খুব সকালে রাতুলের ডাকে সাড়া দিয়ে পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল ওরা। শর্টকাট রাস্তা দিয়ে সেখানে যেতে গিয়েই হল বিপত্তি। মস্ত বড় সেই গোরস্থানের মধ্যে হাড়িয়ে গেল দুই জনেই। প্রচন্ড কুয়াশার কারনে কিছুই বুঝে উঠতে পাড়লনা। শুনতে পেল কারো করুন কান্নার আওয়াজ। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়ে অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা হল দুজনের। পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে রাতুল হাড়িয়ে গেল......তারপর.....
দুই
এই ভোর সকালে গ্রামের পিচ্চি ছেলেমেয়েগুলো হৈ-হুরুল্লা করে কোথায় যেন ছুটছিল। আমি সাধুর দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমি ভ্যাঁদাকে ডাকলাম। ও এই গ্রামের প্রায় সব খোঁজখবর রাখে। ওকে জিজ্ঞাসা করায় ও বলল, কে যেন গোরস্থানের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। আমার তেমন কোন কাজ ছিলনা, তার উপর একটু ঊৎসাহ লাগল সেখানে যাবার।
গোরস্থানে এসে দেখলাম বেশ বড়সড় জটলা পেকেছে যার অধিকাংশই অতি উৎসাহী পিচ্চি ছেলেমেয়ে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখলাম, প্রায় আমার বয়সী একটা ছেলে উপুড় হয়ে পরে আছে। লোকজন নানা ভাবে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করছিল। আমি ছেলেটার আর একটু কাছে গিয়ে বসলাম। কেন যেন ছেলেটাকে অনেক চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু আমাদের গ্রামে আসতে পারে এমন পরিচিত কাউর কথা মনে আসছিলনা।
আমি এখানে আসার দশ মিনিটের মধ্যে ছেলেটার জ্ঞান ফিরল। তারপর লোকজন নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকল। এক সময় এই গ্রামে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমি ও অন্য কয়েকজন ছেলের বাড়িতে আসার কথা বলল। আমার নাম আসতেই ওর প্রতি আমার মনোযোগ বেরে গেলে। ওর নামটা জানার পর চিনতে পারলাম, ও আমার বাল্য বন্ধু আরিফ। আমি আবেগ সামলাতে না পেরে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল।এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কতক্ষণ ধরে যে মাটির উপর এভাবে পরে ছিল তা হয়তবা ও নিজেও তা বলতে পারবেনা।
অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমার চাদরটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। তারপর নানা কথা জিজ্ঞেস করতে করতে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলাম। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, আরিফ গোরস্থানে অজ্ঞান হবার আগে কি ঘটেছিল তা নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাচ্ছিল-না, অথচ আমি এবং অন্য সবাই এটা জানতেই উৎসুক ছিলাম। শুধু জানতে পারলাম, রাতুল নামের ছেলেটির সংগে খুব ভোরে ঘর থেকে বের হয়েছিল। রাতুল কোথায় সে ব্যপারে আরিফ একেবারেই মুখ খুল ছিলনা।
তিন
যখন আমার ঘুম ভাঙল, তখন দুপুর দুইটা বাজে। মনে ছিলনা আমাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। উঠে বসতে গিয়ে টের পেলাম। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। আমি শহীদকে ডাকলাম। ওর কোন উত্তর পেলামনা। কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলা ঘরে ঢুকল। একটু দেরিতে হলেও বুঝতে পারলাম এটা শহীদের মা। উনার সাথে আমার মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলা থেকে খালাম্মা বলে ডাকতাম। উনি আমাকে জাগ্রত দেখে আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। আমি অল্প কথায় উত্তর দিলাম।
রাতুলকে এখনো পাওয়া যায়নি। শহীদ কোথায় তা জানতে চাইলাম। খালাম্মা বললেন, ও নাকি আমার বাসায় ফোন দিতে গিয়েছে। শহীদদের এই গ্রামটায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ফোন করতে হলে বাজারে যেতে হয়। ও আমার মোবাইল থেকে নম্বর সংগ্রহ করে আমার বাসায় ও গ্রামের চাচার বাসায় খবর জানিয়েছে। মনে মনে হাসলাম, সেই গাধাটা এখন অনেক চালাক হয়েছে।
একটা ব্যপার যখন জানলাম তখন একটু অবাক হলাম, শহীদ ঘণ্টা তিনেক আগে আমার চাচার বাসায় খবর দিলেও এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে নিতে আসলনা। ভাবলাম ওরা হয়তবা রাতুল কে নিয়েই বেশী ব্যস্ত। তবে আরেকটা ব্যাপার বেশ কয়েকদিন ধরেই আন্দাজ করছিলাম আমি। ওরা গত দুইদিন ধরে আমকে বেশ অবজ্ঞা করছিল। কারণ একটাই হতে পারে, আমার বাবা রিটায়ার্ড করার পর গ্রামে এসে জায়গাজমি বুঝে নিতে চাচ্ছিল। ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারছিলনা।
এখানে একটা কথা বলা দরকার, আমার দাদা দুই বিয়ে করেছিলেন। আমার বাবা শেষের পক্ষের একমাত্র সন্তান। উনি বড় হয়েছিলেন উনার নানা বাড়িতে। দাদা আমার বাবাকে অল্প বয়সে রেখেই মারা যান। আমার জম্মের পর বছর পাঁচেক আমরা গ্রামে ছিলাম। এর মধ্যেই চাচাদের সাথে আমাদের বিরোধটা খুব খারাপ অবস্থায় পৌছায়। বাবা চাকরীর কারণে দেশে আসতে পারতেননা। তাই আমার লেখাপড়া ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মা ও আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে আমারা ঢাকায় আছি। কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের পাওনা বুঝে নেবার। আর তাতেই আমার চাচারা ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। আমার খোজ খবর না নেওয়াটা তারই বহিঃপ্রকাশ।
চার
আরিফকে গোরস্থানে পাওয়ার পর থেকেই আমি রাতুলের খোজ করছিলাম। আমি জন দশেক বন্ধু বান্ধব নিয়ে গোরস্থানে গিয়েছিলাম। ওকে কোথাও পেলামনা। আরিফকে পেছন থেকে মারার সময় আমার আবেদ চাচা ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। কিন্তু কে এ কাজটি করছিল তা কুয়াশার কারণে দেখা যায়নি। তবে আমার চাচার কারণে আরিফ অনেক বড় বিপদ থেকে বেচে গেছে তা নিশ্চিত। কিন্তু কে আরিফকে এত সকালে মারার জন্য এমন নির্জন এলাকায় ওত পেতে ছিল সেটা একটা চিন্তার বিষয়। ওর চাচাদের সাথে জমি-জমা নিয়ে গণ্ডগোলের কারণে চাচাতো ভাই রাতুলের সাজানো নাটক নয়তো আবার!
চলবে.......
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৫৯