পূর্ব কথা: খুব সকালেই রাতুল আর আরিফ এক বাল্য বন্ধুর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। দ্রুত সেখানে পৌঁছুতে এক বড় গোরস্থানের শর্টকাট পথই বেছে নিল। তাতেই হল বিপত্তি। সকালের কুয়াশায় অপ্রত্যাশিতভাবে তারা পথ হাড়াল। ফিরবার পথও হাড়িয়ে ফেলল। শুনতে পেল কারো কান্না র আওয়াজ। তারপর ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। নাটকীয়ভাবে বন্ধু শহীদ গন্ধ পেল দুই চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতার। কী হবে তারপর.......
পাঁচ
পাশের ঘর থেকে শহীদের হা-পিত্যেস শোনা যাচ্ছিল। কারণ খালাম্মা দের ঘণ্টা ধরে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছেন। শহীদ মাত্র সেদিন একশ টাকা রি-চার্জ করেছে যার পুরোটাই আজ শেষ।
দীর্ঘ ইনিংস শেষ করে খালাম্মা আমাকে এসে বললেন যে, আমার মা নাকি আগামী দুই দিনের মধ্যে তাঁদের বাড়ি ছেড়ে যেতে মানা করেছেন। এর মানে বোঝা যাচ্ছে আব্বা আমাকে নিয়ে কোন রিক্স নিতে চাচ্ছেন না। আমার মা-বাবার এরকম সিদ্ধান্তে শহীদকে একটু খুশি খুশি মনে হল। আমার এই অবস্থার জন্য ও বারবার রাতুলকেই দোষারোপ করছিলো। কিন্তু আমিতো না দেখে, না যেনে মন্তব্য করতে পারিনা। কেননা রাতুল আমার সাথে যতক্ষণ ছিল সেটা আমার সন্দেহের ঊর্ধ্বে। রাতুল কে যতক্ষণ না পাওয়া যাবে ততক্ষণ এ নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। আমার এইরকম মনোভাব হওয়ার পরেও শহীদ নাছোড়বান্দা, ওর একই কথা আমি নাকি ভিলেজ পলিটিক্স বুঝিনা।
আমরা দুইজনে নানা তর্ক করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল তা বুঝতে পারিনি। ওদের বাড়ির বাইরে মাঠটিতে বসে গল্প করতে বেশ ভাল লাগছিল। আমাদের সাথে শহীদের বেশ কয়েকজন বন্ধুও ছিল। ওরা কি একটা বাংলা সিনেমা নিয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ করেই ট্রেনের হর্নের আওয়াজে সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। শহীদের বাড়ির খুব কাছাকাছি জায়গা দিয়ে ট্রেন লাইন গেছে।
রাত নয়টার দিকে বেশ কয়েকজন লোক আমাদের পাশ কাটিয়ে সোজা গোরস্থানের দিকে চলল। গ্রামে সাধারণত এত রাতে বাড়ির বাইরে কেউ যায়না। তাই আমি একটু আশ্চর্য হলেও কিছু মনে করলামনা। কিন্তু হঠাৎ করেই শহীদ একটু চঞ্চল হইয়ে উঠল। সাথের ছেলে গুলোকে গালাগালি করতে লাগল। ওরা প্রথমে ‘থ’। পরে বুঝতে পারল শহীদের পাগলামো শুরু হয়েছে। এই ছেলেটা ছোট থেকেই এই রকম। এই ভাল‘ত এই খারাপ। ওরা একজন একজন করে উঠে চলে গেল। শহীদ আমাকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। কিছুক্ষণ পরেই শহীদ ওর মায়ের সাথে বাকবিতণ্ডায় জরিয়ে পরল। আমি একবার ভাবলাম ওর পাগলামো থামাতে যাব নাকি। আবার সাহস হলনা। ও বারবার শুধু বলছিল, ‘আমি বাবারে এই কাজে যাইতে মানা করছিলাম না! তাও বারবার তাগো লগে যাওয়ার কি দরকার’। ওর মা ওকে শুধু বোঝাচ্ছিল এই কাজ করেই ওদের সংসার চলে।
আমি কখনোই যানতাম না শহীদের বাবা কি কাজ করে। আজও বুঝতে পারলামনা। তবে ওর বাবার কাজে যে ওর আস্থা নেই তা খুব ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো।
হঠাৎ করেই শহীদ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পেছন থেকে খালাম্মা ওর বাবার কাজে বাধা দিতে নিষেধ করল। তারপর আমার কাছে দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবা ওরে ঠেকাও, নাইলে বিপদ হইয়া যাইব’। আমি আর কিছু না জিজ্ঞেস করেই ওর পিছু ছুটলাম। একটু পরে ওকে পেয়ে গেলাম, একটা গাছের নিচে চুপ করে বসে আছে। আমি ওর পাশে বসে আস্তে করে বললাম, ‘কি পাগলামো শুরু করেছিস’। উত্তরে শুধু বলল, ‘তুই বুঝবিনা’। আমি আর বোঝার চেষ্টা করলামনা, চুপ করে পাশে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে শহীদের মা আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন।
ছয়
ঔষধের প্রভাবে প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। কেন যেন নানা কথা বলে শহীদ আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে খালাম্মা বকাবকি করাতে ও চুপ হল। কিন্তু মাঝরাতে আবার আমাকে ডেকে তুলল। তারপর আমার কানের পাশে এসে ফিস ফিস করে বলল, ‘একটা জিনিস দেখবি ‘ত’ চল’। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ওর ব্যপার স্যপার এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। অনেক দিন পরে ওর সাথে দেখা। তাই ওর বাবা বা ও নিজে কি করে তার কিছুই আমি জানিনা। তাই আমি যাব কি যাবনা তা নিয়ে দোটানায় ছিলাম।
শহীদের টানা হ্যাচড়ায় এক সময় যেতে রাজি হলাম। দুজনে খুব আস্তে আস্তে বাইরে বেড়িয়ে এলাম যাতে খালাম্মা টের না পায়। বাইরে এসেই শহীদ আমাকে কথা বলতে নিষেধ করে দিল, শুধু ওকে অনুসরণ করতে বলল। আমি ওর কথা মত যেতে লাগলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পর বুঝতে পারলাম আমরা গোরস্থানের দিকে যাচ্ছি। ওর হাতে ছোট্ট একটা টর্চ ছিল, তাই ঝোপঝাপরার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল না। ভেতরের রাস্তাগুলো শহীদের কাছে অনেক পরিচিত মনে হচ্ছিলো। তাই আমরা বেশ দ্রুত এগোচ্ছিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল কখন কোন গর্তে পরে যাই। একটা সময় আমি কিছু লোকের কথা বার্তার আওয়াজ পেলাম। শহীদ ব্যপারটা বুঝতে পেরে আমাকে নিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পরল। আওয়াজ যেই দিক থেকে আসছিল আমরা দুইজনে সেই দিকে চেয়ে ছিলাম। ঘন কুয়াশার কারণে আমদের এইখান থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট দুরের লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলোনা।
ঘড়িতে তখন রাত বারোটা। উত্তেজনায় আর ভয়ে এই শীতের মধ্যেও আমার শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল। প্রকট একটা পঁচা গন্ধ নাকে আসছিল। হঠাৎ করেই আমাদের পেছন থেকে কেউ সামনের দিকে আসতে লাগল। আমি শহীদের হাত চেপে ধরলাম এই ভয়ে, না জানি কি হয়। শুকনো পাতার উপর পায়ের আওয়াজটা আরও গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করে আওয়াজটা থেমে গেল। আমি প্রথমে ভাবলাম, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু পর মূহুর্তে টের পেলাম কেউ একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে দম বন্ধ করে বসে থাকলাম। আমি মাথাটা কাত করে লোকটার দিকে তাকালাম। আবছা আলোয় যতটুকু দেখলাম তাতে তাকে দৈত্যাকায় মনে হল। পড়নের লুঙ্গিটা ভালো করে গোটানো আর হাতে বেশ বড়সড় একটা রামদা। আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি রামদাটা আমার ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। কিন্তু সে কিছুই করলনা। হন হন করে সামনের লোকগুলোর দিকে চলে গেল। আসলে আমরা এখানে আছি তা লোকটা বুঝতেই পারেনি।
আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছিলোনা আবার চলে যেতেও ভয় করছিল, যদি টের পেয়ে যায়। শহীদের সাথে কথা বলার সুযোগ ছিলনা। সামনের লোকগুলো কি করছিলো তা বুঝবার উপায় ছিলনা। তবে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম।
লোকগুলোর মধ্যে থেকে একজন একটা মশাল ধরাল। অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম সেই দৈত্যাকায় লোকটি একেবারে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থেকে একজন লোক বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছিল। লোকটার পড়া শেষ হলে পেছন থেকে অন্য একজন একটা কলস উলঙ্গ লোকটার মাথার উপরে উপুড় করে ধরল। কাঁচা দুধের গন্ধ আমার নাকে আসল। বুঝলাম দুধ দিয়ে লোকটাকে গোসল করানো হচ্ছে। তারপরে তার হাতে সেই রামদাটা দেওয়া হল। লোকটা সামনে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। বাকিরা পেছনেই থেকে গেল। সে যেখানে থামল সেখানে তার বরাবর কিছু একটা বেধে রাখা হয়েছিল। আবছা আলোয় ঠিক বোঝা যাচ্ছিলোনা। লোকটা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর রামদাটা উঁচিয়ে ধরল। নিচের জিনিসটির উপর কোপ মারতে যাবে, ঠিক তখনি মশালটা নিভিয়ে দেওয়া হল আর সাথে-সাথে ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল।আমার মনে হল রামদার আঘাতটা আমার বুকের উপরে করা হয়েছে।
একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক। কারো কোন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি শহীদের কানে কানে কিছু বলতে যাব। ঠিক তখনি পাশের গাছ থেকে কিছু উড়ে যাবার শব্দ হল। তারপর হু হু করে বাতাস বইতে লাগল। গাছটা অসম্ভব রকম ভাবে নড়াচড়া করতে লাগল। আমার মনে হল লোকগুলো আমার নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে গেছে। আমি ভয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। খেয়াল করলাম শুধু আমাদের আশেপাশের গাছ গুলোতেই প্রচণ্ড বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে কোন অশুভ শক্তি আমাদের চারপাশটা ঘিরে রেখেছে। আমি হামাগুড়ি দিয়ে শহীদের আরও কাছে আসতে গিয়ে হাতের ব্যালেন্স হাড়িয়ে ফেললাম। আমার হাতটা একটা গর্তে ঢুকে গেল। নরম কিছু একটার সাথে গিয়ে লাগল। আমার সারা শরীর ঘিনঘিনিয়ে উঠল। সাথে সাথেই হাত উঠিয়ে দেখলাম আমার অনামিকার বড় নখটার সাথে ছোট্ট গোলাকার কিছু একটা উঠে এসেছে। শহীদকে ধাক্কা দিতেই ও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে টর্চ লাইট অন করল। তাতে দেখলাম আমার নখের সাথে ওটা একটা চোখ। আর আমরা যে জায়গায় বসেছিলাম সেটা একটা নতুন কবর। শেয়ালে লাশটাকে উপরে উঠিয়ে এনেছে। আমি এমন বীভৎস লাশ এত কাছ থেকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সাথে সাথেই শহীদের শক্ত হাত আমার মুখটাকে চেপে ধরল। আমি ক্লান্তি আর ভয়ে মূর্ছা গেলাম।
এরপর কী হবে, বেচে ফিরবে তো ওরা দুজন? কারা সেই লোকগুলো? কেনই বা তারা এত ভয়ংকর কাজে মেতে উঠেছিল? শহীদ কি সেগুলো জানে???
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৩৬