জন্ম থেকেই জ্বলছি আমি। আমার রাত নেই, দিন নেই। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। চলছি তো চলছি। আমার কষ্ট বুঝার কেউ নেই। কেউ কোনোদিন আমার কষ্টের কথা জানারও চেষ্টা করেনি। আমার প্রশস্ত বুক মেলিয়ে দিয়েছি জনসেবায়। সেই বুক চিরে চলে যাচ্ছে একের পর এক যন্ত্রদানব। তিন চাকার রিকশা থেকে শুরু করে ১২ চাকার লরি। এভাবে চলতে চলতে আমি ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি। কোথাও কোথাও ক্ষতে সৃষ্টি হচ্ছে ক্যানসার। তারপরও কারও মায়া দয়া লাগে না। আর লাগবেই বা কেন? আমার যে সৃষ্টিই এ জন্য। তারপরও আমিওতো একটু সুখ আশা করতে পারি। আমারওতো একটু জিড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই সময়তো আমাকে দেয়া হচ্ছে না। কেন? কি অপরাধ আমার? কোথাও আমি সড়ক, কোথাও মহাসড়ক হিসাবে চিহ্নিত। রাজধানী ঢাকায়ও আমাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। আমাকে বিভক্ত করে কোনো কোনো এলাকার সড়ককে দেশের নামিদামি লোকের নামে নামকরণ করা হয়েছে। কোথাও আমি নাকি ভিআইপি সড়ক। আজ আমি শুধু গতকাল বৃহস্পতিবার ভিআইপি সড়কের দৃশ্যের কথা বলতে চাই। সকাল ১০টায় হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ায় সকল যানবাহন। একচুলও নড়ছে না গাড়িগুলো। আমি অবাক হয়ে পড়ি। কেন এমনটা হলো? কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ট্রাফিক পুলিশও অসহায় হয়ে পড়ে। দুপুরে ২টার পর মুষলধারে বৃষ্টি হয়। এ বৃষ্টিতে ভিআইপি সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। গুলিস্তান থেকে গাড়ির জ্যাম শুরু হয়। জিরো পয়েন্ট থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত আসতে প্রতিটি গাড়ির দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। যাত্রীদের যে কি দুর্ভোগ আমি দেখেছি তা বর্ণনার বাইরে। তাদের দুর্ভোগ দেখে আমার বুকে জমে থাকা কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়। মৎস্যভবনে এসে সেই গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে চালক বসে পড়েন। এখানে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর গাড়ির স্টার্ট দেয় চালক। কিন্তু দুই হাত যাওয়ার পর আবার স্টার্ট বন্ধ। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর গাড়িগুলো থেকে যাত্রীরা নেমে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। আশ্চর্যই হন যাত্রীরা। শাহবাগ মোড়ে এসে দেখেন কোথায় যাবে গাড়ি। সকল রাস্তায় গাড়ির চাকা বন্ধ। অচল হয়ে পড়ে আছে গাড়িগুলো। ট্রাফিক পুলিশও রাস্তা ছেড়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদেরও যে কিছুই করার নেই। কারণ গাড়ির সিগন্যাল দেয়ার উপায়তো নেই। সামনের রাস্তা ব্লক। এক মহাগ্যাঞ্জাম। সড়কে পানির উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। নারী, পুরুষ সবাই হাঁটছেন। ভিআইপি সড়কে যানজট। ফুটপাথে লেগেছে জনজট। আমি দেখছি। কিছুই করার ছিল না আমার। শুধু ভাবি কেন আমাকে ভিআইপি সড়ক নামে ডাকা হয়। আমার মাঝে আলাদা কি এমন আছে? কই আমিতো কিছু দেখিনা। আবার ভাবি দেশের মানুষগুলো এত ভালো হয়ে গেছে। কেউ কিচ্ছু বলছেন না। নীরবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভাবছি এটা কেমন দেশ? যেখানে নিয়মের বালাই নেই। যেখানে সময়ের দাম নেই। যেখানে সিস্টেম বলতে নেই। এসব নিয়ে কেউ ভাবে এমনও দেখা যায় না। কারণ যানজটতো দীর্ঘদিনের। এরপরও কেউ তা নিরসনে কোনো উপায় বের করতে পারছে না। এটা কেমন কথা। তাহলে এতসব সংস্থা রেখে লাভ কি? ভাবছি, পাশের দেশ ভারতের কথা। সেখানকার এক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। যেখানকার ভাষাও বাংলা। সেখানে এক নিয়মের মধ্যে চলছে গাড়িগুলো। সড়ক-মহাসড়কগুলো কত না আরামে দিন কাটাচ্ছে। মানুষজনও নিশ্চিন্তে আসা-যাওয়া করছে। শোনা যায় একশ মাইল দূর থেকে এসে অনেক মানুষ শহরে অফিস করেন। তাদের নেই কোনো অনুযোগ, নেই কোনো অভিযোগ। তাহলে আমরা কেন পারছি না। আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে একটি লেগুনা থেকে এক কলেজ ছাত্র ছিটকে পড়ে। প্রায় পাঁচ মিনিট ছাত্রটি সংজ্ঞাহীন ছিল। পরে লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে। ওই কলেজ ছাত্র লেগুনার দরজায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। এখানেই সমস্যা। দরজায় একজন হেলপার থাকে। সে ভাড়া উঠায়। প্রায় সময়ই দেখা যায়, এই দরজায় একাধিক লোক উঠে যাচ্ছে। এত গাড়ি থাকার পরও কেন কুলাচ্ছে না। কেন গাড়িগুলো টাকার লোভে মানুষজন এভাবে উঠায়? আর যাত্রীরাই বা কেন টাকা দিয়ে এভাবে যাতায়াত করবে? সে যাকগে সেসব কথা। আমি আমার কথায় আসি। আমাকে বিভিন্ন নামে ডাকলেও আমি একই। ভিআইপি সড়ক হলেও ভিআইপির মর্যাদা আমাকে কতটুকু দেয়া হচ্ছে আপনারাই দেখেন। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে মহাখালী পর্যন্ত রাস্তার পুরোটাই সব সময় থাকে যানজটে অবরুদ্ধ। ফ্লাইওভার করে যানজট কমানোর কোনো লক্ষণ দেখছি না। বরং যেন আরো যানজট বেড়েছে। ইদানীং যাত্রাবাড়ী থেকে মাতুয়াইল পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ফ্লাইওভার করে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার নিচের রাস্তা এত সরু করা হয়েছে যে সেখান দিয়ে একটি গাড়ি যাওয়াই দুষ্কর। এ ছাড়া রাস্তাগুলো বছরের পর বছর মেরামতহীন। ভাঙ্গা, এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে। ফলে একটি গাড়ি খুব আস্তে আস্তে যেতে হয়। ওদিকে অন্যগাড়ি আটকা পড়ে। এতে যানজটের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমি বুঝি সাধারণ মানুষের বলার জায়গা নেই। তাই তারা বলতে পারে না। সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়। কিন্তু এভাবে কতদিন?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭