এক
সেদিন সকাল বেলায় রাতুল আমার বাড়িতে হাজির। আমি ভাবলাম, এত সকালে এই ছেলের ঘুম থেকেই উঠবার কথানা, সে কিনা আমার বাড়িতে! নিশ্চয় কোন বিশেষ কারণ আছে। আমি এই বিশেষ আর ব্যতিক্র্ম কিছুরই খোজ করছিলাম।
প্রায় পাঁচ বছর পর ঢাকা থেকে গ্রামে আসার পর গ্রামের লোকজনের একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। সবাই জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোন ক্লাসে পড়, তোমার বাবা-মা কেমন আছে, অনেক বড় হয়ে গেছ ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই গত পাঁচ দিনের মধ্যেই গ্রামে ঘুর ঘুর করাটা রীতিমত বিরক্তিকর হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল গ্রামের বাইরে দূরে কোথাও ঘুরতে যাই। রাতুলের কাছ থেকে পজিটিভ কিছু আশা করছিলাম আমি। তাই এত আরামের ঘুম হারাম করে, কোন কারণ জিজ্ঞাসা না করেই ওর সাথে বাইরে বের হলাম।
রাতুল আমাকে হতাশ করেনি। বরং আমার উৎসাহ দিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।কারণ সে গোরস্থান বাড়ি যেতে চাচ্ছিল, যেখানে আমাদের বেশ কয়েকটি বন্ধু থাকতো। ছোটবেলায় ঐ গ্রামটাতে অনেক যেতাম। আমাদের এইখান থেকে সেই গ্রাম বেশ দুর। রাতুল বলল এই শীতের সকালে রিক্সা, ভ্যান কোনটাই পাওয়া যাবেনা। সুতরাং পা-ই একমাত্র ভরসা।
গোরস্থান বাড়ি যাবার পথে ঠিক তাই হল যেমনটা রাতুল বলেছিল।রাস্তার আশেপাশে কোন রিক্সা বা ভ্যান নেই।দশ বছর আগে তিন গ্রামের মানুষের করা সেই মাটির রাস্তা এখনো পাকা হয়নি। আঁকা বাঁকা হয়ে দূরে মিশে গেছে। শুধু পরি্বর্তন একটাই,দুই পাশের ছোট ছোট গাছগুলো এখন বড় হয়েছে। এই সকাল বেলায় গাছের ছায়া গুলো পথটাকে প্রায় অন্ধকার বানিয়ে রেখেছে। আজকে কুয়াশা খুব বেশী বলে মনে হচ্ছে।
প্রায় দুই-কিলো পথ হেঁটে গোরস্থান বাড়ি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। তখনো কুয়াশাচ্ছন্ন চারদিক।তবে গ্রামের মানুষেরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তাই রাস্তায় কিছু মানুষ পাওয়া যাচ্ছিল। গ্রামে ঢোকার দুইটা রাস্তা আছে, একটা গ্রামের সামনে যে গোরস্থান আছে তার মাঝ দিয়ে, অপরটা একটু দূর দিয়ে। রাতুল বলল আমার বন্ধুদের বাড়ি যেতে গোরস্থানের মধ্যদিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। তাই ওর কথা মত আমরা গোরস্থানের মধ্যদিয়ে যাওয়া শুরু করলাম।
গোরস্থানটার চারপাশে গাছ লাগানো ছিল।কিন্তু ভেতরটায় ছোট ছোট ঝোপঝাপরা ছাড়া বড় গাছপালা খুব একটা চোখে পরছিলনা। ফাঁকা জায়গায় কুয়াশাটা আরও বেশী ঘন দেখাচ্ছিল। খুব কাছের জিনিস ছাড়া কোন কিছুই স্পষ্ট দেখাযাচ্ছিলনা।গোরস্থানের ভিতর দিয়ে অনেক আগের চেনা পথে আ্মরা হাঁটছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেয়ে আমাদের মনে হল আমরা ঠিক পথে নেই, অন্য কোন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তাই দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, গোরস্থানের বাইরে বের হয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে গ্রামে যাব।প্রায় মিনিট দশেক হাটার পর আমরা আবার আবিষ্কার করলাম, ফিরতি পথেও আমরা ভুল রাস্তায় হাঁটছি।
তখনো সূর্যের আলো ঘন কুয়াশা ভেখ করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। আমরাও দিক হারিয়ে বসেছি। কোন দিকে গ্রাম আর কোন দিকে যাব সেটা বুঝতে পারছিলামনা। চারদিক থেকেও কোন জনমানুষের আওয়াজ পাচ্ছিলাম-না। আমরা হাটতে হাঁটতে কোথায় এসে পৌঁছেছিলাম তাও জানতাম-না। তাই আমার একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করেছিল। রাতুল বেশ কয়েকবার বন্ধুদের নাম ধরে ডাকল যাতে ওরা আশেপাশে না থাকলেও অন্য কেউ ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পড়েও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। অগত্যা আর অন্য কোথাও না যেয়ে, সূর্য উঠার অপেক্ষায় সেই জায়গাতেই ঠায় দাড়িয়ে রইলাম।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে করুণ সুরে কান্নার আওয়াজ পেলাম। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে রাতুল আমার মুখের দিকে চাইল।আমি ওকে কিছু বললাম-না। তবে এটা বুঝতে পারলাম আমার পাশাপাশি রাতুলও রীতিমত ভূতের ভয় পেয়েছে। ছোটবেলায় এই রকম কান্নার গল্প অনেক শুনেছি। আজ তা বাস্তবে শুনলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আমাদের মনে হল, কোন মেয়ে মানুষ আমাদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে সাহায্য চাইছে। মেয়েটি কাঁদছিল আর বলছিল, ‘ও বাবারা, কে আছেন? আমার ছেলেরে বাঁচান’।
মেয়েটির করুণ কান্নায় আমার খুব মায়া হল কিন্তু কাছে যাবার সাহস হলনা। রাতুল আগ বাড়িয়ে বলল, “চল্ মেয়েটার কাছে যাই”। ওর কথায় আমি সাহস পেয়ে মেয়েটির দিকে যেতে লাগলাম, রাতুলও আমার পিছু পিছু আসল। কিছুদূর যাবার পরেই আমরা তাকে পেলাম। একটা ঝোপের আড়ালে মেয়েটির শুধু পিঠের অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল। তার গায়ে অনেকটা ধূসর রংয়ের চাদর ছিল।আমি আরেকটু এগিয়ে মেয়েটিকে ডাকলাম, মেয়েটি কান্না থামালেও কোন টু শব্দ করলনা, পেছনেও ফিরে তাকাল-না। মেয়েটি নিশ্চুপ থাকাতে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। মরা লাশের সাথে যে আগরবাতি ও আতর দেওয়া হয় তার গন্ধ আসছিল, সাথে লাশের পঁচা গন্ধও অল্প অল্প পাওয়া যাচ্ছিল। এ ধরনের গন্ধে আমি অভ্যস্ত নই। পঁচা গন্ধ অসহ্য ঠেকছিল। দ্রুত ব্যপারটা বুঝতে আমরা মেয়েটির খুব কাছাকাছি আসলাম। তারপর যা দেখলাম তা তখন পর্যন্ত দেখা আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ঝোপের তলায় একটা লাশ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরে আছে। আর এতক্ষণ যাকে মেয়ে ভাবছিলাম, সে ষাটোর্ধ বুড়ি। তাকে দেখে এমন মনে হচ্ছিল যেন সে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের দিকে চেয়েছিল। বুড়িটা কি যেন একটা জিনিস নিয়ে নারাচরা করছিল। আমার মনে হল ওটা লাশটার মাথা। আমি হতবিহব্বল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পেছন থেকে রাতুল আমাকে আলতো টোকা দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চল্ এইখান থেকে পালাই’।ও শুধু এইটুকু বলে লাশটার ঠিক বিপরীত দিকে ভোঁ দৌড় দিল। আমিও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ওর পিছুপিছু ছুটলাম। আচমকা রাতুল একটা খাদে পরে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম শেয়ালের গর্ত হবে। পরে একটা মাথার খুলি আর কিছু হাড় গোড় দেখে বুঝতে পাড়লাম এটা একটা পুরনো কবর। রাতুল সেটা বুঝতে পেরে আতঙ্কে প্রচণ্ড জোড়ে চিৎকার করতে লাগল যেন কেউ ওকে নিচ থেকে টেনে ধরেছে। ওর শরীরটা বেশ মোটাসোটা হওয়াতে, ওকে গর্ত থেকে টেনে বের করতে আমার বেশ বেগ পেতে হল। ওকে উঠিয়ে দেখলাম পায়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে ঐ অবস্থা নিয়েই দৌড়াতে লাগলাম। আমি কখনো আস্তে কখনো জোরে দৌড়চ্ছিলাম যাতে রাতুল আমার পিছুপিছু আসতে পারে। লক্ষ-হীন ভাবে বেশ কিছুদূর যাবার পর রাতুলের পায়ের আওয়াজ আর পাচ্ছিলাম না। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, তারপর ওর নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না।
তখনো সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছিলোনা। আমি একের পর এক চিৎকার করে গেলাম। রাতুলের কোন সাড়াশব্দ পেলামনা। কিন্তু তখনো বুড়িটার সেই কান্নার আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিতে লাগল। নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছিল। মনে হল কেউ যেন আমার মাথার উপড়ে আঘাত করল। তারপর পা পিছলে একটা কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম। এরপর যে কি হয়েছিল তা আর বলতে পারবনা। এত-বড় এই গোরস্থানের কোন জায়গায় আমি ছিলাম তা নিজেও জানতাম না।
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৭