহনীয় পর্যায়ের। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ের অর্থাত্‍ মে-জুন মাসের মতো। এছাড়া ত্রাণ তো আছেই। যাদের একটু সময়, ধৈর্য্য এবং গাড়ি আছে, তারা শুধুমাত্র ত্রাণের খাবার দিয়েই রাজার হালে দিন কাটিয়ে দিতে পারে।

ঈদের পরপরই আমি মিসরাতা হয়ে ত্রিপলীতে এলাম। মিসরাতা এবং ত্রিপলীর অবস্থা পুরাই স্বাভাবিক। ত্রিপলীর অধিকাংশ এলাকাতে কোন যুদ্ধই হয় নি। বিদ্রোহীদের ঢুকতে যতটুকু দেরি হয়েছিল, মানুষের পতাকা পাল্টাতে দেরি হয় নি। প্রতিটা অলিতে-গলিতে নতুন পতাকা, পতাকার রং-এর ডিজাইন, দেয়ালচিত্র। ত্রিপলীর বাংলাদেশীরাও সবাই নিরাপদেই আছে। শুধু একজন মাত্র ব্যক্তি, যিনি দীর্ঘ দিন যাবত বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ, যিনি স্কুলটির জন্য এক অপরিহার্য ব্যাক্তিত্ব, সেই মজিদ স্যার, ডাঃ আব্দুল মজিদ নিখোঁজ। তিনি মিলিটারি হসপিটালের ডাক্তার ছিলেন। ত্রিপলী দখলের আগের দিনও তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। সেদিন তার চেম্বারের পাশের বিল্ডিং-এ ন্যাটো বোমা ফেলেছিল। তার রুমের দরজা ছিটকে এসে ভেতরে পড়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার কিছু হয়নি। কিন্তু ত্রিপলী দখলের বেশ কিছুদিন পরই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাকে তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসও বলছে তারা যথাসাধ্য যোগাযোগের চেষ্টা করছে। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও কেউ তার সাথে দেখা করতে পারে নি, ফোনেও কথা বলতে পারে নি। দূতাবাস সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা মানুষের কখনোই ছিল না। তারা যতই দাবি করুক তিনি ভালো আছেন, অন্তত ফোনে একবার তার কন্ঠস্বর শোনার আগ পর্যন্ত তিনি বেঁচে আছেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সহজ নয়।

প্রতিটা বিপ্লবের কিছু ঋণাত্মক দিকও আছে। সে দিক গুলোই যেন এখন এক এক করে ফুটে উঠছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ হয় একজন নেতাকে সামনে রেখে, যেই নেতার নির্দেশ সবাই মেনে চলে। কিন্তু লিবিয়ার যুদ্ধে কোন নেতা ছিল না। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর একটা কমিটি গঠন করে গাদ্দাফীর সরকার থেকে পদত্যাগ করা বিচারমন্ত্রী মোস্তফা আব্দুল জলিলকে প্রধান ঘোষণা করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যোদ্ধাদের উপর তার প্রভাব ছিল খুবই সামান্য। যোদ্ধারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট গ্রুপের নেতৃত্বে। আর তাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে সব যোদ্ধাকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আসলে কেউ নেই। সবাই-ই একেকজন নেতা। প্রতি রাতেই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সংবাদ পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের উপর যদিও খুব একটা প্রভাব পড়ে না, কিন্তু রাতে কেউই প্রয়োজন না থাকলে নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে চায় না।

সবচেয়ে
বড় সমস্যা অস্ত্র। বিদেশী শক্তি যেন লিবিয়ার মাটিতে ঢুকার সাহস না পায়, সেজন্য গাদ্দাফী অস্ত্রভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন। তার পক্ষের মানুষেরা দুই হাতে অস্ত্র নিয়েছে। তার আশা ছিল তার পক্ষের প্রতিটা লোক তাকে বাঁচানোর জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেটা হয় নি, কিন্তু অস্ত্রগুলো হাতে হাতে রয়ে গেছে। এই অস্ত্র উদ্ধার করা এখন অসম্ভব ব্যাপার। গাদ্দাফীর পক্ষের লোকেরা সুযোগ পেলেই এইসব অস্ত্র ব্যবহার করে গোলমাল সৃষ্টি করবে, এই অজুহাত দেখিয়ে যোদ্ধারাও অস্ত্র জমা দিচ্ছে না। অজুহাতটা অবশ্য সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কারণ সিরতের বেশিরভাগ মানুষ এখন পর্যন্ত এই বিপ্লবকে মেনে নেয় নি। এই মুহূর্তে তারা অবশ্য অস্বাভাবিক রকম নিশ্চুপ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা অপেক্ষা করছে নতুন একটা পাল্টা বিপ্লবের, যেটা ঘটতে হয়তো খুব বেশি দেরি হবে না।

এমনিতে দেশটা কিছুটা গণতান্ত্রিক পথের দিকে এগুচ্ছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে ত্রিপলী ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা যারা গত সেমিস্টার পড়তে পারেনি, তাদেরকে সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে, ডীনের অফিস ঘেরাও করেছে, ডীনের পদত্যাগ দাবি করেছে, যেটা গাদ্দাফীর আমলে অকল্পনীয় একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাপারে আন্দোলন হচ্ছে, মিছিল বের হচ্ছে। উপজাতীয় আমাজিগরা আন্দোলন করছে মন্ত্রীসভায় তাদের থেকে একজন প্রতিনিধি না নেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে। সিরতবাসী মিছিল করছে বেনগাজী রেডিওতে সিরতের জনগণের আদি নিবাস সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করার প্রতিবাদ হিসেবে। ত্রিপলীবাসী আন্দোলন করছে মিসরাতা এবং জিনতানের যোদ্ধাদের ত্রিপলী ছাড়তে বাধ্য করার জন্য। কিন্তু কথা হচ্ছে আন্দোলন গুলো কতদিন শান্তিপূর্ণ থাকবে! অস্ত্র যেহেতু আছে, সেগুলোর ব্যবহার হবেই। আজ, নয়তো কাল। বড়জোর নির্বাচন পর্যন্ত হয়তো শান্তিপূর্ণভাবে কাটবে। নির্বাচনে যে দল হেরে যাবে, সে কি তার সশস্ত্র জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাটা দখল করতে চাইবে না? প্রতিশোধ নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকা গাদ্দাফীর ভক্তরা কি সেই সুযোগটা ছেড়ে দিবে? হেরে যাওয়া দলটি কি তখন তাদেরকে সাথে নিয়ে দল ভারী করার সুযোগটা হাতছাড়া করবে?

অস্ত্র বড়ই ধ্বংসাত্মক জিনিস। নিরীহ মানুষের উপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করার পরিণতিতে গাদ্দাফী নিজে ধ্বংস হয়েছে, আর সেই অস্ত্র পুরো দেশে বিলিয়ে দিয়ে দেশটাকেও ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
১৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×