ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক Evelyn Beatrice Hall-এর সেই অমৃতবাণীর কথা মনে আছে তো? "I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it." আজকে যদি ভলতেয়ার বেঁচে থাকতেন, তো আমার বিশ্বাস তাঁর বাণীতে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আনতেন, ‘এক্সসেপ্ট মুহাম্মদীয়া’ শব্দদ্বয় জোড়া লাগাতেন!
বছর দুয়েক আগে 'Family Guy'-এ দেখেছিলাম যীশু পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে ঘরে বসে বসে 'Playboy' পড়ছে [ যৌনতার স্বাদ না পাওয়া যীশুর Playboy পড়া ছাড়া আর গতি কি? ]। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিক্ষুব্ধ ঘটনা ঘটেছে বলে শুনিনি। কিন্তু কল্পনা করুন যীশুর জায়গায় মুহম্মদ থাকলে কি হতো? মুসলমানরা কি এমনিতেই ছেড়ে দিতো 'Family Guy' নির্মাণে জড়িতদের?
এইতো এ মাসের শুরুতে ফ্রান্সের শার্লি হেব্দো নামের একটি রম্য পত্রিকা কার্যালয়ে পেট্রোল বোমা হামলা হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ হচ্ছে, ঐ পত্রিকাটি তিউনিসিয়ায় সাম্প্রতিক ইলেকশনে ইসলামি পার্টির বিজয়ের পর ‘আরব বসন্ত’ নিয়ে একটি বিশেষ সংস্করণ ছেপেছে। সে সংস্করণে হজরত মুহাম্মদকে ‘অতিথি সম্পাদক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মুহাম্মদের একাধিক ব্যঙ্গচিত্র ছাপানোও হয়েছে। যেমন প্রচ্ছদ চিত্রে দেখানো হয়েছে মুহাম্মদ বলছেন, “না হাসলে ১০০ চাবুক মারা হবে।”
ভিতরে আরেকটা কার্টুনে রয়েছে মুহাম্মদের নাকে কাউনের লাল রঙের আলগা নাক লাগানো। এ ধরনের ব্যঙ্গচিত্র দেখে খেঁপে গেছে তৌহিদী জনতা। হামলে পড়েছে তাই! হায় রে কমজোর ঈমান! কাঠপেন্সিলের এক ঘষায় ধ্বসে যায় তোর ধর্মবর্ম!
হামলার পর শার্লি হেব্দো পত্রিকার কার্যালয়। পত্রিকাটির ওয়েবসাইটটিও হ্যাক করা হয়েছিল।
কার্টুন একটি জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। কার্টুন পছন্দ করে না এমন ব্যক্তি বোধহয় কমই আছে আপনার আমার চারপাশে। অনেক দশক ধরেই বিশ্বজুড়ে প্রচলিত রয়েছে কার্টুন, ক্যারিক্যাচারের মাধ্যমে ভিন্নমত বা মতভিন্নতা ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। সেটা হতে পারে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, হতে পারে সামাজিক কোনো কিছু নিয়ে। চলমান ঘটনাবলী ফুটে ওঠে কার্টুনে। চূড়ান্ত স্যাটায়ারও হয় কার্টুনের মাধ্যমে। বাকস্বাধীনতার প্রকাশ হিসেবে কার্টুন/ক্যারিক্যাচারকে অনেক কাল আগে থেকেই গণ্য করা হয়। এটি ফ্রিডম অব প্রেসেরও অন্তর্ভুক্ত। তো প্রশ্ন করি, ধর্ম কি সমাজ জীবনের বাইরে? বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কুংস্কার নিয়ে যদি ক্যারিক্যাচার করা যায় তবে ধর্ম নিয়ে কেন করা যাবে না? পবিত্রতা-টবিত্রতা, সংস্কার-টংস্কারের ঘোরাটোপে ধর্মকে আর কতদিন শেল্টার দেয়া হবে?
আসল কথা শিল্পের মর্যাদা ইসলাম দিতে পারেনি। ইসলাম পুরোপুরি শিল্পবিবর্জিত। তাই ইসলামে নাচ, গান, অভিনয়প্রতিভার মূল্য নেই। কবিতা মাত্রই ইসলামের দৃষ্টিতে শয়তানের বাণী। হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি আর লালনের ভাস্কর্যে ইসলাম কোনো ভেদ খুঁজে পায় না। ইসলামের চোখে 'ভেনাস দ্য মিলো'র কোনো মূল্য নেই। ভিঞ্চির 'মোনালিসা' আঁকা ইসলামের চোখে হারাম। কীট্সের কবিতা পড়া হারাম, মোৎসার্টের সিম্ফোনীর স্বাদ নেওয়া হারাম।
'সাবমিশন' নামে ১১ মিনিটের একটি শর্টফিল্মের জন্য পরিচালক থিও ভ্যান গগকে (ভিনসেন্ট ভ্যান গগের গ্রেট গ্র্যান্ডসান) ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাস্তায় খুন করে এক মুসলিম মৌলবাদী। থিও-কে কয়েকটি গুলি করার পর এলোপাথারি ছুরিকাঘাত করা হয়, সাথে Butcher's Knife দিয়ে থিওর কণ্ঠনালী ফালি ফালি করে সেই মৌলবাদী। এছাড়াও ১৯৯৪ সালে নোবেল বিজয়ী নাগিব মাহফুজকে ছুরিকাঘাত করা হয় ধর্মনিন্দার অভিযোগে। আর আয়াতুল্লাহ খোমেনী তো সালমান রুশদির মাথা কাটার হুকুম কবেই দিয়ে দিয়েছেন!! এসব দৃষ্টান্ত কি শুধুই বিচ্ছিন্ন?
কে না জানে, মুমিন মোম্মদীয়াদের চমৎকার কৌশলী স্বভাব হচ্ছে, তারা সবসময় প্রচার করে তারা নাকি নির্যাতিত, নিপীড়িত! তারা স্রেফ নির্দোষ! যত দোষ নন্দ ঘোষ! তাদের ননীর মত নরম ‘ঈমান’ প্রতি মুহূর্তেই থল থল করে উঠে পত্রিকার পাতায় কার্টুন ছবি দেখে! আহারে!!
এই তো কয়দিন আগের ঘটনা। ২০০৫ সালে ডেনিশ পত্রিকা জিল্যান্ড পোস্টেনে ছাপানো ১২টি কার্টুন মোহাম্মদীয়াদের ধর্মবর্ম সব ছিন্নভিন্ন করে দেয়! তৌহিদী তেজে কেপে উঠে মুসলিম বিশ্ব!! এদের আগুনে হল্কা বাংলাদেশ তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকার মত দেশেও পৌছায়!! কার্টুন নিয়ে আমাদের দেশেও হাঙ্গামার ইতিহাস আছে। প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিন নিষিদ্ধ হয়ে গেল আরিফের ‘মুহাম্মদ বিড়াল’ কার্টুনটি নিয়ে। মোল্লাদের হৈচৈ আর জ্বালাও পোড়াও দেখে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বেশ ভড়কে গিয়েছিল। জেলে যেতে হল আরিফকে। আর এই তো কিছুদিন আগে ধর্মকারী থেকে প্রকাশিত কুফরী কিতাব ‘হজরত মহাউন্মাদ ও কোরান-হাদিস রঙ্গ’ নিয়েও মর্দে মুমিনদের ভিতরে ভিতরে গুড়গুড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইনকিলাব, সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত পত্রিকায় এদের আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ সীমিত হলেও টের পাওয়া গেছে।
ড্যানিশ পত্রিকা Jyllands-Posten-এ কার্টুন প্রকাশের পর হামাস নেতা মাহমুদ যাহার ইটালিয়ান দৈনিক Giornale-কে বলেছিল,
“We should have killed all those who offend the Prophet and instead here we are, protesting peacefully.”
হুম! তাঁদের এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে মোটে ১০০ জন নিহত হয়েছিল। তাঁরা শুধু পাকিস্তানের ড্যানিশ এম্ব্যাসিতে বোমা হামলা করেছিলেন আর সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের ড্যানিশ এম্ব্যাসিতে আগুন লাগিয়েছিলেন। যে পরিমাণ অপমানিত তাঁরা হয়েছিলেন সে তুলনায় এসব পরিসংখ্যানকে কি ধর্তব্যেই আনা উচিত?
আচ্ছা, মুমিন মোহাম্মদীয়ারা যদি কার্টুন একদমই পছন্দ না করে, তবে কি দরকার তাদেরকে এত খোঁচানো? কোনো মানে হয় বেচারাদেরকে বারে বারে কষ্ট দেয়ার? এটা ঠিক নয়। মোটেও না....
তয় নিচের কয়টা ছবি দেখি :
২০০৫ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখে সৌদি পত্রিকা ‘Al-Yawm’ এ ছাপানো কার্টুন! আহা! এ ছবিতে কোনো রেসিজম নেই! জিঘাংসা নেই! হুঁঙ্কার নেই! জাতিবিদ্বেষ নেই!! ইসলামের মতই পূতপবিত্র এই কার্টুন!
২০০৬ সালের ২৫ মে প্যালেস্টাইনি রাজনৈতিক দল হামাসের প্রকাশনা ‘আল-রিসালা’য় ছাপানো কার্টুন! আচ্ছা, মনে করুন এই ছবিটা যদি এমন হত, কাবা ঘরের সামনে একটা পিচ্ছি হিশু করে দিচ্ছে, তাইলে কি প্রতিক্রিয়া হত? মুহাম্মদীয়ারা খুব সাধু! তারা কিচ্ছু করে না!! শুধু শুধুই পশ্চিমারা মুহাম্মদীয়াদের সাথে ইয়ার্কি মারে। তাই না?
জর্ডানের ‘Ar-Rai’ -এ ছাপানো কার্টুন। ৫ নভেম্বর, ২০০৫।
সিরিয়ার ‘Tishrin’ পত্রিকা। ২১ এপ্রিল ২০০২।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন! এক ইহুদি বুশরূপ পাখিটারে বলছে, বল আমি আরব ঘৃণা করি, পাখিটাও তখন বলছে আমি আরব ঘৃণা করি! আমি আরব ঘৃণা করি!
আপেলের মত সুস্বাদু আরব দেশগুলোকে খেয়ে নিয়ে নিচ্ছে আমেরিকা এবং ইজরায়েলি শয়তানেরা!! ছাপা হয়েছে ২০০৩ সালের ১৩ মে। কাতারের ‘Al-Watan’ পত্রিকায়।
Al-Watan, February 3, 2004 (Oman). Translation: On left - Feast of the Immolation /On right - The Islamic World's Attitude?
৬ ফেব্র“য়ারি, ২০০৬। ইরানের পত্রিকা ‘Al-Wifaq’। এখানে ইসরাইলি বা ইহুদি এক শয়তান লিখতেছে : “I don't admit the limits of freedom of speech except the Holocaust."
নো কমেন্ট। এই ছবিই প্রমাণ করে দেয় মুসলিমদের ঈমান কি রকম। পশ্চিমে এ নিয়ে দুর্দান্ত একটা জোক আছে, 'Christians & Jewish martyrs say; "I will die for what I believe".
A Muslim martyr says; "You will die for what I believe".... '
শার্লি হেব্দোর সম্পাদক Stéphane Charbonnier এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, '' যারা 'ইসলাম কি' জানে না তারাই এই হামলা চালিয়েছে সাথে নিজ ধর্মকেও প্রতারণা করেছে।''
না, তারা মোটেই প্রতারণা করেনি। নিচের হাদিসটাই তা সাক্ষ্য দেবে।
Narrated Aisha (a wife of Muhammad):
I bought a cushion having on it pictures (of animals). When Allah's Apostle saw it, he stood at the door and did not enter. I noticed the sign of disapproval on his face and said, "O Allah's Apostle! I repent to Allah and His Apostle. What sin have I committed?' Allah's Apostle said. "What is this cushion?" I said, "I have bought it for you so that you may sit on it and recline on it." Allah's Apostle said, "The makers of these pictures will be punished on the Day of Resurrection, and it will be said to them, 'Give life to what you have created (i.e., these pictures).' "The Prophet added, "The Angels of (Mercy) do not enter a house in which there are pictures (of animals)."
— Sahih al-Bukhari, 3:34:318, 7:62:110
মানে কি দাঁড়ালো; প্রতিকৃতি আঁকা ইসলামে নিষিদ্ধ, এইতো।
নোয়াম চমস্কি একবার বলেছিলেন,
"If you believe in freedom of speech, you believe in freedom of speech for views you don't like."
কিন্তু মুসলমানরা কি বাক-স্বাধীনতার এই মতে বিশ্বাসী? অন্তত তাদের কার্যক্রমে তো তা মনে হয় না।
পৃথিবীতে অনেক ধর্ম এসেছে। অল্পই ঠিকেছে, বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঠিকেছে সেগুলোই যেগুলো সময়ের সাথে নিজেদের বদলে নিয়েছে, সংস্কার করেছে। ইসলামেরও তাই উচিত হবে নিজেকে সংস্কার করা, অন্তত শিল্পের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া। নতুবা মৌলবাদীদের এসব আক্রমনাত্মক কার্যকলাপে বিব্রত হতে হবে শুধুমাত্র মডারেট মুসলিমদেরকেই।
বলছি না যে শুধু মুসলিম মৌলবাদীরাই এমন করে। ইহুদি- খৃষ্টানদের মাঝেও মৌলবাদী আছে,তারাও মানবতার শত্রু।কিন্তু পৃথিবীবাসী ইসলামের মতো উল্লেখিত বাদবাকি ধর্মগুলো ততোটা খারাপ দৃষ্টিতে দেখে না। কারণ হয়তো পশ্চিমে ইসলামের ত্রুটিগুলো নিয়ে প্রচার বেশি।
বি: দ্র: লেখাটির জন্য অগ্রজপ্রতিম বন্ধুবর CriticBD-এর নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:২৩