সাদা-কালোর দাবার ঘুঁটি। হাতি, ঘোড়া আর রাজা রানী। দরকার চাল, কৌশল ও মারপ্যাঁচ। তাহলেই কেল্লাপতে। জয়ের হাসি। এই দাবার চালই হলো রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। কৌশলী চালে কখন কে কুপোকাৎ হয় বলা মুশকিল। আবার নিজের চালে নিজেই ধরা খাওয়ার নজিরও রয়েছে ভূরি ভূরি। যুগের পর যুগ দাবার ঘুঁটির হাতি-ঘোড়াই রাজা-রানীকে আটকে দিয়েছে। আবার এগিয়ে নিয়েছে শীর্ষে। কাউকে ভাবিয়েছে। কাউকে কাঁদিয়েছে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিও বন্দি দাবার ঘুঁটির কাছে। শুধু চাল যুৎসই হলে পক্ষে যাবে। অন্যথায় বিপদ। রাজা-বাদশার আমল, জমিদারি আমল, উপনিবেশ আমল আর গণতন্ত্রের আমলÑ ঘুরেফিরে একই। কে জানতো এক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর ভর করে বৃটিশরা এ উপমহাদেশকে নিজের কব্জায় নেবে? চতুর ও সাহসী নবাব সিরাজউদদৌলা বৃটিশদের চালে ধরা খাবেন? আর বৃটেনে বসে হাজার মাইল দূর থেকে রানী এলিজাবেথ ভারতবর্ষ শাসন করবেন? এক যুগ কিংবা দুই যুগ নয়। দীর্ঘ প্রায় দুইশ বছর। এ সময়ে চলেছে নানা খেলা। দাবার খেলায় শেষ পর্যন্ত হেরে যায় বৃটিশরা। ভারতবর্ষ ছেড়ে পালাতে হয় তাদের। এরপর ভারতবর্ষ স্বাধীন। এখানেও চলতে থাকে দাবার চাল, কৌশল আর মারপ্যাঁচ। দ্বিজাতি তত্ত্বকে সামনে রেখে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যায়। যার একদিকে পাকিস্তান, অপরদিকে ভারত। এরপরও কি রাজনীতির দাবার চাল থেমে ছিল? না! বরং আরো বেড়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তান যেন দাস হয়ে পড়ে। ক’বছর যেতে না যেতেই ভাষার ওপর আঘাত হানে। শুধু তা-ই নয়, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে তারা হয়ে ওঠে যেন জমিদার। আর পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা তাদের প্রজা। পাকিস্তানের দু-চোখা নীতির চালে পিষ্ট হওয়া পূর্ব পাকিস্তানিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার নানা কৌশল আর চালের খেলায় মেতে ওঠে জেনারেল ইয়াহিয়া। সংখ্যালঘু দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো হাত মেলায় ইয়াহিয়ার সঙ্গে। তারা দুজনে আঁটে নতুন আরেক চাল। শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখতে কামান নিয়ে নামে রাজপথে। কিন্তু তাদের এ চালে নিজেরাই ধরা খায়। আর ওই চাল যে ভুল ছিল তারই প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পেরিয়েছে। দেশ এগিয়েছে অনেক। খাদ্যে অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। উন্নয়নও হয়েছে ব্যাপক। অজপাড়াগাঁয়েও রাতের আকাশে ঝিলিক দেয় বিদ্যুতের আলো। এনালগ থেকে পা দিয়েছে ডিজিটাল যুগে। কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতিতে দাবার চাল কি বন্ধ হয়েছে আজও? নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার হটিয়ে দেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে এমনটাই আঁচ করা যাচ্ছিল। কিন্তু না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। সরকার গঠন করে তারা। দেশ এগুতে থাকে। কিন্তু উপনির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে জাতির সামনে। সর্বশেষ মাগুরা উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে কারচুপি সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। সামনে আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। এ দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে। দুপক্ষ থেকেই চলতে থাকে দাবার ঘুঁটি চালা। আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধী দল তখন রাজপথে। রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে আওয়ামী লীগ জনতার মঞ্চ স্থাপন করে। এর আদলে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনতার মঞ্চ স্থাপন করে। গোটা দেশ হয়ে পড়ে অচল। এরই মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করা হয়। মাত্র কয়েকদিনের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাস করে ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। নতুন নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতার মসনদে বসে আওয়ামী লীগ। আবারও পাঁচ বছর আন্দোলন সংগ্রাম। বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন। এভাবেই চলে যায় পাঁচ বছর। ২০০১ সালে বিএনপি করে জোটবদ্ধ নির্বাচন। এ চালে জয়ী হয় বিএনপি। সরকার গঠন করে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি দাবার চাল চালতে থাকে। আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়। এতে ক্ষেপে যায় আওয়ামী লীগ। তারা সময় মতো রাজপথে নামে। দাবার চাল চলতে থাকে দুপক্ষে। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া প্রেসিডেন্টের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষমতা ছাড়েন। কিন্তু এ চাল যুৎসই ছিল না তা টের পাওয়া যায় ক’দিন পরই। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েক উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। ঘোলাটে হয়ে পড়ে পরিস্থিতি। এ সুযোগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তিন মাসের জন্য এসে তারা দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। তারাও দাবার চাল কম চালেনি। রাজনীতিকে ধ্বংস করার নানা প্রয়াস চালায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। আরো অনেক রাজনীতিককে করা হয় রাজবন্দি। শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারেননি। নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী। এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে দাবার চাল উল্টো চালেন। আদালতের নির্দেশনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠিয়ে দেন। এর স্থলে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন পরিচালনার আইন করেন। বিএনপির তীব্র বিরোধিতাও এক্ষেত্রে কাজে আসেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দাবার চালে থমকে যায় বিএনপি। যার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে তাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেন নির্বাচন নিয়ে সংলাপে বসতে। খালেদা জিয়া হরতাল, অবরোধের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দেননি। অবশ্য তিনি সময় চেয়েছিলেন। সে সময় চালের পর চাল চলতে থাকে দুদিক থেকেই। বিদেশিদের চাপ, ভোটারদের অনীহা সত্ত্বেও নির্বাচনী বৈতরণী উৎরে যায় সরকার। বিএনপি ভেবেছিল কয়দিন আর? সরকার ঠিকবে না। বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলেন, সে সময় আওয়ামী লীগ বলেছিল নিয়ম রক্ষার একটা নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে সবকিছু। এই দাবার চালে কুপোকাৎ হয়ে যায় বিএনপি। নির্বাচনের ইতিমধ্যে তিন বছর পেরিয়েছে। সরকার সবদিক সামলে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলেও নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। তবে সাদা কাপড়ে একটা কালো দাগ লেগে গেছে। বিএনপির হয়তো এখানেই তৃপ্তি। তাই তো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বুলি আওড়াচ্ছেন তিন বছর ধরেই। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে সরকারি দল কাজ শুরু করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনী জনসভা না হলেও বগুড়া ও লক্ষ্মীপুরে বিশাল জনসভা করেছেন। তিনি দুটি জনসভায়ই নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী ময়দানে পুরোদমে হাঁটছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অনেক আগে ঘোষণা দিয়েছেন আগামী নির্বাচন পরিচালনার জন্য সহায়ক সরকারের প্রস্তাব জাতির সামনে তুলে ধরবেন। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় মতামত তুলে ধরতে গিয়ে খালেদা জিয়া এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেছিলেন। মূলত তার দাবি অনুযায়ীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠনে মতামত জানতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেন। আর বিএনপিকে দিয়েই তা শুরু করেন। এখানেও চলে আরেক চাল। আরেক কৌশল। প্রেসিডেন্ট সার্চ কমিটি গঠন করেন। সার্চ কমিটি দেশের বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারপর নাম দেন। সেই নাম থেকে একজন সিইসি ও চারজন কমিশনার নিয়োগ দেন। বিএনপির দাবি অনুযায়ী দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন মহিলা কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরতে পারেনি জনগণের সামনে। প্রতিপক্ষ যখন নির্বাচন নিয়ে মাঠে তখনও তারা বসে আছেন সময়ের অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা কী বিএনপির কোনো দাবার চাল? এর উত্তর তারাই জানেন। কয়েক বছর ধরে দেখা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাতে অফিস করেন। তিনি যখন অফিস করতে বসেন তখন আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ শেষে অবসরে যান। রাতে অফিস করা কোন দাবার চাল এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকও খালেদা জিয়ার সঙ্গে মতবিনিময়ে অফিস সময় এগিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন মাঠ গরম। নির্বাচন মাথায় রেখে দু’তরফেই শুরু হয়েছে দাবার চাল। সাদা চোখে দেখা যায় নির্বাচনী ময়দানে পুরোদমে মাঠে আওয়ামী লীগ। তারা একের পর এক ছক্কা হাঁকিয়ে যাচ্ছেন। বোলিং আর ব্যাটিংয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন। দর্শক ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা তাদের। অন্যদিকে বিএনপি দর্শকের দৃষ্টি কাড়ারও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে দাবার ঘুঁটি হাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আগামী দিনে কে কিভাবে চাল দেন এটাই বিষয়। শেষ কথা হলো- রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। দাবার ঘুঁটির শেষ চাল দেখার অপেক্ষায় আমজনতা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৮